ঘড়িতে এখন সময় ১১টা বেজে ৩৭মিনিট পুরো এলাকা নিস্তব্ধ হয়ে এসেছে যেমন টা পুরো দেশটাও হয়ে পড়েছে। কামাল, পলাশ, শিমুল, সালাম সবাই উপস্থিত কিন্তু আজাদ এখনও উপস্থিত হয়নি!
কি ব্যাপার ওর তো এতো দেরি হওয়ার কথা নয়! পথে কোনো সমস্যা হলো নাকি?! কামাল বলল।
কি জানি বাপু? হতেও তো পারে দেশের যা অবস্থা!! শিমুল বলল একপাশ থেকে।
আরে নাহ্! ও অনেক বুদ্ধিমান ছেলে আমি ওকে চিনি। ওর কোনো সমস্যা না হবারই কথা। সালাম উত্তর করলো, একটু টেনশন নিয়েই।
আরেক পাশে বসে পলাশ চুপ করে কালকের মিশনের ম্যাপ টা দেখছিলো।
ওদের কথোপকথনের কিছুক্ষনের মধ্যেই আজাদ উপস্থিত
ওহ্! সবাই হাজির, শুধু আমিই লেট।
পলাশ চোট করে ম্যাপ থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো
কিরে আজাদ তোর এতো দেরি কেন?! ভাই মিশনে যাবো, মানচিত্রের মিশন আর তুই দেরি করে মিটিংয়ে আসলি।
সরি ভাই, ভুল হয়ে গেছে। কথা না বাড়িয়ে আর সময় নষ্ট না করে মিটিং শুরু কর।
আজাদের মনটা খুব ভারী হয়ে আছে, কিন্তু এটা সে বুঝতে দিচ্ছে না কাউকে।
পলাশ বলে উঠলো, কারও কোনো কথা বা দ্বিমত থাকলে জানাতে পারিস, সালাম ভাই আপনার কোনো কথা আছে কি?
সালাম ওদের মধ্যে একটু সিনিয়র এবং লিডার মানে বড় ভাই।
সালাম বলল, আমার শুধু একটাই কথা প্লান বুঝে ঠিক মত কাজ করতে হবে। জীবনের ঝুঁকি আছে এবং থাকবেই কিন্তু পিছ পা হওয়া যাবে না। এর আগে দেশের জন্য কেউই পিছ পা হয়নি। সবার মনে থাকবে তো?
সবাই প্রফুল্ল হয়ে বলল কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আজাদ একটু আনমনে ছিল।
তার চোখে কেবলই একটা মুখ ভেসে উঠছে বারবার। মাকে সে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছে বাসায়।
সবাই মিটিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথায় মত্ব। পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিচ্ছে সালাম ভাই।
ভোরে গেরিলা বাহিনী ভ্যান নিয়ে ঢুকবে শহরে আর এই সুযোগ! একটা আচমকা আক্রমণ ব্যাস।
একপাশ থেকে কামাল বলে উঠলো, কিন্তু এই ছোট খাটো আক্রমণে কি আর হবে? ওরা তো অনেক সৈন্য, সমরাস্ত্র, গোলা বারুদ নিয়ে ঢুকবে। উল্টো আমরাই রিস্কে পরে যাবো, আর বুঝতেই পারছেন ভাই, ধরা পড়লে সোজা স্যুট করে দিবে।
সালাম বললো, তোর কথা সব ঠিক আছে, কিন্তু একটু তো রিস্ক তো নিতেই হবে। আর দেশের জন্যে দশের জন্য জীবন বাজি না রাখলে কি হবে!?
শিমুল তার জায়গায় বসে থেকে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো। আর ম্যাপের দিকে তাকিয়ে থেকে একটু শান্ত গলায় বলল,
আচ্ছা ভাই, ওরা কি নিশ্চিত আজকে ভোরেই শহরে ঢুকবে!? আর এই পথ দিয়েই কি ঢুকবে?
পলাশ উত্তর দিলো, শোন, খবর ভুয়া হবার কোন সুযোগ নেই। কারণ বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাইছি। ধর, ভোর ৪ টার পরেই গেরিলা সৈন্য বাহিনী পথে পাওয়া যাবে আর তখনই এট্যাক।
শিমুল ওর দিকে তাকিয়ে, হুমম, সুন্দর পরিকল্পনা, এখন শুধু সফল হলেই হয়। একটু আঘাত হাঁনতে পারলেই হলো, এই সময়ে একটুকুই অনেক।
সালাম আজাদকে জিজ্ঞেস করলো, আজাদ তুমি কি বুঝতে পেরেছো?
আজাদ একটু হকচকিয়ে উঠে বললো, হ্যা বুঝতে পেরেছি সব।
সালাম জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি কোনো কোন কারণে চিন্তিত বা ভয় পাচ্ছ?!
আজাদ বললো, আরে না ভাই, এই একটু অন্যমনস্ক ছিলাম।
সালাম বললো, আমরা এই পাঁচ জন আছি, পথে আমাদের অনেক সঙ্গী থাকবে কিন্তু মূল মিশনে যাবো শুধু আমরা পাঁচজন।
আর কোনো প্রশ্ন এই ব্যাপারে।
সবাই একসাথে বললো, না ভাই আর কোনো প্রশ্ন নেই।
আজাদ তখনোও মায়ের কথাই বেশি ভাবছিলো।
বিকেলে যখন আজাদ নিজের বাসায় ঢুকলো, তখন থেকেই মা খুব জিজ্ঞেস করছিলো, কিরে বাবা তোর এতো দেরি হলো কেন? পথে কোনো সমস্যা হয়নি তো? দেশের যা অবস্থা!!
আজাদ মাকে শান্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, মা সব ঠিক আছে কোনো সমস্যা হয়নি আমার।
সন্ধ্যে বেলায় বিছানায় শুয়ে ছিলো আজাদ। মা ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো কিরে বাবা তোর কি শরীর খারাপ? কপালে বুকে হাত দিয়ে ভালো করে ছুঁয়ে দেখলো, না জ্বরতো না তো তাহলে শুয়ে আছিস কেন?
আজাদ বললো, মা এমনি শুয়ে আছি, ক্লাস করে একটু ক্লান্ত।
মা বললো, এ কয়দিন তুই ভার্সিটিতে যাস না, সব পরিস্থিতি ঠান্ডা হোক তারপর যাবি।
আজাদ একটা অট্টহাসি দিলো হা হা হা, মা পরিস্থিতির ভয়ে যদি বাইরে না যাই তাহলে কি সব ঠান্ডা হয়ে যাবে?
মা বললো, হোক আর না হোক তোর বাইরে যাওয়ার দরকার নেই।
আজাদ বললো, মা তুমি এত বেশি ভাবো কেন? আমরা এখন বড় হয়েছি না। হা হা হা..
তখন রাত ১টা বেজে ২২ মিনিট।
সালাম প্ল্যানটা বুঝিয়ে দিচ্ছে সবাইকে, ব্যাপার টা ভালো করে বুঝে নে, আমরা সময় কিন্তু খুব স্বল্প পাবো যা করতে হবে ওই অল্প সময়ের ভেতরই করতে হবে। ভ্যানের সামনে দুটো জিপ থাকবে তারপর জিপ দুটো একটু এগিয়ে গেলে ভ্যানে সোজা আক্রমণ। বিস্ফোরক পথে বুঝিয়ে দেবে সিনিয়র লিডার।
কামাল একটু কেঁপে উঠে বললো, ভাই, আমার একটু ভয় লাগছে আমরা মিশন সফল করতে পারবো তো?
সালাম উত্তর দিলো, আরে বোকা ছেলে, পারবি না কেন!? আমরা না পারলে কি হবে?!
শিমুল খুব এক্সাইটেড ছিলো, পাবর না মানে! শিওর পারবো। ১০০% শিওর।
পলাশ বলে উঠলো, সাবাশ এভাবে না বললে কি হয়।
আজাদ ওদের সব কথা চুপ করে শুনছিলো।
রাতে মা ওর জন্য গরুর কলিজা ভুনা করেছিল, আর খাওয়ার শেষে পায়েশ খুব নাক ডুবিয়ে খেয়েছে।
আহ, মা তোমার হাতে জাদু আছে।
মা বললো, তোর এই কথা শুনে শুনে দাঁত সব পরে যাচ্ছে। এবার একটা বিয়ে কর আমার রান্নার সঙ্গী এনে দে।
আজাদ একটু মৃদু হাসি দিয়ে বললো, মা,, বিয়ে যদিও করি; রাধবে কিন্তু তুমিই, হা হা হা..
সালাম আবারও আজাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কি হয়েছে আজকে, একদম অন্যমনস্ক তুমি!!
আজাদ বললো, না ভাই তেমন কিছুনা। মায়ের কথা মনে পড়ছিলো এই।
সালাম একটু মুচকি হেসে বললো, তা ঠিক আছে, আর অন্য কারও কথা মনে হচ্ছে কি?!
আজাদ জোরে এক অট্টহাসি দিলো, হা হা হা..
তখন সবাই নিচু গলায়, এই এই আস্তে আস্তে হাসির সাউন্ড কমা। আমরা এখানে আছি জানলে বিপদ হতে পারে!
আপাতত মিটিং শেষ।
এরপর সবাই যে যার মত করে একটু বিশ্রাম করতে লাগলো রাত ৩টায় বের হতে হবে ওদের, শেষ রাতে বের হয়ে ওরা সবাই প্রস্তুতি নেবে ছোট যুদ্ধের।
আজাদ বাড়ি থেকে বের হবার আগে মা'য়ের ঘরে ঢুকলো।
মা পুরো সংসারটা বাবাহীন গত দুই বছর একলাই টেনে নিয়ে এসেছেন! মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, আরও অনেক কিছু এই এতটুকু সময়ে সাধন করেছেন।
মা'র কাছে গিয়ে বসতেই, কিরে বাবা কিছু বলবি? ঘুমাস নি কেন এখনো? নাকি পড়বি আরও।
আজাদ বললো, এমনি মা ঘুম আসছিলো না। তুমি এখনও জেগে আছো।
মা বললো, আমার ঘুম আসছে না দুশ্চিন্তায়, দেশে কি শুরু হলো।
আজাদ বললো, মা একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, কোনো সমস্যা থাকবেনা দেশে; দেখো একদিন।
এরকম ভাবে কথা বলতে বলতে একসময় মা ঘুমিয়ে পরে।
আজাদ চুপ করে ওর ঘরের ভেতরে দরজা লক করে বাইরে বের হওয়ার আরেকটা দরজা ছিলো সেটা দিয়ে বের হয়ে গেলো।
রাত ৩টা কাটায় কাটায়, সালাম সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, আজ রাত অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাত এই মিশন সফল হলেই আমাদের স্বাধীনতার যাত্রা শুরু। সবাই সাহসের সাথে এগিয়ে যাবে, ভুলে যাবে না লড়াইটা দেশের জন্যে।
সবাই এক সাথে কামাল, পলাশ, শিমুল, আজাদ আর সাথে সালাম ভাই খুব উত্তেজিত হয়ে আছে কখন মিশন শুরু হবে।
কিন্তু একটা সমস্যা ছিলো, কে আগে বিস্ফোরক বোমা নিয়ে ছুটে যাবে? সোজা কাজ নয়, ভুল হলেই ওখানেই ইতিহাস।
পলাশ সালামকে জিজ্ঞেস করলো, ভাই কে আগে যাবে বলে দিলেন না তো।
শিমুল হাত উঁচিয়ে বললো, ভাই আমি এক পায়ে দাঁড়ানো,
কামালও এক পায়ে দাঁড়ানো, বললো আমাকে দিন এই দায়িত্ব।
সালাম সবার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো, গুড, তোমাদের সাহসের প্রশংসা করি! কিন্তু কে প্রথমে যাবে সেটারও সমাধান হয়ে গেছে।
সিনিয়র লিডার আজাদকে ঠিক করে রেখেছেন প্রথম এটাকের জন্য।
আজাদ হাসি মুখে বললো, আমি প্রস্তুত।
সবাই হাসি মুখে বললো, নে তুই শুরু কর আমার সবাই এক এক করে ঝাঁপিয়ে পরবো, তোর শুরুর নেপথ্যে।
ম্যাপ ধরে ওরা সবাই শহরের মূল প্রবেশ পথে পৌঁছে গেলো। সবাই প্রস্তুত। সবারই হৃদ স্পন্দন চারগুন। এরকম মিশনে সবাই নতুন, কেউ আগে এরকম পরিস্থিতি মোকাবেলা করেনি। ওরা পাঁচজন ওঁত পেতে আছে, আক্রমনের জন্য।
আজাদের কাঁধে হাত রেখে , কিরে পারবি না?! সালাম জিজ্ঞেস করল।
আজাদ উত্তর দিলো, সুন্দর এক হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে,
পারবো ভাই, নিশ্চিত পারবো। মায়ের জন্য সব করতে পারবো।
এরপর যদি আরেকটা জীবনে ফিরে আসি সেই জীবনটাও মায়ের জন্যই উৎসর্গ করে দিবো...!
পাদটিকা:- মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে এই কাল্পনিক গল্প লেখা। বাস্তবের এর কোনো মিল হয়তোবা নেই। তবে এখানে এই পাঁচজন যুবকের দেশ প্রীতি শাশ্বত।
আর এখানে মূলত আজাদের মায়ের প্রতি যে ভালোবাসা, মমতা তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি মাত্র। আজ বিশ্ব 'মা' দিবস। মাকে নিয়ে অনেকে অনেক অনুভূতি শেয়ার করেছেন। আমি মনে করি মায়ের জন্য এরকম দিবস প্রয়োজন হয় না। প্রতিদিন মাকে ভালোবাসুন, প্রতিদিনই হোক মা দিবস।
.
একটা প্রশ্ন-
মা কি সন্তানের জন্য কোনো দিবস পালন করে..??
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৭ রাত ১:১৮