বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’:
বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের অসমাপ্ত উপাখ্যান
আবদুল্লাহ আল আমিন
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বন্দী ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। বন্দী মুজিব জানতেন না মুক্তিযুদ্ধের কথা, জানতেন না পাকিস্তানীদের বর্বরতা, গণহত্যা, নির্যাতন, নিপীড়নের কথা; পাকিস্তানীরা তাকে তা জানতে দেয়নি। কিন্তু সমগ্র বাঙালি মুজিবকে হৃদয়ে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধ করে চলেছিল। একাত্তরে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি হয়ে উঠেছিল মুজিবের দ্বিতীয় সত্তা। কারণ ‘১৯৭১ এর মার্চে শেখ মুজিব সৃষ্টি করেছিলেন শুভ দাবানল, শুভ প্লাবন, শুভ অগ্নিগিরি, নতুন ভাবে সৃষ্টি করে ছিলেন বাঙালি মুসলমানকে যার ফলে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম।’(হুমায়ুন আজাদ, আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ২০০৬। পৃষ্ঠা : ২৫)
পাকিস্তানী কারাগারে অবরুদ্ধ থেকেও ন’ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে তিনিই ছিলেন নিয়ন্ত্রক, তিনিই ছিলেন বাতিঘর। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল তাঁকে রাষ্ট্র প্রধান করেই বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করা হয়। এবং এই সরকারের শপেেথর স্থানটি বৈদ্যনাথতলা থেকে মুজিবনগরে পরিণত হয়ে যায়। বাঙালির এই কালজয়ী পুরুষকে নিয়ে একালে বাংলাদেশের প্রায় সব কবি রচনা করেছেন অসংখ্য স্তব গাথা, নিউজউইক ম্যাগাজিন ১৯৭১ সালেই তাঁকে দিয়েছে ‘চড়বঃ ড়ভ ঢ়ড়ষরঃরপং’ এর অভিধা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবি- সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ থেকে উপন্যাস পর্যন্ত রচনা করেছেন। কিন্তু তিনি কী নিজেকে নিয়ে তেমন কিছু লিখেছেন? আমরা জানতাম তিনি লেখক বা তাত্ত্বিক ছিলেন না, কোন তত্ত্ব বা মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি রাজনীতি করেন নি, তিনি সারাজীবন রাজনীতি করেছেন মানুষের দুঃখ বেদনায় তাপিত ও মথিত হয়ে। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়ে বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বদলে গেল আমাদের পূর্ব ধারণা। আমরা আবিস্কার করলাম লেখক শেখ মুজিবুর রহমানকে। বইটি পড়ে জানা গেল, এককালের এক তেজস্বী ছাত্রনেতা কীভাবে মহানায়কে পরিণত হলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লেখক ছিলেন না, কিন্তু ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেনি। বই এ লেখক ব্যক্তি জীবনের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের অসমাপ্ত ইতিহাস। শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মাজীবনী মূলতঃ বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অসমাপ্ত কাহিনী। তিনি অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় তাঁর জীবন ও সমকালীন ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরেছেন। নিজের পাণ্ডিত্য কোন ভাবেই তিনি জাহির করতে চাননি, যা দেখেছেন এবং বুঝেছেন তাই লেখার চেষ্টা করেছেন নিজেস্ব ভঙ্গিতে। কোন আরোপিত জ্ঞানভাষ্য বা তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই আত্মকথা বিবৃত করেন নি তিনি।
বঙ্গবন্ধুর মতো আত্মকথা ইতোপূর্বে অনেকেই লিখেছেন। ভারতে এই ধরনের আত্মজীবনী লিখেছেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, বিপিনচন্দ্র পাল, জওহরলাল নেহেরু, মহাত্মা গান্ধী, রাজেন্দ্র প্রসাদ, মওলানা আবুল কালাম আজাদের মতো বরেণ্য নেতারা। আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা, ঘানার নক্রুমা, সিঙ্গপুরের রাষ্ট্রনায়ক লি কুয়ান ইউ, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের অন্যতম পুরোধা পুরুষ কেসলি হেফোর্ড, কেনিয়ার জোমো কেনিয়াটা, জাম্বিয়ার মার্কাস গার্ভে প্রমুখ জননায়ক এ ধারার আত্মজীবনী লিখেছেন। এ কালের ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে ‘শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটিকে বাংলাদেশের ক্ল্যাসিকাল জাতীয় আত্মকথা বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। ব্যক্তিজীবন
জনজীবনে প্রোথিত করায়, সমকালের প্রয়োজনে আপাতত ইতিহাসের নির্বাচিত অংশের উদ্বোধনে, জাতির স্ব- নির্মিত অতীত প্রকল্প গঠনে এবং জনপ্রিয় ও সম্ভাব্য মুক্তিপ্রাপ্ত ভবিষ্যতের চিত্রাঙ্কনে মুজিবুরের এই অসমাপ্ত আত্মকাহিনী ধ্র“পদী ভাঙ্গিতেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের জীবনী কথা। যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ১৯৭১ সালে পূর্ণ মুক্তির দীক্ষা নেবে, তার ....... আখ্যানে পাওয়া যাবে অধুনা আবিস্কৃত ও সদ্য প্রকাশিত স্মৃতি কথনে”। (আলাপন বন্দোপাধ্যায়, জাতির জীবনঃ দেশ ও নায়ক । দেশ ২ ডিসেম্বর ২০১২। পৃ ঃ ৬০)
বঙ্গবন্ধু ১৯২০ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাঁর আত্মজীবনী লিখেছেন এবং লেখার সময়কাল ১৯৬৬-৬৯ সাল যখন তিনি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী আবিস্কার ও প্রকাশে মূল কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গ্রন্থটি প্রকাশনায় তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন জাতীয় অধ্যাপক ইতিহাসবিদ সালাউদ্দীন আহমেদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শামসুল হুদা হারুন, ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খান ও বেবী মওদুদ। গ্রন্থটি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন: ‘এই মহান নেতার নিজের হাতে স্মৃতি লিখে গিয়েছেন যা তার মহা প্রয়াণের ঊনত্রিশ বছর পর হাতে পেয়েছি’। ( ‘ভূমিকা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।
১
১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন যখন তুঙ্গবিন্দু স্পর্শ করেছে, সেই বছর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার মধুমতী তীরবর্তী টুঙ্গিপাড়া গ্রামের শেখ বংশে শেখ মুজিব জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান। লেখার শুরুতে তিনি জানাচ্ছেন, শেখ বংশের গোড়াপত্তন করেন শেখ বোরহান উদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ। বই এ তিনি লিখেছেন, কীভাবে শেখ পরিবার ইংরেজ শাসকদের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে এবং কীভাবে শেখ পরিবার পুরনো ঐশ্বর্য হারিয়ে ফেলে। শেখ মুজিব ব্যক্তি ও রাজনৈতিক জীবনে ছিলেন অসমসহসী ও প্রতিবাদী- এসব গুণাবলী তিনি পেয়েছিলেন সম্ভবতঃ উত্তরাধিকার সূত্রে শেখ পরিবার থেকে। তিনি প্রবাদতুল্য স্মৃতিশক্তির আধিকারী ছিলেন, যাকে দু দশক আগে একবার দেখেছেন তার নাম বলতে পারতেন। এ কারণে ডায়েরি কিংবা কোন প্রকার দলিল ছাড়াই অনায়াসে লিখেছেন বিশ বছর আগের ঘটনা এবং অভিজ্ঞতা। লিখেছেন শৈশব কৈশারের অম্ল মধুর স্মৃতি, পূর্বপুরুষের কথা, প্রাত্যহিক জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় আসয় এবং ভালবাসা ও বেদনামথিত জীবনের নানাদিক।
শেখ মুজিবের রাজানৈতিক জীবনের গোড়াপত্তন মহানগর কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলে। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত লেখাপড়া ও রাজনীতি করেছেন কলকাতায়। ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলে থাকতে তিনি সান্নিধ্য লাভ করেন করেন শিক্ষাবিদ ইৎরাত হোসেন জুরেরী এবং দার্শনিক অধ্যাপক সাইদুর রহমানের। তাঁরা দুজনেই ছাত্র শেখ মুজিবকে স্নেহ করতেন গভীর ভাবে। এছাড়াও আঠার বছরে বয়সে কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। গ্রন্থের লেখক শেখ মুজিব জানাচ্ছেন, অন্যান্য বাঙালি মুসলমান তরুণের মতো তিনিও মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাস ভূমির জন্য পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই বাঙালি মুসলমানের স্বপ্নের রঙ ফিকে হয়ে যেতে থাকে ফলে তাদের মোহভঙ্গ হতে বেশি দেরি লাগেনি। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই তারা বিষয়টি বুঝেছিলেন এবং বন্ধুবান্ধব মিলে আলোচনা ও বৈঠক করেছিলেন কিভাবে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আলাদা রাষ্ট্র করা যায়।
২
১৯৪০ এর দশকের দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বাঙালির মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকট, মুসলিম লীগের মধ্যে প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল দ্বন্দ্ব, দেশভাগ, দেশত্যাগÑ এসব নিয়েই মুজিবের প্রথম যৌবন। তিনি দেখেছেন মুসলিম, লীগ ক্রমশঃ অভিজাত প্রতিক্রিয়াশীল ভূ স্বামীদের দখলে চলে যাচ্ছে। তাঁর স্বপ্ন মুসলিম লীগ যেন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র বাঙালি মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। মুসলিম লীগকে ‘জনগণের প্রতিষ্ঠান’ ও জনতা লীগে পরিণত করতে তিনি শহীদ সাহেবের নেতৃত্বের প্রতি অবিচল থেকেছেন। কারণ তার মনে হয়েছে, শহীদ সাহেবের রাজনীতিতে গণমুখিতা রয়েছে । ১৯৪৩ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখো দিলে তিনি শহীদ সাহেবের নির্দেশে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষকে বাচাঁনোর জন্য লঙ্গর খানা খুলেছিলেন। এ সময় তিনি দিনভর কাজ করতেন, কোনদিন হোস্টেলে ফিরতেন, কোনদিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের মর্মস্পর্শী বর্ণনা তার লেখায় পাওয়া যায় ঃ ‘......মা মরে পড়ে আছে,ছোট বাচ্চা সেই মরা মার দুধ চাটছে কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাবার জন্য কাড়কাড়ি করছে।’ (পৃষ্ঠা ১৮)
মুজিব তাত্ত্বিক কিংবা সমাজবিশ্লেষক ছিলেন না, তিনি তৎকালীন সমাজের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেন নি, তাঁর বইয়ে। তিনি যা দেখেছেন তাই সাদামাটা ভাবে অকপটে তুলে ধরেছেন। কংগ্রেস- মুসলিম লীগের রাজনীতি, দেশভাগ, হিন্দু- মুসলমান সম্পর্কের টানাপড়েন, দু সম্প্রদায়ের সখ্য বৈরিতা সবই তার গ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় ঠাঁই পেয়েছে। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও দুর্বলতার কথাও রয়েছে তাঁর বর্ণনয়। যখন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচল চলছে। তখনও মুজিব সুস্থ, উদার অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি অবিচল আস্থা রেখেছেন তার সহজাত চারিত্রিক দৃঢ়তা দিয়ে। এ কারণেই সুভাষচন্দ্র, সি আর দাসের রাজনীতির প্রতি ছিল তার অপরিসীম অনুরাগ যা সংশয় সংকটে টলে যায়নি। এই উদার, অসাম্প্রদায়িক, নিখাদ স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি তিনি পেয়েছিলেন সম্ভবতঃ তৎকালীন পূর্ববঙ্গের নদী, প্রকৃতি ও জনজীবন থেকে।
৩
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তে বঙ্গবন্ধু অসংখ্য চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। চন্দ্রঘোষ (পৃ ঃ ১৮৮) গোপালগঞ্জের গরিব বুদ্ধা (পৃ ঃ ২৫৬) ভাষা আন্দোলনে রাজবন্দি দশবছরের স্কুল ছাত্র (পৃ ঃ ৯৬) এর মতো চরিত্র এসেছে বর্ণনায় যাদের পাঠক মনে রাখবে। পিতা লুৎফর রহমান এবং সহধর্মিনী ফজিলাতুন্নেছার প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। যে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশর জাতীয় সঙ্গীত হবে, তার প্রসঙ্গও এসেছে, তবে তেমন বেশি নয়। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন কীনা তা জানা যায় না, তব্ েনজরুল সান্নিধ্য পেয়েছেন কয়েকবার। কিংবদন্তিতুলা সঙ্গীত শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের প্রসঙ্গও এসেছে গ্রন্থে। কমিউনিস্ট ও নমঃ শুদ্রদের কিছু উল্লেখ আছে। কিন্তু বইয়ের অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছেন, বিংশ শতাব্দীর বাঙালির ইতিহাসের প্রধান পুরুষ মওলানা ভাষানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, কিন্তু সবচেয়ে বেশি আছে তারা যাদের নিয়ে তিনি মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যাত্রা করেন।
বিশ শতকের বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম প্রধান পুরুষ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আর্দশ, নির্বাচিত নায়ক। ‘শহীদ সাহেব’ সর্ম্পকে সপ্রশংস উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেতিনি বলেছিলেন ‘শহীদ সাহেব ছিলেন উদার ’ নীচতা ছিল না, দলমত দেখতেন না, কোটারি করতে জানতেন না, গ্র“প করারও চেষ্টা করতেন না। উপযুক্ত হলেই তাকে পছন্দ করতেন এবং বিশ্বাস করতেন। কারণ তার আত্মবিশ্বাস ছিল অসীম। সাধুতা, নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাইতেন। (পৃ ঃ ৪৭) যুক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী ( ১৯৪৬) পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ প্রবক্তা শহীদ সাহেবের প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম শ্রদ্ধা। শহীদ সাহেবও শিষ্য শেখ মুজিবকে স্নেহ করতেন, তা তিনি উল্লেখ করেছেন আরেগভরে এভাবেÑ ‘তিনি যে সতিই আমাকে ভালবাসতেন ও স্নেহ করতেন তার প্রমাণ আমি পেয়েছি তাঁর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার দিন পর্যন্ত’। (পৃ ঃ২৯) শেরে বাংলার সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর সর্ম্পক ছিল, তবে সে সর্ম্পক ছিল দ্বন্দ্ব মধুর। রাজনৈতিক ভাবে তারা দুজন ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করতেন। তথাপি পিতৃ আজ্ঞায় তাকে কখনই অবজ্ঞা অশ্রদ্ধা করতে চাননি। শেরে বাংলা সর্ম্পকে পৌত্রতুল্য মুজিব লিখেছেন ‘তাঁর মনটা উদার ছিল, যে কারণে তাঁকে আমি ভক্তি করতে শুরু করলাম। ষড়যন্ত্রকারীরা যখন তাঁর কাছে না থাকতো তখন তিনি উদার ও অমায়িক।’ আবার শেরে বাংলার আকাশ ছোঁয়া জনপ্রয়িতা সর্ম্পকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সচেতন ছিলেন। মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছিল র্দীঘ কালের রাজনৈতিক সর্ম্পক, ১৯৫৭ সাল থেকে ভাসানী ভিন্ন রাজনৈতিক বলয়েয় অধিবাসী হলেও তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সর্স্পক ছিল অত্যন্ত সৌহাদ্যপূর্ণ। তথাপি তিনি মওলানা ভাসানীর দুর্বলতাগুলি শনাক্ত করেছেন দৃঢ়তার সাথে। মওলানা ভাসানীকে বাদ দিয়ে শামসুল হককে এক সভায় সভাপতি করা হলে মওলানা সাহেব রুষ্টহন। এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেখক লিখেছেন, ‘মওলানা সাহেবের খেলা বুঝা কষ্টকর। সভায় তিন চারদিন পূর্বে মওলানা সাহেব খবর দিলেন তিনি সভায় উপস্থিত হতে পরবেন না। কিন্তু কেন সে কারণ কিছুই জানান নি। আমি জানতাম কোন রকম বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তিনি সরে থাকতে চেষ্টা করতেন। ( পৃ ঃ ২৪৬) এ ভূ- খন্ডের মুক্তির লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন বঙ্গবন্ধু। সাড়ে পাঁচ দশকের জীবন পরিক্রমায় তিনি অসংখ্য মানুষের সাথে মিশেছেন, কিন্তু নীতিহীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, আর্দশহীনতার সঙ্গে আপস করেন নি কখনই। নীতিহীন রাজনীতি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘নীতিহীন নেতা নিয়ে অগ্রসর হলে সাময়িক কিছু ফল পাওয়া যায়। কিন্তু সংগ্রামের সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না।’ (পৃ ঃ ২৭৩) এ কারণে বোধ হয় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীকে একজন রাজনীতিবিদের বিজয়ের কহিনী বলা যায় না, বলা যায় সংগ্রামের উপাখ্যান। বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেন, নিজ সন্তানদের কাছে পান না, বারবার ফিরে আসেন করাগারের কঠোর জীবনে এসবই বর্ণিত হয়েছে বেদনা মথিত ভাষায় ও শব্দে এই উপাখ্যানে।
৪
আফ্রো এশীয় লাতিন আমেরিকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নায়ক, রাষ্ট্রনায়ক এবং বরেণ্যরা অনেকেই অটোবায়োগ্রফি বা আত্মজীবনী লিখেছেন। এসব আত্মজীবনীর লেখকরা ব্যক্তিগত জীবনের গল্প লিখতে গিয়ে লিখেছেন জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, স্বদেশের অভ্যুদয়, দেশগঠন তথা জাতিগঠনের উপাখ্যান। লেখকের জীবন এবং জাতির জীবন এক সূত্রে গাঁথা হয়ে যায় এসব আত্মজীবনীতে। বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীও সর্ব অর্থেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অসমাপ্ত কাহিনী। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ইংরেজি অনুবাদ ‘দি আনফিনিশড মেমোয়ার্স’ সম্প্রতি পেঙ্গুইন ভাইকিং থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
বাঙালির রাজনৈতিক জীবন তথা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসকে কোন ভাবেই বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে আলাদা করে দেখার অবকাশ নেই। তিনি রাজনীতির মানুষ ছিলেন এবং তার রক্তের সাথে রাজনীতি মিলেমিশে একাকার হয়েছিল। বাঙালির চিরায়ত মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সাথেও গভীর ভাবে পরিচিত ছিলেন কৈশোর থেকেই সে কারণে চরম বাম বা ডান পন্থা মতাদর্শ গ্রহণ করেননি তিনি। সব সময় তিনি মধ্যপন্থা অনুসরণ করে গেছেন।। তার দল আওয়ামী লীগেও সম্ভবতঃ এই দু ধারা বহমান রয়েছে এখনও। যদিও ডানপন্থীরা তাঁকে কমিউনিস্ট আর বামপন্থীরা তাঁকে আমেরিকান পন্থী হিসেবে শনাক্ত করেছেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ষাটের দশক থেকেই তিনি ছিলেন এদেশের রাজনীতির প্রধান পুরুষ, এই কালপর্বে তার সঙ্গে তুলনীয় কোন রাজনীতিবিদ ছিল না এই দেশে। সে সময় তাঁকে ঘিরেই আন্দোলিত হচ্ছিল বাংলাদেশের রাজনীতি এবং তাঁর পাশে তাঁর অগ্রজ ও সমকালীন রাজনীতিবিদরা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছিলেন। মসনদে আরোহন করার জন্য তিনি রাজনীতি করেননি, রাজনীতির ধারায় যুগান্তর ঘটানোর জন্য তিনি রাজনীতি করেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও ত্রিশের কবিরা বাংলা কবিতায় যুগান্তর ঘটিয়েছিলে আর বাঙালির সমাজ ও রাজনীতিতে যুগান্তর ঘটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। একথা অতিশয়িত হবে না যে, বঙ্গবন্ধু কেবল শারীরিক ভাবেই মহাকায় ছিলেন না ‘সাধারণ বাঙালির থেকে অনেক উচুঁতে ছিল তাঁর মাথাটি, সহজেই চোখে পড়তো তার উচ্চতা, এবং আমাদের বামন রাজনীতিবিদদের মধ্যেও তিনি ছিলেন মহাকয়।’ (হুমায়ুন আজাদ, প্রাগুক্ত, পৃ : ২৪) নানা কারণে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বাংলাদেশ ও বাঙালির উত্থান পতন প্রগতি ও অভ্যুদয়ের অসমাপ্ত মহাকাব্য। এক নিঃসঙ্গ নায়ক কারগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে বাংলাদেশের মাটি, প্রকৃতি,জনজীবনকে মিলিয়ে দিয়ে যে উপাখ্যান রচনা করেছেন, তা সর্বঅর্থেই বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অসামাপ্ত উপাখ্যান হয়ে উঠেছে।
আবদুল্লাহ আল আমিন: লেখক ও প্রাবন্ধিক।
সহকারী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ।