জানি পোষ্টটি অনেক বড়। তারপরও যাদের একটু সময় আছে তারা দেখতে পারেন। দেখতে পারেন মানুষ মানুষের জন্য কি উদার হতে পারে।
অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়’—এ রকম কিংবা তার চেয়েও বেশি করুণ আর দুঃখ-কষ্টে ভরা ছিল কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুরহাট থেকে উত্তরে এবং ঘোগাদহ থেকে পূর্বে দুধকুমার, গঙ্গাধর নদ ও ব্রহ্মপুত্রের কোল ঘেঁষে জেগে ওঠা নামহীন এক চরের মানুষের জীবন। যাদের খোঁজ নেননি কোনো জনপ্রতিনিধি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো এনজিও। এমনকি তিনটি ইউনিয়নের সীমান্তে হওয়ায় কোনো ইউনিয়নই এদের কাগজ-কলমে স্বীকৃতি যেমন দেয়নি, তেমনি দেয়নি ডাকার, বলার বা পরিচয় দেওয়ার মতো একটি নাম।
যাত্রাপুর ইউনিয়ন বলত, এটি পড়েছে ঘোগাদহ ইউনিয়নে; ঘোগাদহ ইউনিয়ন মনে করত, যাত্রাপুর ইউনিয়নের মধ্যে। অপরদিকে নুনখাওয়া ইউনিয়ন পরিষদ ধরে নিয়েছে, চরটি তাদের ভৌগোলিক সীমানায় নয়।
তারপর ঘটে যাওয়া বাস্তবতা গল্পকেও হার মানিয়েছে। নামহীন, কর্মহীন, মাথা গোঁজার ঠাঁইহীন ওই চরের মানুষের পাশে দাঁড়ায় প্রথম আলো। ২০০৩ সালে বন্যাপীড়িত চরের মানুষের মধ্যে ত্রাণসাহায্য দেয় প্রথম আলো। সঙ্গে থাকে বন্ধুসভা। সেই শুরু, তারপর ফসল ফলানোর সময় চারা-বীজ, শীতের সময় গরম কাপড়, মঙ্গার সময় খাদ্য, নদীভাঙা মানুষের জন্য টিনের ঘর, রোজা-ঈদে বিশেষ খাবার দেওয়ার মতো নানা কার্যক্রম চলতে থাকে। চরের মানুষের মনে এই বিশ্বাস জন্মায় যে, প্রথম আলো তাদের প্রকৃত বন্ধু। তাই ভালোবেসে, খুশি হয়ে চরবাসী নামহীন চরের নাম দেয় ‘প্রথম আলোর চর’। দিনটা ছিল ২০০৪ সালের ১৫ নভেম্বর। এই নামকরণ পরে সরকারি কাগজে ও দলিলপত্রে স্বীকৃতি পায়।
প্রথম আলোর চরে কোনো স্কুল না থাকায় কোমলমতি ছেলেমেয়েরা নদী পাড়ি দিয়ে দূরের স্কুলে যেত না। প্রথম আলো এখানে তৈরি করে স্কুলঘর। সে স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন ১০৩। দুজন শিক্ষক এবং একজন অফিস সহকারীর বেতনসহ শিক্ষার্থীদের সেখানে দেওয়া হচ্ছে খাবার নিয়মিত। তিন লাখ টাকা ব্যয়ে স্কুলের জন্য আরেকটি ৬০ ফুট আধাপাকা ঘর তুলে দিচ্ছে ‘প্রথম আলো ট্রাস্ট’। তার কাজ এখন শেষের দিকে। একসময় এই চরবাসীর পরিচয় দেওয়ার মতো একটি জায়গার নামও ছিল না। আজ তারা পেয়েছে অনেক কিছু। সেখানকার ছেলেমেয়েরা এখন নিজেদের স্কুলে পড়ে: অ-তে অনেক বড় হতে হবে।
নৌকায় আলোর পরশ
‘কাচীহারা গ্রামের মানুষের এত দুর্ভোগ, কেউ এ গ্রামে না এলে বুঝতেই পারবে না। প্রথম আলো এই গ্রামের সমস্যার খোঁজ করে (এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে) আমাদের সাহায্য করেছে। প্রথম আলোর এই সহায়তা ছোট হলেও আজকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে দিয়েছে।’ চলতি বছরের ৯ আগস্ট এই কথাগুলো বলেছিলেন জামালপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কবীর আল আছাদ।
এ বছরের ১২ জুলাই প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘আলোর পথে পাতিল সাঁতার’। প্রতিবেদনটি সবার মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। সে এলাকার ছেলেমেয়েরা পাতিল নিয়ে সাঁতার কেটে স্কুলে যাওয়া-আসা করত। এ সমস্যা সমাধানে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও সেখানে কোনো কাজ হয়নি। সমস্যা সমস্যাই রয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত প্রথম আলো গ্রামের শিক্ষার্থীদের দুর্দশার কথা বিবেচনা করে তাদের পাশে দাঁড়ায়। ‘প্রথম আলো ট্রাস্ট’ থেকে নৌকা বানানোর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪১ হাজার টাকা। এই টাকায় ১৮ হাত দীর্ঘ দুটি নৌকা বানানো হয়। নৌকা দুটি এখন ব্যবহূত হচ্ছে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কাচীহারা আলাই পূর্বপাড়া গ্রামের শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসা-যাওয়ার জন্য। বর্ষা মৌসুমে কোমলমতি ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার একমাত্র অবলম্বন এখন এই নৌকা।
নৌকা পাওয়ার পর সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী জবা আক্তারের অনুভূতি ছিল এ রকম, ‘নৌকা পাইয়া আমাদের মনে খুব আনন্দ লাগতাছে। স্কুলে আসতে আর পাতিল দিয়া সাঁতার পারন লাগব না। কাপড়-চোপড় ভিজব না। আমরা আর স্কুল কামাই দিমু না।’ কাচীহারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দবির উদ্দিন আহমেদ প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘১৩ বছর ধরে আমি এই স্কুলে আছি। এলাকাটা হাওর এলাকার মতো। বর্ষাকালে আমরাই ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে আসতে মানা করতাম। নৌকা পেয়ে তাদের আর এ সমস্যা থাকল না। প্রথম আলোয় প্রকাশিত “আলোর পথে পাতিল সাঁতার” প্রতিবেদনটি অবহেলিত এই গ্রামকে সবার নজরে এনেছে।’
শুধু লেখা নয়, আরও কিছু
প্রকাশের শুরু থেকেই একটা প্রশ্ন ছিল আমাদের মধ্যে। প্রথম আলোয় আমরা কি শুধু প্রতিবেদন লিখব, মতামত দেব, সমালোচনা করব, আর কিছু করব না? সময়টা তখন ২০০০ সাল। সারা দেশে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যায় নারীর ওপর এসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা। প্রথম থেকেই প্রথম আলো স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করতে থাকে এসিড-সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো। এ রকম অসংখ্য ঘটনার একটি হলো, ‘ঘুমিয়ে থাকা ২ বোনের মুখে এসিড নিক্ষেপ’। প্রথম আলোয় বেরোয় ২০০০ সালের ৮ জানুয়ারি। ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ড উপজেলার সিংগাইর গ্রামের রুবিনা (১৫) ও রোজিনা (১০) ছিল ওই দুই বোন। পৈশাচিক সেই ঘটনায় ওদের জীবনে নেমে আসে কালো অন্ধকার। শুধু ঝিনাইদহেই ১০ মাসে ১০ কিশোরীকে এসিডে ঝলসে দেওয়া হয়েছিল। এ থেকে দেশের পুরো চিত্রটা সহজেই অনুমেয়। এসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা এ সময় হঠাৎ বেড়ে যায়। এসিডদগ্ধ হওয়ার মর্মস্পর্শী এসব ঘটনা আমাদের ভীষণভাবে আলোড়িত করে। এর পরই এসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রথম আলোকে সক্রিয় করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।
ওই বছরের ১৯ এপ্রিল গঠন করা হয় ‘এসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল’। শুরুতেই প্রথম আলোর সব কর্মীর এক দিনের বেতন ৩২ হাজার টাকা দিয়ে এই তহবিল গঠন করা হয়। এ তহবিল গড়ে তুলতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয় পাঠকদের। এগিয়ে আসেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও। একই সঙ্গে এসিড ও বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ যত্রতত্র বিক্রির বিরুদ্ধে কঠোর আইন করার জন্য প্রথম আলো সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।
বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা থেকে পাঠকেরা প্রথম আলোর এই তহবিলে যে অর্থ দান করেছেন, তা দিয়ে এসিড-সন্ত্রাসের শিকার ১৩৫ জন নারীকে এ পর্যন্ত পুনর্বাসন করা হয়েছে। তাঁদের জমি, ঘর, দোকান, গবাদিপশু, ট্রলার দেওয়ার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা চলেছে। ৭০ জন এসিডদগ্ধ নারীকে চিকিৎসা-সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আরও ৩০ জনকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, মাসিক ভাতা ও শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়েছে।
এসিডদগ্ধ মানুষের সহায়তার পাশাপাশি ভয়ংকর এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত গঠন ও সচেতনতা তৈরিতে ২০০২ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে পুরুষের বিশাল শোভাযাত্রার মতো ব্যতিক্রমী আয়োজন করা হয়। এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক এ উদ্যোগে যোগ দিয়েছিল। এর পর থেকে প্রতিবছরই এই বিশেষ দিনটিতে কোনো না কোনো কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে।
‘যেখানে এসিড-সন্ত্রাস, সেখানেই মানববন্ধন’ কার্যক্রমের মাধ্যমে এসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। প্রথম আলোর পাঠক সংগঠন বন্ধুসভার সদস্যরা এসব মানববন্ধনের আয়োজন করে থাকে। এ উদ্যোগে আমরা স্থানীয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি লক্ষ করেছি।
এ ছাড়া প্রশাসনসহ সব শ্রেণীর মানুষ নিয়ে এসিডদগ্ধদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে সাতক্ষীরা, খুলনা, নরসিংদী, ভোলা, সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লা এবং সম্প্রতি দিনাজপুরে নেতৃস্থানীয় শিল্পী, লেখক, আইনজীবী ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে সাতটি বড় সভা হয়েছে।
মাদককে ‘না’ বলো
শুধু এসিড নয়, মাদকের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ায় প্রথম আলো। মাদককে ‘না’ বলো স্লোগান নিয়ে ২০০২ সালে শুরু হয় ‘প্রথম আলো মাদকবিরোধী আন্দোলন’। পরামর্শ-সহায়তা অনুষ্ঠান এর নিয়মিত কার্যক্রম। এখানে মাদকাসক্ত তরুণ, মাদকাসক্তের পরিবার, আত্মীয়স্বজন, মাদকমুক্ত তরুণ-তরুণীরা উপস্থিত থাকেন। মাদকাসক্ত পরিবারের সদস্যরা তাঁদের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। সমস্যার সমাধান ও প্রশ্নের উত্তর দেন চিকিৎসক ও পরামর্শকেরা। শুধু পরামর্শ-সহায়তা অনুষ্ঠান নয়, মাদকবিরোধী আন্দোলনের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আরও রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসে সারা দেশে সভা-সমাবেশ, মাদকবিরোধী কর্মশালা, মাদকবিরোধী মুক্ত সংলাপ, মাদকবিরোধী বন্ধুমেলা ইত্যাদি। দেশজুড়ে হয়েছে এ ধরনের ১৫০টি কার্যক্রম। খ্যাতিমান মনোরোগ চিকিৎসকসহ বিশিষ্ট লেখক, শিল্পী ও গায়কেরা অংশ নেন এসব অনুষ্ঠানে।
বন্যা-সিডর ও আইলা-দুর্গতদের পাশে
প্রথম আলোর প্রথম দশক ধরে যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছি আমরা। বন্যা, সিডর বা আইলা-দুর্গত মানুষের জন্য প্রথম আলোর পাঠক-শুভানুধ্যায়ীরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বপ্রণোদিত হয়ে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। অনুদান চেয়ে কোনো আহ্বান না জানালেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে লক্ষ-কোটি টাকা জমা পড়েছে ‘প্রথম আলো ত্রাণ তহবিলে’। আমরাও ছুটে গেছি দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। ছুটে গেছেন প্রথম আলোর কর্মী আর বন্ধুসভার বন্ধুরা, একই সঙ্গে পাঠকেরাও।
বন্যা, সিডর ও আইলায় আমাদের যে অভিজ্ঞতা, তাতে আবারও প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ চাইলে পারে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি জয় করতে। বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে সর্বাত্মকভাবে দাঁড়িয়েছে প্রথম আলো। ১৫ জানুয়ারি, ২০০৭-এ শুরু হওয়া এই কার্যক্রম শেষ হয় ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ সালে।
ভয়াবহতম ‘সিডর’ ১৫ নভেম্বর, ২০০৭ সালে আঘাত হানে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলে। পরদিন থেকেই সিডর-দুর্গত মানুষের পাশেও দাঁড়ায় প্রথম আলো। আমাদের ত্রাণ-তৎপরতা চলে এক বছরের বেশি সময় ধরে।
সিডরের ক্ষত শুকাতে না শুকাতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। আইলার দুর্যোগপীড়িত মানুষের জন্য সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় প্রথম আলো।
বন্যা, সিডর আর আইলা-দুর্গত মানুষের জন্য প্রথম আলোর ত্রাণ কার্যক্রম থেকে চাল, ডাল, লবণ, বিশুদ্ধ পানি, খাওয়ার স্যালাইন ও বস্ত্র বিতরণ করা হয়। বিতরণ করা হয় ঘর তোলার সরঞ্জাম ও পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি; নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করা হয় রাস্তা, স্কুল, স্কুল লাইব্রেরি নির্মাণ; বীজতলা তৈরি, দূষিত হয়ে যাওয়া পুকুর পরিষ্কার করাসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। আইলা-দুর্গত অঞ্চলে এক হাজার দুর্গত মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার মতো একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রও তৈরি করা হয়।
অদম্য মেধাবীরা এগিয়ে
প্রথম আলোর পৃষ্ঠায় কৃতী শিক্ষার্থীদের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা করতে গিয়ে সন্ধান পাওয়া গেল প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশ কিছু মেধাবী শিক্ষার্থীর; যারা শত প্রতিকূলতা জয় করে বিস্ময়কর কৃতিত্ব প্রদর্শন করে। প্রথম আলো এসব শিক্ষার্থীর নাম দিয়েছে অদম্য মেধাবী। ২০০৭ সালে প্রথম অদম্য মেধাবীদের জন্য ‘প্রথম আলো ট্রাস্ট’-এর কার্যক্রম শুরু হয়। এ বছর ২১ জন দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে দুই বছরের জন্য অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা হয়।
২০০৮ সালে অদম্য মেধাবীর কার্যক্রমে ২৯ জন দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে দুই বছরের জন্য অদম্য মেধাবী নির্বাচন করা হয়। এদের মধ্যে ১৬ জন এবার জিপিএ-৫ পেয়ে তাদের অদম্য মেধাবীর স্বীকৃতিকে নন্দিত করেছে। তাদের মধ্য কেউ উচ্চতর পর্যায়ে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে।
২০০৯ সালে অদম্য মেধাবী কার্যক্রমের আওতায় আসে ৪৩ জন শিক্ষার্থী। ২০১০ সালে ৫০ জন অদম্য মেধাবী নির্বাচিত হয়। অদম্য মেধাবী কার্যক্রম নিয়ে প্রথম আলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো দরিদ্র অথচ মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক এবং উচ্চতর শিক্ষায় অর্থনৈতিক সহযোগিতা করা। এই অদম্য মেধাবীদের বছরে এক দিন একত্র করা হয়। সেদিন তাদের দেখে আর তাদের কথা শুনে আমরাও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্দীপ্ত হই।
সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে
কারও পক্ষে কি ভুলে যাওয়ার উপায় আছে, ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে ফেনীতে জয়নাল হাজারীর ক্যাডার বাহিনী কীভাবে টিপু সুলতানের হাড়গোড় ভেঙে দিয়েছিল? ডেইলি স্টারকে সঙ্গে নিয়ে সেই টিপু সুলতানের পাশে দাঁড়িয়েছিল প্রথম আলো। প্রথম আলো সাংবাদিক নির্যাতনের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। টিপু সুলতানের চিকিৎসা বাবদ প্রায় ২৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। নয়বার ব্যাংককে গিয়ে ছয়বার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা সম্ভব হয়েছে দেশের সর্বস্তরের মানুষের সহায়তায়। শুধু টিপু সুলতান নন, আরও দুজন নিহত সাংবাদিকের পরিবারের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়েছে প্রথম আলো। খুলনার নহর আলী ও হারুনুর রশীদ খানের পরিবারকে দোকান করতে সহায়তা এবং বাড়ির জায়গা কিনে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও এ কার্যক্রমকে আমরা জোরদার করতে চাই।
প্রথম আলো বিশ্বাস করে, মানুষ মানুষের জন্য। এসব আশাজাগানিয়া কার্যক্রম ও সমাজের ঘুম ভাঙানোর প্রয়াসের মধ্য দিয়ে প্রথম আলোর কাছে এ সত্য স্পষ্ট হয়েছে যে, সমাজের মানুষ একে অপরকে সহায়তা করতে চায়। এদের শুধু সংগঠিত করতে হয়, আশা জাগিয়ে তুলতে হয়। সে কারণেই আমরা বলি, আসুন, বদলে যাই, বদলে দিই। আমরা আরও বলি, নিজে শুরু করলে অন্যরাও এগিয়ে আসবে এই বদলের মিছিলে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, স্বাধীনতা অর্জন তো এই সত্যের দীপ্ত উচ্চারণেরই প্রতিনিধিত্ব করে।
যখন কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদে জেগে ওঠা চরের বাসিন্দারা তাদের চরের নাম রেখে দেয় প্রথম আলোর চর, তখন আমরা উপলব্ধি করি আমাদের ওপর আস্থা ও দায়িত্বের ভার কত বেশি। ২০০৮ সালে প্রথম আলোয় সংবাদ প্রকাশের পর ঝিনাইদহ-যশোর সড়কের সঙ্গে যুক্ত হওয়া একটি রাস্তা পাকা হয়। এলাকাবাসী এর নাম দেয় প্রথম আলো সড়ক। পরবর্তী সময় ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ থেকে এ নামটি অনুমোদিত হয়।
সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও সৃজনশীল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য প্রথম আলোর সম্পাদককে ২০০৫ সালে এশিয়ার নাগরিকদের বিশেষ সম্মান র্যা মন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার দেওয়া হয়। সেদিনের দেওয়া মানপত্রের বক্তব্যের জবাবে আমি বলেছিলাম, দুর্নীতি, রাজনীতি ও অপরাধজগতের মধ্যে সম্পর্ক; আইনের প্রতি ধনী ও ক্ষমতাশালীদের অশ্রদ্ধা-অবজ্ঞা এবং বৈষম্যের কারণে সামাজিক বিস্ফোরণের বিপদের ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন ও সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ সংবাদমাধ্যম গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা সে লক্ষ্যে দৃঢ়সংকল্প নিয়ে এগিয়ে চলেছি। র্যা মন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারের অর্থ হিসেবে পাওয়া প্রায় ৩৩ লাখ টাকা তিন ভাগ করে এক ভাগ এসিডদগ্ধ নারীদের সাহায্য তহবিলে, এক ভাগ মাদকবিরোধী আন্দোলনের জন্য এবং এক ভাগ নির্যাতিত সাংবাদিক বা তাঁদের পরিবারের সহযোগিতার জন্য নির্দিষ্ট তহবিলে দিয়েছি। ম্যাগসাইসাই পুরস্কার প্রথম আলোর জন্য ছিল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্মান, যা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধকে আরও বেশি শাণিত করেছে।
এক যুগ পূর্তির এই শুভক্ষণে, পাঠক, আপনাদের ভালোবাসা, আপনাদের নিঃস্বার্থ সংহতি আমাদের আরও বেশি মাত্রায় প্রাণিত করছে প্রথম আলোকে সত্য ও সুন্দরের পথে নিষ্ঠাবান হতে। গঠনমূলক সামাজিক পরিবর্তনে গণমাধ্যমকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আমরা আরও বেশি সক্রিয় ও সচেষ্ট থাকতে চাই। আশা করি, অতীতের মতো ভবিষ্যতেও প্রথম আলোর সঙ্গে থাকবেন আপনারা, থাকবে তার পাঠকেরা।
ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানে ১৫ মে, ২০০৯। এই ঝড়ে মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি বিপুল সম্পদের ক্ষতি সাধিত হয়। প্রথম আলো ট্রাস্ট জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাপক ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম হাতে নেয়।
ত্রাণকাজের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ হলো আইলা-দুর্গত অঞ্চল সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের সিংহরতলী পরিবেশ স্কুল প্রাঙ্গণে ‘প্রথম আলো দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র’ নির্মাণ। মোট ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে এই আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়।
বছরের স্বাভাবিক সময়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ‘পরিবেশ স্কুল’ নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালিত হবে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করাও হবে আশ্রয়কেন্দ্রের অন্যতম কাজ।
আশ্রয়কেন্দ্রের জমিদাতা আবুল কাশেমের বাড়ির পাশে পুকুরটি আইলার পানিতে নষ্ট হয়ে যায়। আশ্রয়কেন্দ্র-সংলগ্ন পুকুর সংস্কার করে এলাকার মানুষের পানির সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। এই প্রকল্প গ্রহণের উদ্দেশ্য এলাকাবাসীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করা, পরিবেশ স্কুলের সংস্কার করা এবং পানীয় ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য সুপেয় পানির সংস্থান করা। ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে পুকুর ও পুকুরঘাট সংস্কার করে প্রথম আলো। প্রথম আলোর এই দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র ও সংলগ্ন পুকুর ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জন্য একটা অবলম্বন হয়ে উঠেছে। এই আশ্রয়কেন্দ্রটি নির্মিত হয়েছে কারিতাসের সহযোগিতায়।
সুত্র : প্রথম আলো

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



