ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট এ পি জে আব্দুল কালাম মারা যাওয়ার প্রায় একমাস হয়ে গেলো তখন তাকে নিয়ে এতো বেশি হইচই হয়েছিলো যে তাই তখন এ নিয়ে আমার লেখার আগ্রহ লোপ পেয়েছিলো। তবে তাকে নিয়ে একটু দেরিতে হলেও এই বিশ্লেষণধর্মী লেখাটা পোস্ট করলাম।
এপিজে মারা যাওয়ার পর ভারতের মতো বাংলাদেশেও ব্যাপক সাড়া পড়েছিলো। ব্লগ, সোস্যাল সাইট থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সব প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ রাষ্ট্রের বড়কর্তা থেকে ছোট কর্মী সবাই ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলো শোক প্রকাশ করতে । নিউজফিডে আর সোস্যাল সাইটের ঝড়তো বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় 'কোমেন' কেও হার মানিয়েছিলো। আবার অনেকেইতো এপিজে সাহেবের নোবেল পুরস্কার না পাওয়া নিয়ে বিস্ময় ও হতাশাও প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ এ জন্য নোবেল কমিটিকে তোপ দেগে দিয়েছিলো। কিন্তু বরাবরই আমি নির্লীপ্ত ছিলাম। দেখাইনি কোন অনুভূতি। ভাবছিলাম সবকিছু উবে যাক তারপর কিছু একটা বলবো।
আদতে আমরা যে এ পি জে কে নিয়ে এতো শোক আর হতাশা প্রকাশ করছি একবারো কি ভেবেছি এই এ পি জে কালাম আমাদের কতখানি বন্ধু ছিলেন। কিংবা তিনি একজন মুসলমান হিসেবে কতখানি মুসলমানি ছিলো ওনার মাঝে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। হায়রে বাঙালি আমরা চিরকালই মানুষ চিনতে ভুল করি! মূলত ২০০২ সালে তিনি যখন ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হন তারপরই তিনি তার পরমাণু ক্ষমতার বাইরে গিয়ে আন্ত:নদী সংযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পানিশূন্য করতে বিভিন্ন কার্যক্রমের সূচনা করেন। তারই ফলশ্রুতিতে ২০০৩ সালে আজকের টিপাইমুখ বাঁধ দেয়ার যে তোড়জোড় চলছে সেটা তখনি রাজ্যসভায় পাশ হয়েছিলো।
তিনি সারাজীবন ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং আমৃত্যু তিনি সেটা ধারন করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তিনি একজন মুসলমান হয়েও কোন মুসলমানী রীতি বা সংস্কৃতি কখনোই ওনার মাঝে পরিলক্ষিত হয়নি। তিনি কখনো 'আল্লাহ' শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন কিনা সেটা আল্লাহই ভালো জানেন। উল্টো তার মধ্যে হিন্দুদের সংস্কৃতি পালন করতে দেখা যায়। তিনি সকালে ঘুম হতে উঠে গীতা পাঠ করে দিন শুরু করতেন। তিনি হিন্দুদের পূজায় গিয়ে নর্তকীদের পায়ে নৈবেদ্য ছিটিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। এতে করেই বুঝা যায় তিনি ঠিক কোন কিসিমের মুসলমান ছিলেন। তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ইন্ডিয়ান টাইমস পত্রিকায় খবর বের হলো এপিজে কালাম রাষ্ট্রপতি হওয়ায় ভারতের মুসলমানরা উচ্ছ্বসিত নয়।
মৃত্যুর পর যখন তার জন্মভূমি তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমে তাকে সমাহিত করার আগ পর্যন্তও আমি সন্দিগ্ধ ছিলাম তাকে ঠিক মুসলমান হিসেবে জানাজা পড়িয়ে সমাহিত করা হবে কিনা যাহোক শেষতক ইসলামী নিয়মেই তাকে কবরস্থ করা হয়েছে। তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে প্রায় ২ লাখ লোক সমবেত হয়েছিলো।
কিন্তু ভারতের মানুষ তাকে যে পরিমাণ ভালোবাসা দেখিয়েছে কিংবা তিনি আজীবন যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ধারন করে গেছেন সেখানে তিনি এবং তার চিন্তা-চেতনা ও তার দর্শন সবসময়ই রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত থেকে গেছে। তিনি সর্বদা মৃত্যুদন্ডের বিরোধী ছিলেন অথচ তার সমাধিস্থ করার দিনই ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
তাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি বনানোও ছিলো বিজেপির একটা রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় দুই হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিলো। সে দাঙ্গা বাঁধানোয় তৎকালীন গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী ও আজকের দিনের ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইন্ধন ছিলো। এ সব মিলিয়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ও তার দল বিজেপি ঘরে- বাইরে দারুনভাবে সমালোচিত ছিলো। তাই সে সমালোচনা থেকে মুখ ঢাকতেই সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের এই পরমাণু বিজ্ঞানীকে রাষ্ট্রপতি করা হয়।
বিজেপির মতোএকটি কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদি দল কেন একজন মুসলমানকে রাষ্ট্রপতি করেছিলো সেটা বোঝার জন্য মোটেই বুদ্ধিজীবী হওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ সেটা তখনি আঁচ করা গিয়েছিলো। আর সেসময় গুজরাট দাঙ্গায় যেসব মুসলমান মৃত্যুবরণ করেছিলেন এপিজে তাদের রক্তের উপর দিয়েই রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তিনি পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার করে যে মানবজাতির বিশাল অংশকে হুমকির মুখে রেখে গেছেন সেটা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন আরো পরে। সুতরাং যে সোস্যাল সাইট ব্যাবহারকারী এপিজে সাহেবের নোবেল না পাওয়া নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন তার জানা উচিৎ নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় শুধুমাত্র মানবকল্যাণমূলক আবিষ্কারের জন্য। মানবজাতির বিধ্বংসী কোন আবিষ্কারের জন্য নয়।
এ উপমহাদেশেরই আরেকজন পরমাণুবিজ্ঞানী পাকিস্তানের আব্দুল কাদের খান এপিজের মৃত্যুর দুদিন পর এপিজে কালাম সম্পর্কে বলেছেন তিনি একজন সাধারণ বিজ্ঞানী ছিলেন। পরমাণু বোমা তৈরিতে তার কোন গুরুত্বই নেই। ভারত যে পরমাণু বোমা তৈরি করেছে সেটা মূলত রাশিয়ার থেকে ধার করা। যাহোক তাদের এসব বিতর্কে আমি যেতে চাইনা। তবে এ পি জে আব্দুল কালাম সারা বিশ্বময় তরুণদের নিকট একজন 'ইনিসপিরিশনাল হিরো' এবং 'মটিভেশনাল লিডার' হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি নিজেই ছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়। আর জ্ঞান বিতরণকেই তিনি প্রিয় কাজ হিসেবে নিয়েছিলেন। তার বলা বিখ্যাত উক্তি 'স্বপ্ন সেটা নয় যা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে বরং স্বপ্ন তাই যা মানুষকে ঘুমাতে দেয়না'। তার এ উক্তিটি আমাকে এখনো দারুনভাবে উদ্দীপ্ত করে। তিনি একজন জেলে পরিবার থেকে এসে ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তরুন বয়সে তিনি পত্রিকার হকারি করতেন। তার জীবনের এ অংশগুলো থেকে শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক। তাকে নিয়ে হয়তো হাজারো নেতিবাচক উপলব্ধির আছে কিন্তু তার মধ্যেও একটা বড় শিক্ষা তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন আর তা হলো জ্ঞান অন্বেষণ এবং তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। আর সে কাজটি করতে করতেই তিনি পরলোকে চলে গেলেন।
সবকিছুর পরও কথা থেকে যায় একজন মানুষ যখন মৃত্যু বরণ করে তখন তার সবকিছুরই দায়িত্ব চলে যায় আল্লাহর হাতে। সুতরাং আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
কিশোর বয়সে এপিজে কালাম
বাংলাদেশ-ভারতের অভিন্ন নদীগুলোর পানি সরিয়ে নেয়ার মাস্টারপ্ল্যান
তার ইন্সপায়ারিং ওয়ার্ড
যে কথা অনুপ্রেরণা যোগায়
আবুল পাকির মুহাম্মদ জয়েনউদ্দীন আব্দুল কালাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ ভোর ৬:০৪