somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জলের নিচে জল, গভীর অতল

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১. ফৌজিয়ার বয়স তিন পেরিয়ে চার পৌছায়নি। কিং আব্দুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল এউয়ারপোর্টের খুব কাছে জেদ্দার শহরতলীতে হিরা স্ট্রীটে ওর চেয়ে বছর তিনেকের বড় ভাই ওয়ালিদ আর দেড় বছরের ছোট বোন ফাতিমাকে নিয়ে ও বাবা মা’র সাথে থাকে। ওদের তিন ভাই বোনের জন্ম এখানেই। ওর বাবা জাহেদ মাহমুদ স্থানীয় একটি চেইন রেস্টুরেন্ট এর অপারেশনে কাজ করে। রেস্টুরেন্ট এর কাজ শেষ করে কখনই রাত একটার আগে সে বাসায় ফিরতে পারেনা। ফৌজিয়াও মায়ের সাথে জেগে থাকে। বাবা আসলে সারাদিনের জমানো কথা বাবাকে বলবে, বাবার সাথে খাবে, তারপর বাবার সথেই ঘুমাবে। বাবার সান্নিধ্যের জন্য ও অস্থির হয়ে থাকে। আজ রাত দুটো বেজে গেছে, কিন্তু বাবা এখনো ফিরছে না। ফৌজিয়ার রাগ হচ্ছে। সে আজকে তার নামের প্রথম অক্ষর F লিখতে শিখেছে, বাবা আসলে দেখাবে বলে অপেক্ষা করছে। এদিকে ওয়ালিদ ভাইয়া আজ বাসায় আরবী পড়াতে আসা হুজুরের কাছে পড়েনি, ফাতিমা দুবার নিজে নিজে সোফায় উঠতে গয়ে পড়ে গেছে, এসব নালিশ এর ঝাঁপি নিয়ে তার আর তর সইছে না।
ফৌজিয়া একটু পরপর মাকে জিজ্ঞেস করছে বাবা এখনো আসছে না কেন। ফৌজিয়ার মা চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির সাধারন পরিবাবের মেয়ে। বিয়ের দশ বছর পরেও স্বামীকে এখনো ‘তুমি’ সম্বোধন করতে তার লজ্জা, ‘আপনি’তেই সে স্বচ্ছন্দ। জাহেদ আগে এটা নিয়ে রাগ করত, তবে এখন আর কিছু বলে না। স্বামীকে সে কাজের সময় খুব একটা ফোন করেনা। আজ অবশ্য বলে গেছে ওদের রেস্টুরেন্ট এর এক স্টাফ ছুটি শেষে আজ ইন্ডিয়া থেকে আসবে, অফিসের গাড়ি ড্রাইভ করে জাহেদই তাকে আনতে যাবে। কিন্তু এয়ারপোর্ট, রেস্টুরেন্টের স্টাফ কোয়ার্টার সবই বাসার কাছে, এত সময় তো লাগার কথা না।
রাত তিনটার দিকে কলিং বেল বাজল। ফৌজিয়া দৌড়ে গেল মা’র আগে। বাবা এসেছে, হাত ভর্তি কাছেই দানিয়ুব সুপার মার্কেট থেকে কেনা একগাদা বাজার, যার মধ্যে ফৌজিয়ার পছন্দের সানটপ জুস আর চিটোস চিপস ও আছে। বাবার সাথে আরেকজন স্যুটপরা বাবারই বয়সী ভদ্রলোক, হাসি মাখা মুখে হাল্কা চাপ দাড়ি, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, হাতে কিট ক্যাট এর বড় প্যাকেট। বাবা মাকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ইনি হলেন ব্যারিস্টার আসিফ সাহেব। দেশি ভাই। কুয়ালা লামপুর থেকে এসেছেন, নিউ ইওইয়র্ক যাবেন। পথে জেদ্দায় ১১ ঘন্টার ট্রানজিট। তাই সৌদি আরবের ভিসাও নিয়ে নিয়েছেন, ট্রানজিটের সময়টায় হারাম শরীফ এ ইবাদত করবেন বলে। এয়ারপোর্ট এ অফিসের স্টাফ আনতে গিয়ে উনার সাথে পরিচয়। উনাকে নিয়ে হারামে গিয়েছিলাম, এমনিতেতো সময় পাইনা, তাই আজকে সুযোগ পেয়ে আমিও উনার সাথে তাওয়াফ করে এলাম, তাই দেরী হল’। বাবা এক নিমিষে কথা গুলো বলতে বলতে হাতের ব্যাগগুলো মাকে দিল। মা সেগুলো রাখতে ভিতরে চলে যেতেই আসিফ সাহেব ফৌজিয়াকে হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে একটা ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘দেখতো ফৌজিয়া এটা কে? চিনতে পার কিনা’? ফৌজিয়া দেখল ওর ছবি! কিন্তু পরনের ড্রেসটা ওর না, পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডটাও অপরিচিত। ছবিটা কোথায় তোলা ও জানেনা, ওখানে ও কখনো গিয়েছে বলে মনে করতে পারল না। ভীষণ অবাক হয়ে ও বাবার দিকে তাকাল, বাবা হাসছেন। ফৌজিয়া ফোনটা আসিফ সাহেবের হাত থেকে নিয়ে দৌড়ে ভেতরে মার কাছে গেল। মাকে দেখাল। মাও ভীষন অবাক। ফৌজিয়ার ছবি, কিন্তু পেছনে টুইন টাওয়ার! ফৌজিয়া কেন, সে নিজেও কখনো মালয়েশিয়া যায়নি। বিষয়টা বুঝতে তিনি ফৌজিয়াকে নিয়ে বসার ঘরে এলেন। তখন জাহেদ বলল, ‘এটা আসিফ ভাই এর একমাত্র মেয়ে, ফাতিহা’র ছবি। গাড়িতে বসে ওনাকে যখন আমার ফোনে তোমাদের সবার ছবি দেখাচ্ছিলাম তখনি উনি বললেন যে উনার মেয়ে নাকি হুবহু ফৌজিয়ার মত দেখতে। আমি উনার ফোনে ফাতিহার ছবি দেখে বললাম, কুয়ালা লামপুরে রেখে আসা মেয়েকে যখন জেদ্দায় পেয়ে গেলেন, আজকে ওকে ছবিতে নয় বাস্তবেই দেখে যাবেন, তাই ওনাকে নিয়ে এলাম’। জাহেদ এর স্ত্রী হতভম্ভ। আল্লাহ তায়ালা দুজন মানুষকে একি রকম করে তৈরী করেছেন, আবার তাদের যোগাযোগ ও করিয়ে দিয়ছেন! তার বিষ্ময় আরও বাড়িয়ে আসিফ সাহেব বললেন, ওদের জন্মও একি দিনে, ১৩ অক্টোবর, ২০১১। ফৌজিয়াকে তিনি আবার কোলে তুলে নিলেন। ফৌজিয়া দেখল, আসিফ সাহেবের চোখে ওর প্রতিচ্ছবিটা ঝাপসা হয়ে আসছে। সেখানে জমেছে জল, গভীর অতল।

২. জেদ্দা থেকে নিউ ইয়র্ক ১৫ ঘন্টার একঘেয়ে, ক্লান্তিকর, বিরিতিহীন ফ্লাইট। আলীবাবা আর চল্লিশ চোরের লোহিত সাগর পার হয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর লিখার সাথে পরচিয় থাকার কারনে সেই শৈশব থেকেই প্রিয় হয়ে ওঠা সুয়েজ উপ্সাগর আর আরব্য রজনীর আরেকজান্দ্রিয়া সামনে পড়তেই ভীষণ আপ্লুত হলেন আসিফ সাহেব। এর পর ভূমধ্যসাগরে সিন্দাবাদের রহস্যের হাতছানি আর মাইকেল মধুসূদনের কল্যানে পরিচিত ফ্রান্সের মার্সেই পার হয়েই ‘অতলান্তিক’। আসিফ সাহেব একটু পরপর জানালার লিড তুলে বাইরে তাকান। সেখানে মেঘে রদ্দুরে মাখামাখি। মেঘের নিচে আটলান্টিক। ফৌজিয়ার আর ফাতিহার কথা মনে পড়তেই তার চোখের কোণে জল জমে। নীচে মেঘ নামের জল। তারও নীলে সাগরজল। জলের নীচে জল, গভীর অতল।

http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/691126/জলের-নিচে-জল-গভীর-অতল

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৩৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×