somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ফকির ইলিয়াস
আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

বাংলাদেশের জনশক্তি ও আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার আইন

২৭ শে আগস্ট, ২০০৮ ভোর ৫:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশের জনশক্তি ও আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার আইন
ফকির ইলিয়াস
-------------------------------------------------------------
কুয়েতে অত্যন্ত নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়েছে বাংলাদেশের শ্রমিকরা। তাদের ওপর অমানবিক হামলে পড়েছে সেদেশের পুলিশ, আধা-সামরিক বাহিনী। বেদমভাবে লাঠিপেটা করা হয়েছে। বাংলাদেশী শ্রমিকদের অপরাধ, তারা তাদের বেতন-ভাতা ও সুবিধার জন্য আন্দোলনে নেমেছিলেন। রাজতন্ত্রের দেশ কুয়েতে আন্দোলন, মিছিল, মিটিং যে করা যায় না- তা বাংলাদেশী প্রবাসী সমাজের অজানা নয়। তারপরও তারা কেন এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হলেন তার কারণ খোঁজা খুবই জরুরি।
এটা বিশ্বের সব সভ্য সমাজই জানেন, মধ্যপ্রাচ্যে এখনও বহাল রয়েছে এক ধরনের দাসপ্রথা। যারা ভিসা প্রদান করে কিংবা যারা বিভিন্ন ছোট-বড় কোম্পানির মালিক তাদের আরবিতে বলা হয় ‘কফিল’ বা ‘আরবাব’। আর যিনি চাকরি নিয়ে যান তাকে আরবিতে বলা হয়ে থাকে ‘আমাল’ বা ‘নফর’। আরবাব শব্দের আভিধানিক প্রতিশব্দ হচ্ছে প্রভু। আর ‘নফর’-এর প্রতিশব্দ হচ্ছে চাকর। আর এভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে উঠেছে এক ধরনের প্রভু-দাস প্রথা। দুঃখের কথা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দরিদ্র শ্রমশক্তিকে তা জেনেশুনেই চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যেতে হচ্ছে। জীবনের অন্বেষণে আপস করতে হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আমি স্পষ্ট বলতে পারি, এসব দেশে দরিদ্র জনশক্তির প্রতি সবল কফিলদের আচরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অমানবিক। এসব দেশের অধিকাংশগুলোতেই কোন বিদেশী স্বনামে কোন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান খুলতে পারেন না। ব্যবসা করতে হয় ওই আরব কফিলের নামে। আর ব্যবসা জমে উঠলে পাষণ্ড কফিল ওই বিদেশী ব্যবসায়ীকে বিনা কারণেই তার দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারে ভিসা বাতিল করে। অতীতে এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে। এখনও ঘটছে। কখনও কাউকে বিনা কারণে জেল খেটেও দেশে আসতে হয়েছে।
সেসব দেশের কফিলগুলো এতই পরাক্রমশালী, সেদেশের লেবার ডিপার্টমেন্ট সব সময় কফিলদের পক্ষেই থাকে। মোট কথা, প্রতিটি বিদেশী শ্রমিকের ভাগ্য নির্ভর করে আরবি কফিলের হাতের ওপর। সেদেশে যাওয়ার পরপরই প্রতিটি শ্রমিকের পাসপোর্ট জমা নিয়ে নেয় কফিল। দেশে আসার আগ পর্যন্ত পাসপোর্টের মালিককে আর তা দেখার সুযোগটুকু পর্যন্ত হয় না। আর এভাবেই মানসিক চাপের মুখে রাখা হয় শ্রমিককে প্রবাস জীবনের প্রথম দিনটি থেকে।
এক সময় ছিল যখন কুয়েতে একশ’ দিনার, ওমানে আশি রিয়াল, দুবাইয়ে দেড় হাজার/দুই হাজার দিরহাম, সৌদি আরবে দেড়-দুই হাজার রিয়াল মাসিক বেতনে শ্রমিক নিয়োগ করা হতো। এই মাসিক বেতনের পরিমাণ এখন অর্ধেকেরও নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। অথচ দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয়ভার বেড়েছে দেড়-দুই গুণ। আমরা জানি এবং দেখছি, আন্তর্জাতিক শ্রমশক্তির বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, কাউকে নামমাত্র বেতনে কঠিন শ্রম দেয়ার মুখোমুখি ঠেলে দেয়া হবে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, ইউরোপের দরিদ্রতম দেশ থেকে কিন্তু চল্লিশ-পঞ্চাশ দিনার মাসিক বেতনে কোন শ্রমিক কুয়েতে যাচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশেই এ রকম নিু মজুরিতে নেয়া হচ্ছে নাÑ যাবেও না ইউরোপ থেকে শ্রমিক। অথচ বাংলাদেশী শ্রমিকরা কুয়েত-সৌদি আরবসহ অন্যান্য তেল সম্পদের দেশে শ্রম দিচ্ছে সপ্তাহে ষাট ঘণ্টারও বেশি। জনশক্তি রপ্তানিকারকরাও নানা মিথ্যা তথ্যের আশ্রয় নিচ্ছে।
দুই.
মধ্যপ্রাচ্যে এই যে নির্মম শ্রম বাণিজ্য চলছে, এর মুনাফালোভী বেনিয়ারা কোনভাবেই আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার আইন মেনে চলছে না। অথচ জাতিসংঘ সংবিধানে শ্রম অধিকার খুব স্পষ্টভাবেই বর্ণিত আছে। জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর এসব আইনি নীতিমালা মেনে চলারই কথা। কিন্তু তারা তা মানছে না। বরং অমানুষিক নির্যাতন করছে শ্রমিকদের ওপর। গৃহবাবুর্চির চাকরির নামে হরণ করছে নারীর সম্ভ্রম।
ইউরোপ-আমেরিকায় একজন শ্রমিক প্রতি সপ্তাহে তার বেতন পান। এসব দেশে সপ্তাহে মজুরি দেয়া হয় ঘণ্টাপ্রতি। একজন দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক কাজ করেন সপ্তাহে চল্লিশ ঘণ্টা। এর বেশি কাজ করলে তা ওভারটাইম হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিশ্বে পয়লা মে যে মহান মে দিবস পালিত হয় এর মূলমন্ত্রই ছিল শ্রমিকের শ্রম অধিকার আইন সংরক্ষণ করা। বিশ্বের সভ্য দেশগুলো সে আলোকেই শ্রম আইনে সংযোজন-বিয়োজন ঘটাচ্ছে প্রায় প্রতি বছর। আমার প্রশ্ন হচ্ছেÑ মধ্যপ্রাচ্যের আলখেল্লাধারী রাজ শাসকরা কি নিজেদের সভ্যতার পথে অগ্রসরমাণ বলে দাবি করেন না। যদি করেন তবে তারা তাদের শ্রম আইনগুলো আরও উদার করছেন না কেন? কেন আটকে রাখা হচ্ছে শ্রমিকের বেতন মাসের পর মাস?
এখানে আরেকটি বিষয় বলা দরকার, বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতা ও দল মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশকে তাদের মিত্র মনে করেন। তথাকথিত ভ্রাতৃপ্রতীম সৌহার্দ্য রয়েছে বলেও দাবি করেন তারা। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এসব রাজনীতিক শ্রম অধিকার আইন সংশোধনে মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহ, খলিফা, সুলতান, আমিরদের সঙ্গে কথা বলেন না কেন? লিয়াজোঁ তৈরি করেন না কেন? চাপ প্রয়োগ করেন না কেন?
আমরা দেখছি কুয়েতে শ্রমিকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। তাদের হীনভাবে দমন করা হয়েছে। এ বিষয়ে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারেনি প্রবাসী কল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। বর্তমান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী প্রবাস বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকলেও তিনি সে অফিস নিয়মিত করছেন না। পড়ে আছে ফাইলের স্তূপ। এ বিষয়ে ৩১ জুলাই ’০৮ বৃহস্পতিবার চ্যানেল আই একটি সংবাদ রিপোর্ট করেছে, যা হতবাক করেছে সব সচেতন মানুষকে।
বাংলাদেশের শ্রমশক্তিকে বিদেশে পাঠিয়ে কাজে লাগাতে হলে কিছু কাজ করা খুব জরুরি। আর তা হচ্ছে,-
১. মধ্যপ্রাচ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য জাতিসংঘের মাধ্যমে সেসব দেশগুলোর প্রতি প্রস্তাবনা পাঠাতে হবে।
২. বাংলাদেশের রিক্রটিং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানোর চুক্তিনামা প্রবাসী মন্ত্রণালয়কে পরখ করে দেখতে হবে। ন্যূনতম বেতন কত হলে লোক পাঠানো যাবে তার একটা গাইড লাইন তৈরি করতে হবে। সে প্রক্রিয়ায় লোক পাঠাতে হবে। বিশ্বে নতুন শ্রমবাজার খুঁজতে হবে।
৩. মধ্যপ্রাচ্যের বাংলাদেশ দূতাবাসকে শ্রমিকদের সর্বপ্রকার সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসতে হবে। যাতে প্রবাসী বাঙালিরা তাৎক্ষণিক তাদের সমস্যায় সহযোগিতা পান। প্রতিটি দূতাবাসে একটি মনিটরিং সেল বা তত্ত্বাবধান শাখা থাকতে হবে।
৪. কোন বাংলাদেশী শ্রমিক যাতে অমানবিকভাবে নিগৃহীত না হন, সেজন্য রাজনৈতিকভাবে আলোচনা করতে হবে। উটের জকি, গৃহপরিচারিকা, অবৈধভাবে পাচার ও দাসপ্রথা বন্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে যত শিগগিরই উদ্যোগী হবে ততই মঙ্গল হবে প্রবাসী সমাজের।

------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ২২ আগষ্ট ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত


ছবি - রণজিত দাস


সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০০৮ ভোর ৫:৫৩
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×