somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ফকির ইলিয়াস
আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

বিক্রীত জীবন ও সভ্যতার বিন্যস্ত নখর

১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৮:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিক্রীত জীবন ও সভ্যতার বিন্যস্ত নখর
ফকির ইলিয়াস
====================================
সময় পেলেই আমি আমার দুই মেয়েকে নিয়ে বিভিন্ন অভিজাত গ্রন্থবিপণি ঘুরে আসি। নিউইয়র্কে 'বার্নস এন্ড নবলস'-এ আমাদের যাওয়া হয় প্রায় প্রতিমাসেই। বই কেনা, বইপড়া আমার নেশা। আমার দুই মেয়েও বই কিনতে, পড়তে ভালবাসে। আমি তাদের বই কিনে দিতে কখনই কার্পণ্য করি না। সাধারণত 'বার্নস এন্ড নবলস'-এ গেলে আমি আমার পছন্দমতো বইয়ের সেকশনগুলো ঘুরে দেখি। কখনও সেখানে ফ্লোরে বসেই পড়া শুরু করে দেই।

সেদিনও গিয়েছিলাম বই দেখতে, বই কিনতে। ঘুরতে ঘুরতে একটি বইয়ে আমার দৃষ্টি গিয়ে থামল। বইয়ের প্রচ্ছদটিই আকর্ষণীয়। একজন ভারতীয় টিনএজের ছবি। হাতে নিয়ে বইটি পড়া শুরু করলাম। বইটির নাম- সোল্ড (SOLD)। অর্থাৎ বিক্রীত কিংবা যা বিক্রয় হইয়াছে। বইটি কবিতার। ফলে আমার আগ্রহ বেশ বেড়েই গেল। বইটি লিখেছেন-প্যাট্রিশিয়া ম্যাককরমিক। খুব খ্যাতিমান কেউ, এমনও নয়। তারপরও কাব্যগ্রন্থটি উঠে এসেছে বেস্ট সেলারে। পেয়েছে পুরস্কারও।

সূচনাতেই বলা হয়েছে, গ্রন্থটি লিখতে গিয়ে লেখিকা ভারত এবং নেপাল সফর করে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। তার অভিজ্ঞতালব্ধ চিত্রই ফুটে উঠেছে গোটা গ্রন্থের পঙ্ক্তিমালায়।
গ্রন্থটির অন্যতম চরিত্র ''লক্ষ্মী ''নামের একজন কিশোরী। হিমালয়ের তান্ডবে ওদের শস্যজমি বিনষ্ট হয়ে যায় পুরোপুরি। সংসারে সৎপিতার তদারকি ছিল। শুরু হয় চরম টানাপড়েন। একদিন সৎপিতা লক্ষ্মীকে তুলে দেয় একটি দুষ্টচক্রের হাতে। লক্ষ্মীকে বলা হয় ওকে কাজের খোঁজে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু ক'দিন পরই লক্ষ্মী বুঝতে পারে ও বিক্রি হয়ে গেছে। তাকে লিপ্ত করানো হয় আদিম পেশায়। লক্ষ্মীর জীবনে নেমে আসে মুখোশপরা সমাজের পাশবিক নির্যাতন। একজন কিশোরী লক্ষ্মীর জীবনযাত্রা শুরু হয় এমন অশুভবৃত্তির মাধ্যমেই।

এই গ্রন্থটিতে আরও বেশকিছু চরিত্রের বর্ণনা আছে। ওদের নাম- শাহানা, শিল্পা, প্রিয়া ইত্যাদি। ওদের নিয়ন্ত্রণ করে 'মমতাজ' নামের এক প্রৌঢ়া। সুপ্রিয় পাঠক-পাঠিকা, একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, এমন দৃশ্যকল্প নতুন কিছু নয়। গণিকাবৃত্তি এভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। তারপরও একজন মার্কিনি কবির বর্ণনায় এই 'বিক্রীত জীবন' উপাখ্যান এত বাজার পাচ্ছে কেন? তার একটিই কারণ, গ্রন্থটির লেখিকা তার লেখার প্লট হিসেবে থার্ড ওয়ার্ল্ডকে বেছে নিয়েছেন। ভারত-নেপাল অঞ্চলটি হয়ে উঠেছে তার অন্যতম পছন্দ।

ধনী-সভ্য দেশগুলো, তৃতীয় বিশ্বকে তাদের পর্যবেক্ষণের মাঠ হিসেবে দীর্ঘ সময় থেকেই বিবেচনা করে আসছে। ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন, মন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও কখনও হয়ে উঠেছে তাদের খুব বেশি 'এক্সপেরিমেন্টাল সাবজেক্ট/ অবজেক্ট '। জীবনকে বাঁচানোর বদলে, বরং জীবনকে কেটে ছিঁড়ে তাদের তত্ত্বজ্ঞান প্রতিষ্ঠায়ই ব্রত হয়েছে কোন কোন মহল। যা মানবতাকে শুধু হত্যাই করেনি, কলঙ্ক লেপে দিয়েছে গোটা মানব সমাজের চোখে-মুখে।

'সোল্ড' গ্রন্থটিতে গ্রন্থকার যে বর্ণনার বুনন নির্মাণ করেছেন তা কি ইউরোপ আমেরিকায় নেই? হ্যাঁ, এখানেও আছে। তারপরও প্রাচ্যের কোন লেখকের কলম দিয়ে সমাজের পচন কিংবা ধর্মের দিকগুলো তুলে ধরিয়ে বাজার মাত করার চেষ্টা কেন হচ্ছে? তার প্রধান কারণ দুটি। প্রথমটি হচ্ছে বিশ্বে মোড়লিপনা ধরে রাখা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, মুনাফার বাণিজ্য বর্ধন। এ প্রসঙ্গে আমি একটি ঘটনার কথা বলি। যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাংবাদিক চার্লস জিরহাম এক আড্ডায় জানাচ্ছিলেন তার মস্কো সফরের অভিজ্ঞতার কথা।

তিনি ১৯৭৭ সালে সে সময়ের বৃহৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। চার্লস তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, কমিউনিজমের সে সময়ের তীর্থস্থান সোভিয়েত ইউনিয়নে বাড়তি দুটো ডলারের জন্য তরুণীরা উদগ্রীব থাকত। অনেক মার্কিনী ধনকুবের পর্যটকরা সেই আয়েশ গ্রহণের জন্য ছুটে যেতেন মস্কো অভিমুখে। পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের ডলার এভাবেই গিয়ে হাতে হাতে উড়ত মস্কোর গণিকামহলে।

ধরা যাক এই যুক্তরাষ্ট্রের কথাই। এখানে কি টিনএজরা সামাজিক সভ্যতার বিন্যস্ত নখর থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ? না, নিরাপদ নয়। মধ্যরাতের টিভিতে 'মিসিং কিডস্' এর ছবিসহ বিবরণ দেখলে গা শিউরে উঠে। পনেরো-আঠারো বছরের কিশোরী। ২০০১ থেকে নিখোঁজ রয়েছে! মানব-শিশুকল্যাণ সংস্থার এমন বিজ্ঞাপন দেখলে পাঁজর ভেঙে যায়। একজন পিতা হিসেবে চোখ জলে ভেসে যায়! হায় জীবন! ন' বছর ধরে নিখোঁজ মেয়েটি এখন কোথায় আছে? কেমন আছে? বেঁচে আছে কি? এমন অনেক ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খায়।

অপ্রাপ্ত বয়স্কদের যৌন নির্যাতনে বাধ্য করতে তৃতীয় বিশ্ব এবং প্রথম বিশ্বের মাঝে একটি পার্থক্য আছে। তা হচ্ছে আইনি বাধ্যবাধকতা এবং আইনি সহায়তা। তৃতীয় বিশ্বে বাল্যবিবাহ, শিশু নির্যাতন, সামাজিক অনাচারের সুবিচার হয় না। সুবিচার পাওয়া যায় না। প্রথম বিশ্ব সে বিষয়ে অত্যন্ত সোচ্চার ও সজাগ। ফলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও সেবা দিতে সর্বদা প্রস্তুত। তারপরও প্রথম বিশ্বে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চুরি, পাচার, গ্রেভইয়ার্ড থেকে মৃত মানুষের হাড়গোড়-খুলি চুরি, সমাধি থেকে মূল্যবান ধাতু নির্মিত ফলকগুলো চুরির মতো জঘন্যতম ঘটনাও ঘটছে। সেসব ঘটনার খন্ডচিত্র তৃতীয় বিশ্বের মানুষ খুব কমই জানছে, জানতে পারছে। কারণ তা দেখার জন্য, দেখে গ্রন্থ লেখার জন্য যে সাধ্যের দরকার তা নেপাল কিংবা বাংলাদেশের একজন দরিদ্র লেখকের নেই। অথচ মার্কিন লেখিকা প্যাট্রিশিয়া ম্যাককরমিকের সে সাধ্য আছে বলেই তিনি গ্রন্থ লেখার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ভারত-নেপাল ছুটে যেতে পারছেন। অথবা তার প্রকাশনা সংস্থা স্পন্সর করে, খরচ দিয়ে তাকে নির্দিষ্ট অঞ্চলে পাঠাচ্ছে। নিজেদের সহস্র অন্ধকার মিথ্যায় ঢেকে, তৃতীয় বিশ্বকে তুলে ধরা হচ্ছে, প্রথম বিশ্বের কাছে চরম মানবতাবিরোধী ভূখন্ড হিসেবে। ফলে ভারত-নেপাল-বাংলাদেশের যে প্রজন্ম যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা কিংবা ইংল্যান্ড-ফ্রান্সে জন্মেছে, তারও বিরূপ ধারণা হচ্ছে পিতা-পিতামহের শিকড় সম্পর্কে। প্রপিতামহের নাড়িপোঁতা সেই রাষ্ট্রভূমি সম্পর্কে।

বিশ্বের চারপাশে ঘটে যাওয়া অমানবিক, অমর্যাদাকর, বর্বর ঘটনাবলির দৃশ্যচিত্র একজন কবি কিংবা লেখক তার লেখায় তুলে আনতেই পারেন। কিন্তু এসব স্থাবর কাঁটাগুলো দূর করবে কে? দূর করতে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রপক্ষকে। পারস্পরিক সৌহার্দ্য, রাষ্ট্রীয় আইনের উপাদান বিনিময়, সংহতির শক্তিচর্চা সর্বোপরি মানবিক বিবেক জাগ্রত করে তোলার মাধ্যমেই এসব সামাজিক অনাচার রোধ করা সম্ভব।

আমরা দেখছি, নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন (এনজিও) এর নামে পাশ্চাত্যের একটি শ্রেণী প্রাচ্যে গিয়ে কর্মকান্ড চালালেও নেপথ্যে এক ধরনের শোষণের মনোবৃত্তি লালন করছে কেউ কেউ। এমন মানসিকতার চির অবসান প্রয়োজন। বিক্রীত মানব জীবনকে উপজীব্য করে যারা যশ এবং অর্থ দুটোর পেছনে ছুটছেন, তাদের অজানা নয় মানবতাবোধই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তির নাম। কিন্তু তারা তার পরিচর্যা করছেন না।

বিক্রীত জীবনের গ্লানি আমাদের যেমন পীড়া দেয়, ঠিক তেমনি সভ্যতার বিন্যস্ত নখরও আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে সমানভাবে। একজন কবি যেমন সুন্দরের পূজারি, একজন কৃষকও তেমনি সুন্দরের বিবর্তক। তার ফলানো ফসলের হাসি, ধানচারার সবুজ মাঠে বয়ে যাওয়া ঢেউ আমাদের আশায় নবতর দোলা দিয়ে যায়। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রধান শত্রু 'দারিদ্র্য' 'অভাবের তাড়না'-ই সৃষ্টি করে ক্ষত। তাই আবারও বলি, দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্বই হতে পারে প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়।
নিউইয়র্ক , ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯
--------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ। ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×