somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ফকির ইলিয়াস
আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

জালাল উদ্দীন খাঁ ও তার সঙ্গীত /যতীন সরকার

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জালাল উদ্দীন খাঁ ও তার সঙ্গীত
যতীন সরকার
========================================
জালাল উদ্দীন খাঁ (১৮৯৪-১৯৭২) পূর্ব ময়মনসিংহের একজন বিশিষ্ট বাউল কবি ও গায়ক। তার জন্ম নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আসদহাটি গ্রামে। তার পিতার নাম সদরুদ্দীন খাঁ।

কেন্দুয়া উপজেলার সিংহের গাঁও-এর হাসমত আলী তালুকদারের একমাত্র কন্যা ইয়াকুতুন্নেছাকে বিবাহ করে জালাল উদ্দীন তাঁর পৈতৃক নিবাস পরিত্যাগ করেন ও আমৃত্যু সিংহেরগাঁও-এ বসবাস করেন।

বিশ শতকের বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে প্রাকৃত বাঙালিজনের এই কবি তার সাধনায় সক্রিয় ছিলেন। যে অঞ্চলে তিনি জন্মেছিলেন ও জীবন-যাপন করেছিলেন, সে অঞ্চলটির লৌকিক ঐতিহ্য খুবই সমৃদ্ধ। তখনকার অখণ্ড বাংলার বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহের যে অংশটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘পূর্ব ময়মনসিংহ’ নামে, জালালউদ্দীন খা সেখানকারই মানুষ। এককালের পূর্ব ময়মনসিংহের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও তার আশপাশের সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের কিছু অংশ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী প্রভৃতি এলাকা নিয়েই গড়ে উঠেছিল একটি বিশিষ্ট সংস্কৃতি অঞ্চল। সে অঞ্চলে জন্ম হয়েছিল অনেক লোককবি ও লোকগীতিকাব্যের। এরকমই লোককবি ও লোকগীতিকার সুনামগঞ্জের হাছন রাজা ও রাধারমন, নরসিংদীর দ্বিজদাস ও হরিচরণ আচার্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনোমোহন দত্ত, নেত্রকোনার লাল মাসুদ, সুলা গাইন, বিজয় নারায়ণ আচার্য, দীন শরৎ (শরৎ চন্দ্র নাথ), কিশোরগঞ্জের রামু মালি, রামগতি শীল ও রামকানাই নাথ। এঁদেরই প্রত্যক্ষ উত্তরসাধক বিশ শতকের জালালউদ্দীন খাঁ।

জালাল খাঁ প্রত্যক্ষ প্রেরণা পেয়েছিলেন এ অঞ্চলেরই আরেকজন প্রখ্যাত লোককবি ও গীতিকার রশিদ উদ্দিন (১৮৮৯-১৯৬৪)-এর কাছ থেকে। বিগত শতাব্দীর বিশের দশকেই রশিদ উদ্দিন খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। জালালের চেয়ে রশিদ বছর পাঁচেকের বড় ছিলেন। অগ্রজ কবি রশিদের বাড়ি ছিল নেত্রকোনা শহরের পাশের গ্রাম বাহিরচাপড়ায়। এই বাহিরচাপড়ায় রশিদের বাড়িতে থেকে জালাল খাঁ কিছুদিন নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। সেই সূত্রেই রশিদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে জালালের কবিপ্রতিভা তথা সংগীত প্রতিভা বিকাশের পথ খুঁজে পায়।

রশিদ উদ্দিন ছাড়াও ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ অঞ্চলে জালালের সমসাময়িক অগ্রজ ও অনুজ কবি গীতিকারদের মধ্যে ছিলেন- উকিল মুন্সি, চান খাঁ পাঠান, তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, দুলু খাঁ, আবেদ আলী, উমেদ আলী, আবদুল মজিদ তালুকদার, আবদুস সাত্তার, খেলু মিয়া, ইদ্রিস মিয়া, আলী হোসেন সরকার, চান মিয়া, জামসেদ উদ্দিন, গুল মাহমুদ, প্রভাত সূত্রধর, আবদুল হেকিম সরকার। এদেরই ধারাবাহী কবি গীতিকারদের মধ্যে এখন এই একুশ শতকের প্রারম্ভেও-সক্রিয় আছেন খোরশেদ মিয়া, মিরাজ উদ্দিন পাঠান, আব্দুল হাকিম এবং মহিলা কবি আনোয়ারা বেগম।

আর জালাল রচিত সঙ্গীতের ধারাটিকে সজীব রাখছেন সারা দেশের অনেক গায়কই। এদের মধ্যে ময়মনসিংহের ফুলপুরের আবুল কাশেম তালুকদার ২০০৩ সালে প্রয়াত হয়েছেন। অন্ধ গায়ক সুনীল কর্মকার এ দেশে তো বটেই, মার্কিন দেশে গিয়েও জালাল গীতি পরিবেশন করে রসিকজনের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। জালালের শেষতমা পত্নীর গর্ভজাত পুত্র আব্দুল হামিদ খান (ভাসানী) ও পিতার সাধনার ধারাকে আপন সাধ্যমত বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করছেন।

জালাল উদ্দীন খাঁ অনেক গান রচনা করেছিলেন। তার জীবদ্দশায় চারখণ্ডের ‘জালাল-গীতিকা’ গ্রন্থে ৬৩০টি গান প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘জালাল-গীতিকা’ পঞ্চম খণ্ড। সেই খণ্ডে গানের সংখ্যা ৭২টি। এই মোট ৭০২টি গান নিয়ে ২০০৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়েছে ‘জালাল গীতিকা সমগ্র।’

জালাল তার গানগুলোকে বিভিন্ন ‘তত্ত্ব’-এ বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেন। সেই ‘তত্ত্ব’গুলোর নাম- আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ় তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব। ‘জালালগীতিকা’র অধিকাংশ গানই এরকম তত্ত্বনামাঙ্কিত হলেও অনেক গানকে জালাল খাঁ তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করেননি। যেমন- ‘জালাল গীতিকা’ প্রথম খণ্ডে সংকলিত ২০২টি গানের মধ্যে ২০টি গান ‘ভাটিয়ালি’ নামাঙ্কিত। দ্বিতীয় খণ্ডের ২২৮টি গানের ৬০টিই ‘ভাটিয়ালি’। তৃতীয় খণ্ডের ৭৮টি গান সাতটি ‘তত্ত্ব’ বিষয়ে, আর ১৪টি ‘মুর্শিদি’ ও ১১টি ‘মারফতি’ নামাঙ্কিত গান।

‘জালাল গীতিকা’র চতুর্থ খণ্ডে কোনো তত্ত্ব নির্দেশ ছাড়াই বাউল সুর, ঝাপতাল, চৌপদী, প্রসাদ সুর, মুকুন্দ সুর, খেমটা নামে মোট ১০১টি গান সংকলিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর উত্তরসূরিদের হতে ‘জালাল গীতিকা’র যে পঞ্চম খণ্ড প্রকাশিত হয় তাতে গীতিগুলোর কোনোরূপ শ্রেণীবিন্যাস বা নামাঙ্কন করা হয়নি। এটিতে জালালের জীবৎকালে অপ্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের ৭২টি গীতি সংকলন করা হয়।

জালাল যদিও বাউল কবি বা বাউল গীতিকাররূপে পরিচিত, তবু মনে রাখা প্রয়োজন যে বাউল হচ্ছে বাংলার একটি বিশিষ্ট লৌকিক ধর্ম ও সাধন প্রণালীর নাম এবং এই নামের বিশিষ্ট সাধন প্রণালীটির সঙ্গে পূর্ব ময়মনসিংহ ও তার আশপাশের অঞ্চলে প্রচলিত বাউল বা বাউলা গানের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। তবে তা না থাকলেও, বাউলসহ সকল লৌকিক ধর্মেরই অন্তঃসার যে বিদ্রোহী চেতনা, সে চেতনা এ গান পুরোপুরিই ধারণ করে। জালালের গানেও এই বিদ্রোহী-চেতনারই প্রকাশ ঘটেছে।

জালাল ‘মালজোড়া’ গানের আসরে অংশগ্রহণ করে প্রভূত কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। ‘মালজোড়া’ হচ্ছে বাউল গান পরিবেশনেরই একটি বিশেষ রীতি বা প্রকরণ। একতারা বাজিয়ে আপন মনে গায়ক যে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন, মালজোড়া বাউল গানের রীতি তা থেকে আলাদা। এতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গায়ক বিভিন্ন তত্ত্বকথা নিয়ে গানে গানে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন। গানের ভেতর দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার রীতিটি দীর্ঘকাল ধরেই প্রচলিত ছিল ‘কবি গান’ বা ‘কবির লড়াই’য়ে। পরে সেটি বাউল গায়কদের মধ্যে নতুন রূপ ধারণ করে হয়ে যায় মালজোড়া গান। কবিগান ও মালজোড়া গানের প্রতিদ্বন্দ্বিতার রীতিতে কিছুটা পার্থক্য আছে। কবির লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই কবি আসরে ওঠেন দুটি সামাজিক বা পৌরাণিক চরিত্রের ভূমিকা নিয়ে। যেমন- একজন কবি আসরে উঠে নিজের পরিচয় দিলেন ‘রাবণ’ বলে, আর প্রতিপক্ষের কবিকে সম্বোধন করলেন, ‘রাম’ বলে। অর্থাৎ, একজন কবি রাবণের ও অন্যজন রামের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গেলেন। তারপর রাবণ রামকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলবেন এবং রাম সেসব প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাবেন। প্রশ্ন ও উত্তর -দুই-ই হবে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত গানে গানে। মালজোড়া বাউল গানেও দুই কবি গানের মাধ্যমেই বিতর্কের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন, তবে কবি গানের কবিদের মতো তারা অন্য কোন পৌরাণিক বা সামাজিক চরিত্রের ভূমিকা গ্রহণ করে না- সোজাসুজি একে অন্যকে নানা প্রশ্ন করেন ও প্রশ্নের উত্তর দেন। কবিগান ও মালজোড়া গান- উভয় প্রকরণেই লোকমানসের একটি বিশেষ প্রবণতার পরিচয় ধরা পড়ে। সে প্রবণতাটি হচ্ছে যুক্তিবাদের। লোকসমাজের মানুষ কোনো কিছু বিশ্বাস করার আগে তা যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে চায়, লৌকিক ধর্মও তাই ‘অনুমান’-এর উপরে স্থান দেয় ‘বর্তমান’কে। লৌকিক ধর্মের অনুসারী কবিরাও যুক্তির সুতো দিয়েই তাদের গানের মালা গাঁথেন, এক কবি আরেক কবির যুক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানান, জনসমক্ষে তারা বিতর্কে অবতীর্ণ হন। মালজোড়া গানের মধ্যদিয়েও এরকম বিতর্কই অনুষ্ঠিত হয়। মালজোড়া গানে কবিরা স্রষ্টা বা ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে নানামতের বিচার করেন, এমনকি ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করতে দ্বিধা করেন না। ১৯৪৯ সালে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার বাসাটি গ্রামে এক মালজোড়া গানের আসরে জালাল উদ্দীন খাঁ ‘ধরাট’ বা প্রশ্ন রেখেছিলেন-

আল্লা বলতে কেউ নাই এ সংসারে।

মিশে গেছে আলো হাওয়ায়

বিশ্বজুড়ে তালাশ কর কারে?

জালালের প্রতিপক্ষ বাউল ইদ্রিস এই ধরাটের উত্তর দিয়েছিলেন নেত্রকোনার আরেক প্রখ্যাত বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের একটি গানের সাহায্য নিয়ে-

জালাল তুমি ভাবের দেশে চল

আল্লাকে দেখবে যদি

চর্মচক্ষের পর্দা খোল।

গিয়া তুমি ভাবনগরে

চেয়ে থাকো রূপ নেহারে

সজল নয়নে ফটোগ্রাফ তোল-

মনরঙে প্রেমতরঙ্গে তোমার দিলের কপাট খোল।

দেখবে তোমার মাবুদ আল্লা

সামনে করে ঝলমল ।।

দেখবে আল্লার রঙ ছুরত

অবিকল তুই জালালের মত

তোর সঙ্গে অবিরত

করে চলাচল।

তোমার রঙে রঙ ধরেছে

হয়েছে এক মিল

তোরে দেখলে তারে মিলে

আর কারে তুই দেখবে বল ।।

এখানে যে ধরনের যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে, সে ধরনের যুক্তি প্রয়োগের মধ্য দিয়েই লোকসমাজের কবি গীতিকাররা তাঁদের স্বাধীন চিন্তার উৎসারণ ঘটিয়েছেন। জালাল রচিত গীতিগুলোতেও এ রকমই স্বাধীন চিন্তা ও বিদ্রোহী চেতনার স্পষ্ট ও সার্থক অভিব্যক্তি ঘটেছে। লৌকিক ধর্মের ঈশ্বর বিশ্বাস শাস্ত্রীয় ঈশ্বর-বিশ্বাস থেকে পৃথক। ঈশ্বরকে ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে লৌকিক ধর্মের অনুসারীরা মানব দেহের মধ্যেই উপলব্ধি করেন। যা নাই ভাণ্ডে, তা নাই ব্রহ্মাণ্ডে’- অর্থাৎ সারা ব্রহ্মাণ্ডে যা আছে তার সবই আছে মানব দেহের ভেতরে- এটিই তাদের ধর্মবোধ ও জীবনবোধের ভিত্তি। এ বোধ থেকেই তারা ‘সোহংবাদী’ বা ‘আনাল হফবাদী’ অর্থাৎ ‘আমিই ঈশ্বর’ বা ‘আমিই সত্য’- এ রকম ভাবনার অনুসারী। আবার সেই ভাবনা থেকেই তারা ‘মানুষভজন’কারীও, মানুষগুরুকেও তারা ঈশ্বর রূপে মান্য করেন। এ সব কারণেই শাস্ত্র ব্যবসায়ী ধর্মযাজক বা মোল্লা-পুরোহিতের সঙ্গে তাদের বিরোধ উত্তুঙ্গ হয়ে ওঠে। শাস্ত্রের পুঁথিপত্র না ঘেঁটে তারা নিজেদের মতো করে ‘সত্যসিন্ধু জলে’ ডুব দিতে চান।

এরকম সত্যসিন্ধু জলে ডুব দিয়েই জালাল খাঁ তার আত্মতত্ত্বের গানগুলো রচনা করেছেন। ‘জালালগীতিকা ও গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের প্রথম গানটিতেই জালাল বলেছেন,

আমার আমার, কে কয় কারে ভাবতে গেল চিরকাল,

আমি আদি আমি অন্ত-আমার নামটি রুহুজ্জামাল।।

আমারি এশকের তুফান, আমার লাগি হয় পেরেশান,

আবাদ করলাম সারে জাহান, আবুল বাশার বিন্দু জালাল।।

আমি ময় অনন্ত বিশ্ব- আমি বাতিন আমি দৃশ্য,

আমি আমার গুরুশিষ্য, ইহকাল কি পরকাল ।।

আমার লাগি আমি খাড়া, আমার স্বভাব হয় অধরা,

আমি জিতা, আমি মরা- আমার নাহি তাল-বেতাল।।

আমি লায়লা আমি মজনু, আমার ভাবনায় কাষ্ঠ তনু,

আমি ইউসুফ, মুই জোলেখা, শিরি-ফরহাদ কেঁদে বেহাল ।।

আমি রোমের মৌলানা, শামছ তাবরেজ দেওয়ানা,

‘জুমলে আলম’ মোর শাহানা, খাজা, সুলতান, শাহ-জালাল।।

আমার বান্দা কারাগারে আমিই বদ্ধ অন্ধকারে,

মনের কথা বলবনারে, কেঁদে কহে দীন জালাল।

জালালের সঙ্গীত ভাবনা তথা জীবনদর্শনে দ্বৈতবাদের কোনো স্থান নেই। সে কারণেই প্রচলিত অর্থে যাঁকে ‘দয়াময়’ খোদা বা ঈশ্বর বলা হয়, তাকে লক্ষ্য করেই জালাল বলেন-

আমি বিনে কে-বা তুমি দয়াল সাঁই

যদি আমি নাহি থাকি, তোমার জায়গা ভবে নাই।

‘সীমার মাঝে অসীম’ এর বোধটিও এবং ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ এর ধারণাটিও, জালালের গানে অভিব্যক্তি পেয়েছে। খোদার উদ্দেশ্যে তার বক্তব্য-

বিশ্ব প্রাণের স্বরূপ ছায়া, আমাতে তোমারি মায়া,

ছেড়ে দিলে এ সব কায়া, তুমি বলতে কিছুই নাই ।।

তুমি যে অনন্ত অসীম, আমাতে হয়েছ সসীম;

কালী-কৃষ্ণ, করিম-রহিম কত নামে ডাকছি তাই ।।

এই অদ্বৈতবোধ থেকেই জালাল আত্মস্বরূপের সন্ধান করেন-

মন বেহুদা খোদা বলে ডাকছ কারে?

খোদ ছেড়ে খোদা রয় না-ফুলে হয় ফল যে প্রকারে।

ফল শাখা পত্র ফুল চারযোগে এই তরুকুল

যার তার জাতি প্রকৃতি মূল নিজেকে নিজে চিনবেন নারে।

নিজেকে নিজে চিনে দিয়েই জালাল খোদা বা ভগবানকেও চিনে নিতে পেরেছেন এবং একান্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে ফেলেছেন-

দরবেশ তুমি আল্লা খোঁজ ঋষি খোঁজে ভগবান

হয় না দেখি কারো সাধ্য করতে তার অনুসন্ধান।।



ভগবান নয় জানোয়ার কিসে দেখা পাবি তাহার

পাইলে পাবে স্বরূপ সাকার যে রূপ আজ বর্তমান।।

‘স্বরূপ সাকার’ ও ‘বর্তমান’ যে মানুষ, সেই মানুষকেই তো ফেরেশ্তারা সেজদা দেয়। যে-ফেরেশ্তা মানুষকে সেজদা দিতে অস্বীকার করেছিল, সেই তো হয়ে গেল শয়তান। সে-কথা স্মরণ করেই জালালের অনুজ্ঞা-

আদমকে করতে এতেকাদ, শয়তান হয়ে যাবে তফাত

থাকে যদি দিরের সাধ, সেজদা দেও মানুষের পায়।

মানুষের মহিমাই ধরা পড়েছে জালালের গানের বিভিন্ন চরণে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত এ-রকম,-

১. মানুষ থুইয়া খোদা ভজ, এই মন্ত্রণা কে দিয়াছে,

মানুষ ভজ কোরান খোঁজ পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে

২. করিম রহিম রাধা কালী এ বোল সে বোল যতই বলি

শব্দ ভেদে ঠেলাঠেলি হইতেছে সংসারে।

মানবদেহে থেকে স্বয়ং একই শক্তি ধরে

প্রেমের মূর্তি লয়ে একজন বিরাজ করে প্রতি ঘরে।

৩. প্রতি ঘটেই খোদা আছে এ বিশ্বব্রাহ্মণ্ডময়

সে তো পাখির মতো খাঁচায় পুরে

এক স্থানেতে রাখার নয়।

৪. বিচার করলে নাইরে বিভেদ কে হিন্দু কে মুসলমান

রক্তমাংসে একই বটে সবার ঘটে একই প্রাণ।

৫. মানুষের ছুরত তার মধ্যে কুদরত

সেই জন্য ভজিতে হয় মানুষের চরণ।

৬. মানুষের ছবি আঁকো, পায়ের ধূলি গায়ে মাখো

শরিয়ত সঙ্গে রাখো, তত্ত্ববিষয় গোপন আছে।

জালাল রচিত ‘দেশতত্ত্ব’ ও ’সংসারতত্ত্ব’-এর গানগুলোতে পরিপার্শ্ব সচেতনতা ও সমকালচেতনার তীক্ষ্ম প্রকাশ ঘটেছে। দেশ-সংসার-সমাজের নানা অসঙ্গতি দেখে বিস্মিত ও ব্যথিত হয়ে জালাল গেয়েছেন-

তাজ্জব হয়ে গেলাম বাবা দিল দুনিয়ার ব্যবহারে

চোরেরা খায় খোরমা পোলাও সাধু খোরায় দ্বারে দ্বারে ।।

পরের সম্পদ করে শোষণ ধনীর ঘরে হয়েছে ধন

খাট পালঙ্কে শুয়ে এখন গাঁজামদের আড্ডা মারে ।।

এ-রকমই সমাজ-সচেতনতা থেকে তিনি রচনা করেন-

১. পেট ভরে যে খেতে পায় না অন্যচিন্তা করবে কিসে?

২. অর্থ ছাড়া ফকিরি কই, তালশিয়ে দেখরে মন

দুনিয়ার দরবেশি যত, টাকা পয়সাই মূল কারণ।

৩. টাকা কলির পরম ধর্ম, টাকাতে সকল কর্ম,

টাকা বিনে কোনো কর্ম করা নাহি যায়।

একজন প্রকৃত আধুনিক মানুষের মতোই তিনি লক্ষ্য করেছেন যে ধর্মব্যবসায়ী অল্পশিক্ষিত মৌলবি-মুন্সিরা লোক সাধারণের আত্মজ্ঞান লাভের পথে বাধার সৃষ্টি করে রেখেছে, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে ভাষা শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত রাখতে চেয়েছে-

বিজাতি ইংরেজি শিক্ষায় বেহেশ্ত না পাওয়া যায়

মোল্লাজিদের কথা শুনে শিখল না মানুষে,

সকল ভাষা সমান বুঝে ধর এবার কষে-

কবে আবার সুদিন উদয় জালালে কয় চল্ সাহসে ।।

যে-সময়ে পল্লীর মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণকে পাপ বলে মনে করেছে, সে সময়েই জালাল বলেছেন-

জন্মনিরোধ না করিলে সুখ পাবে না এ-সংসারে।

শুধু গ্রামগঞ্জের অজ্ঞাত অখ্যাত গায়কদের কণ্ঠেই নয়, আব্বাস উদ্দিন ও আবদুল আলিমের মতো প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পীও জালালের গান রেকর্ড করেছেন। সে রকমই কয়েকটি গান-

১. ও আমার দরদী আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না।

২. আরেও ভাইট্যাল গাঙের নাইয়া----

৩. দয়াল মুর্শিদের বাজারে---

৪. সেই পাড়ে তোর বসত বাড়ি---

এ-সব গান অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, কিন্তু এগুলোর রচয়িতা যে জালাল উদ্দীন খাঁ -

এই প্রয়োজনীয় তথ্যটি অনেকেরই অজ্ঞাত।

জালালের গানে স্বদেশপ্রেমের অভিব্যক্তি ঘটেছে এ-ভাবে-

জীবন আমার ধন্য যে হায়

জনম মাগো তোমার কোলে

স্বর্গ যদি থেকেই থাকে

বাংলা মা তোর চরণ মূলে ।।

ঃ.

হেথা আমি কুসুম সাথে

জনম নিলাম অরুণ প্রাতে

শুয়ে ঘাসের গালিচাতে

মরণ যেন হয় বিভোলে ।।

মরার পরে ভুল ভাঙ্গিয়া

তোমার মনে মিশাইয়া

রেখ আমায় যুগে যুগে

জালালে কয় পরাণ খুলে ।।

ইদানিং কালে জালাল উদ্দীন খাঁর জীবন ও সংগীত নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছে। ১৯৯০ সনে বাংলা একডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে আজিজুল হক চৌধুরী বিরচিত জীবনীগ্রন্থ ‘জালাল উদ্দীন খাঁ’।

পশ্চিম বঙ্গের প্রখ্যাত গবেষক সুধীর চক্রবর্তী ১৯৯০ সনে ‘বাংলা দেহতত্ত্বের গান’ ও ২০০১ সনে ’জনপদাবলি’ নামে দুটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। প্রথম গ্রন্থটিতে জালালের ১০টি ও দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে তাঁর ১৩টি গান সংকলিত হয়েছে। দুটো গ্রন্থের ভূমিকাতেই জালালের সংগীত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সুধীর চক্রবর্তীর ‘জালাল-গীতি: ‘কত রঙের নক্শি কাঁথা’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে নাঈম হাসান-সম্পাদিত লিট্ল ম্যাগাজিন ‘নিরন্তর’-এর ষষ্ঠ সংখ্যায় পৌষ, ১৪১২ সালে। ১৯০৫-এর মার্চ মাসে প্রকাশিত হয়েছে যতীন সরকার-সম্মাদিত ‘জালালগীতিকা সমগ্র’।
-------------------------------------------------------------------
দৈনিক ইত্তেফাক / ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯

ছবি- স্টুয়ার্ট বয়েড










সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৮:০০
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×