ফকির ইলিয়াস
=========================================
লোডশোডিংমুক্ত বাংলাদেশ! বিষয়টি ভাবতেই চমকে উঠবেন অনেকে। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা ২০১৪ সালের মধ্যে লোডশেডিংমুক্ত বাংলাদেশ উপহার দিতে পারবে।
যদি তাই হয় তবে তা হবে বাঙালি জাতির জন্য একটি বড় প্রাপ্তি। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই ৩৮ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। সে তুলনায় মাটি বাড়েনি। এই অবস্থায় ২০২০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত হবে? সে প্রশ্নটি সঙ্গত কারণে আসতেই পারে।
বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। এই অগ্রযাত্রাকে থামানো যাবে না। যেমনটি যায়নি এই বাংলাদেশের মোবাইল ফোনের ব্যবহার। আমি আমার বিভিন্ন লেখায় বলি, বাংলাদেশ মোবাইল ফোন বাণিজ্যে যতটা এগিয়েছে অন্য খাতে ততটা এগুতে পারছে না কেন? এর প্রধান অন্তরায় কি?
আমার জানা মতে, ১৯৯৮ সালেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত ফোন কোম্পানি এটিএন্ডটি বাংলাদেশে তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিল। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা হয়নি। সেই সুযোগ দেয়া হয়নি। কোন বিদেশী সংস্থা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে গেলেই একটা সুর ওঠে- 'এই বুঝি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এলো!'
ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। বাঙালির সে অবস্থাই হয়েছে। যারা বারবার শোষিত হয় তারা তো ভয় পাবেই। তেমন অবস্থা বদলেছে গেল দশ বছরে। আমরা এখন বিভিন্ন বিদেশী বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে ব্যবসা করতে দেখছি। পুরো সমাজকেই কিনে নিতে চাইছে করপোরেট বাণিজ্য সংস্থাগুলো। এসব বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের হাত এখন প্রসারিত মিডিয়া হাউজের দিকেও। খাতায় সব প্রকার বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের মালিকানা তালিকা থাকবে, আর একটা মিডিয়া থাকবে না, তা কি হয়? তাই মিডিয়া নিয়ন্ত্রণেও এখন কালো হাতের ছড়াছড়ি। দৈনিক, পাক্ষিক না হয় মাসিক। টিভি স্টেশন স্থাপন করতে না পারলে নিতান্তপক্ষে একটা রেডিও। রয়েছে অনলাইন নিউজ সংস্থার প্রতিযোগিতা। যারা ঘটনার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সংবাদ ছড়িয়ে দিতে পারছে বিশ্বব্যাপী। এই যে অর্জন, তা সাধিত হয়েছে প্রযুক্তির কল্যাণে। কিন্তু এই প্রবাহ কি সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত? না, প্রভামুক্ত নয়। এটা অনেকেই জানেন। মিডিয়ার বার্তাকক্ষে পৌঁছে যায় রাজনীতিবিদ মালিকের হাত। থাকে তার চোখ। তিনি চান, তার মিডিয়াটি তার দলের কথা বলুক। দলের সিনিয়র নেতার কভারেজ একটু বেশি করে দিক।
না, পাশ্চাত্যের মিডিয়া যে সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত সেটা আমি বলছি না। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের মন মতো না হলে তারাও আপনার 'চিঠিপত্র' ছাপবে না। যদিও তাদের করপোরেট সেস্নাগান 'সকল সংবাদই ছাপার দাবি রাখে'।
এমনটি ভাবার সুযোগ নেই, নিউইয়র্ক টাইমসে ইহুদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোন বিজ্ঞাপন দিতে চাইলে তারা তা ছাপবে? না, ছাপবে না, যত টাকাই দেয়ার কথা বলা হোক না কেন! তাহলে মিডিয়াকে গণমানুষের বন্ধু বলা যাবে কিভাবে? কিভাবে নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে মিডিয়া? এই পথটি সহজ করার জন্যই নিরন্তর সংগ্রাম করতে হচ্ছে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষকে। তারা পিষ্ট হচ্ছেন একহাত থেকে অন্য হাতে। সম্প্রতি বোস্টনে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অতিথি হয়ে এসেছিলেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি. জেমস এফ মরিয়ার্টি। তিনি সেই সেমিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছেন, বর্তমান সময়ে একটি-দুটি মিডিয়ার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করার সুযোগ নেই। কয়েকটি মিডিয়া মিলিয়ে দেখে তবেই সত্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত। তার কথাটি মিথ্যে নয়। যুক্তরাষ্ট্রেও গসিপ ম্যাগাজিনগুলোর পাঠক বেশি। তারা এসব সংবাদকে এক ধরনের প্রমোদ বলেই বিবেচনা করে। 'ইউএস টুডে' কিংবা 'ওয়াশিংটন পোস্ট' ভাবনার খোরাক দেয়। সত্য-মিথ্যের হিসাব মেলানোর সুযোগ দেয়। গসিপ ম্যাগাজিনগুলো তো তাও দেয় না। প্রজন্মকে এই সত্য অনুধাবনের কাছাকাছি যেতে হবে।
এটা খুবই আশার কথা, এখন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তিন-চার হাজার টাকা মূল্যের মোবাইল ফোন দিয়েও ওয়েব ব্রাউজ করা যায়। জরুরি সংবাদটি এসএমএস করে পাঠানো যায়। আরেকটু দামি ফোন দিয়ে ছবি তুলেও পাঠানো যায় দেশে-বিদেশে। তাহলে সত্যটি দাঁড়াচ্ছে এই একটি ফোন একজন মানুষকে 'অন দ্য স্পট' থেকে রিপোর্টার করে তুলতে পারছে বেশ সহজেই। যে হিসেবে একজন সচেতন মানুষই হতে পারছেন এক একজন মিডিয়া প্রডিউসার, ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও। এই যে প্রাপ্তি, তার চেতনাকে ধরে রেখেই এগিয়ে যেতে পারে একটি জাতিসত্তা। বলার অপেক্ষা রাখে না, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ বলে দাবিদার বাংলাদেশের সরকারপক্ষ থেকে শক্তিশালী এবং স্বচ্ছ সমর্থন জনগণ পাবে, তা ভাবতেও কষ্ট হয় কি! কারণ সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই তার ঘনিষ্ঠ দলবাজরা স্বার্থ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, খেলাধুলা, সড়ক-জনপথ, ব্যবসা-বাণিজ্য, কূটনীতির সেক্টর সবখানে সেই দলবাজরা প্রাধান্য পায়। সরকারে থাকা শীর্ষরা এটাকে একটা উপহার প্রদান বলে যেমন গণ্য করেন, তেমনি তারা তেমন সিকিউরড অনুভব করেন অনুগতদের হাতে। আর এভাবেই রাষ্ট্রের মেধাবীরা বাদ পড়ে যায়। সুযোগ পেয়ে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা লাইম লাইটে চলে আসে। এমনকি নিজ দলের মেধাবীরাও হেরে যায় তদবিরবাজদের কাছে।
বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলই এই প্রতিযোগিতা দীর্ঘদিন থেকে করে আসছে। এই মানসিকতার কোন উন্নয়ন ঘটেনি কিংবা ঘটছে না। ওয়ান-ইলেভেনের পর বাংলাদেশে এই সত্যটি আরও সুদৃঢ় করছে, উদার হতে হবে রাজনীতিকদেরই। কারণ একটি দল রাষ্ট্রশাসন করে পাঁচ বছর মেয়াদে। আর জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পান পাঁচ বছর পর একবার। এই পাঁচ বছরে বিভিন্ন আনুষঙ্গিক কারণে ভোটারের মত পরিবর্তনের সুযোগও পায়। ভোট কিনেও নেয়া যায়। আবার স্থানীয়, আঞ্চলিক, ব্যক্তিগত ইমেজ প্রভৃতি বিষয় ফ্যাক্টর হয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে।
যোগ্য জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে মিডিয়ারও একটা ভূমিকা থাকে। কারণ মিডিয়া জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে ওই প্রার্থীর একটি সুস্পষ্ট চিত্রমালা। ঠিক একইভাবে আজ দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধা নিরসন কিংবা সমাজ নির্মাণে যে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হচ্ছে এর জন্যও দরকার মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
এমনকি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নেও দরকার সরকার ও এলাকাবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। একটা কথা স্পষ্ট করে বলি, কোন এলাকায় কে সংগ্রামী, কে অপরাধকর্মের সঙ্গে জড়িত তা ওই এলাকাবাসীর অজানা থাকার কথা নয়।
তারা যদি সম্মিলিতভাবে এসব অপশক্তিকে রোধে তৎপর হন এবং সরকারের সাহায্য চান তবেই একটি যৌথ প্রয়াস গড়ে তোলা সম্ভব বলে আমি মনে করি। এক্ষেত্রে সরকারের পোষ্য ভাড়াটে বাহিনীর বিরুদ্ধেও গণমোর্চা গড়ে তুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে মানুষকেই। মানুষ আলো চায়। এর জন্য পথ করে দিতে হবে। এই আলো সমাজ-মানবতা-জাতি বাঁচানোর আলো। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার বাস্তবতার অনুকূলে কাজই তা ত্বরান্বিত করতে পারে।
নিউইয়র্ক , ২০ অক্টোবর ২০০৯
-------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ।ঢাকা। ২৩ অক্টোবর২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি - পল পোলজার্টি
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ৯:১৮