somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ফকির ইলিয়াস
আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

সামাজিক সামন্তবাদের দস্যুতা

০৮ ই অক্টোবর, ২০১০ সকাল ৭:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সামাজিক সামন্তবাদের দস্যুতা
ফকির ইলিয়াস
----------------------------------------------------------------------
প্রতিটি সমাজে সামন্তবাদ সোচ্চারই থাকে। কোথাও প্রকাশ্যে। কোথাও গোপনে। সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শক্তি পরীক্ষা করে। এ শক্তি পরীক্ষা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় আইনের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এর প্রসার বেশ ব্যাপকই বলা যায়। এ সামাজিক সামন্তবাদের দস্যুতা বাংলাদেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কখনো নিরীহ মানুষের ওপর, কখনো নারীর ওপর, কখনো শিশুর ওপর।
একটি সাম্প্রতিক ঘটনার কথা বলা যায়। বাংলাদেশের উচ্চ আদালত রায় দিয়েছে, বোরকা পরতে কোন মহিলাকে বাধ্য করা যাবে না। নিঃসন্দেহে এ রায়টি একটি যুগান্তকারী রায়। কারণ কোন মহিলাকে বোরকা পরিয়ে এক ধরনের মানসিক শাস্তি দেয়ার মতো মধ্যযুগীয় কাল এ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যাপন করছে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, বোরকা ইস্যুটি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ালো কেন? তাহলে কী হচ্ছে বাংলাদেশে। ধর্মীয় তমদ্দুনের নামে বাংলাদেশে একটি মহল যত্রতত্র তাদের রাজনৈতিক মতবাদ প্রকাশে ব্যস্ত রয়েছে, তা কারও অজানা নয়। ফতোয়ার নামে দোররা মেরে বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। ছাতকছড়া গ্রামের নূরজাহান সেই কালের সাক্ষী হয়ে আছেন। এই যে ফতোয়াবাজরা তারাই ক্রমে দেশে উঠতি জঙ্গিবাদীদের মদত দিয়েছে। তারা হরণ করেছে চিন্তার স্বাধীনতা, সৃজনশীল মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সামাজিক বিবর্তনের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সমাজের কাঠামো বিনির্মাণ। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি ক্ষমতাসীন সরকারই প্রকারান্তরে মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে সখ্য বজায় রেখে ক্ষমতা স্থায়ীর স্বপ্ন দেখেছে। আর সে আস্কারা পেয়ে এসব সামন্তবাদী দস্যু সমাজের বিভিন্ন প্রাঙ্গণে তার দাঁত বসিয়েছে বারবার।
সামন্তবাদের চেহারার তীব্রতা আছে 'সমাজের আধুনিক উচ্চ শ্রেণী' বলে কথিত মানুষের মাঝেও। গৃহকর্তা কিংবা গৃহকর্তী কর্তৃক 'কাজের মেয়ে' খুনের ঘটনা বাংলাদেশে অহরহই ঘটছে। কাজের ছেলেরা এক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কম। 'কাজের মেয়ে'রাই বেশি শিকার হচ্ছে। আর এসব নির্যাতনকারী উচ্চ শ্রেণীর মানুষরা আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়েও যাচ্ছে। কখনো তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এই যে পরাজয়, এই যে ব্যর্থতা গোটা সমাজের, গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার। কারণ সমাজ তাদের রুখতে পারছে না।
বাংলাদেশে আরেকটি ব্যাধি সমাজকে ধ্বংস করতে প্রকট রূপ ধারণ করেছে। তা হচ্ছে বখাটেদের উৎপাত। 'ইভটিজিং'কারীরা সব ধরনের লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে কলুষিত করছে জনজীবন। তাদের সংঘবদ্ধ উৎপাত নাকি কখনো কখনো পুলিশের মুখোমুখিও দাঁড়ায়। অপরাধী ধরতে গিয়ে পুলিশ হামলার শিকার হয়েছে, এখনো হচ্ছে। ভয়ে শঙ্কিত হওয়ার কথা, সমাজের স্খলন কি এভাবেই প্রজন্মকে আত্মঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব শিশু দিবস, বিশ্ব নারী দিবস, বিশ্ব শ্রম দিবস ইত্যাদি অনেক দিবসই ঘটা করে পালন করা হয়। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী যে ইতিবাচক প্রভাব তা খুব কমই সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিফলিত হয়। না হওয়ার কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় আইনের বাধ্যবাধকতা প্রকৃত অপরাধী চক্রকে কঠিন শাস্তি দেয়ার বিধান নিশ্চিত করতে পারেনি। এই না পারার গ্লানি বাঙালি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত হয়েই চলেছে।
দুই.
সামাজিক দস্যুতা যে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে নেই, তা আমি বলছি না। দস্যুরা এখানেও মাঝে মধ্যে তাদের নখর দেখায়। কিন্তু ধরা পড়ে এবং তাদের কঠিন বিচারের মাধ্যমে সমুচিত শাস্তিও হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭২ সালে প্যাট্রিক লেমন নামের এক ব্যক্তি এরিজোনা অঙ্গরাজ্যে ধর্ষণ করেছিল। ২০১০ সালের মার্চ মাসে ডিএনএ টেস্ট দিতে গিয়ে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে সে ধরা পড়েছে। দীর্ঘ ৩৮ বছর পর অপরাধী ঠিকই আটকা পড়েছে আইনের হাতে। এই যে আইনের শক্ত হাত, একমাত্র তাই রাষ্ট্রের মানুষকে রক্ষা কবচ হয়ে সাহায্য করতে পারে।
সামাজিক সামন্তবাদ রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় পেলে বীভৎস রূপ ধারণ করতে পারে যে কোন মুহূর্তে। সম্প্রতি পাবনায় যে দুঃখজনক ঘটনাগুলো ঘটে গেছে তা গোটা জাতিকেই কলঙ্কিত করেছে। এ সময় নিউইয়র্ক সফররত দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, এ বিষয়ে তার বক্তব্য কি? তিনি বলেছিলেন, 'এক হাতে তালি বাজেনি।'
তালি দুই হাতেই বাজুক, দেশে ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের কতিপয় কর্মী যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে সে বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। তারা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির নামে মূলত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নকেই যে কলুষিত করছে, তা প্রধানমন্ত্রী নিজেও খুব ভালো করে জানেন। তারপরও তারা এভাবে ছড়ি ঘুরাবার সাহস কেন পাচ্ছে? কোথা থেকে পাচ্ছে?
মনে রাখা দরকার যারা জঙ্গিবাদের নামে মস্তানি করছে, আর যারা রাজনৈতিক পরিচয়ে সামাজিক সন্ত্রাস করছে, তাদের উভয়ের গন্তব্য কিন্তু একই। সমাজের শান্তি বিনষ্ট করা। একটি পক্ষ সরকারি মদত পেলে অন্যপক্ষ যেনতেনভাবে সমাজের দখল নেয়ার জন্য মরিয়া হবেই। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ গেল চারদলীয় জোট সরকার। হাওয়া ভবননির্ভর বিএনপির শীর্ষ নেতানেত্রীরা চরম দুর্নীতি করেছিল বলেই জঙ্গিবাদী শক্তিটি সমান্তরালভাবে বেড়ে উঠতে পেরেছিল। তাই হুমকি-ধমকি না দিয়ে প্রকৃত অর্থেই মহাজোট সরকারের মধুলোভী ভ্রমরদের শায়েস্তা করা না গেলে বর্তমান সরকারের পালক খসে পড়তে বেশি দেরি নাও হতে পারে।
বাংলাদেশে সামন্তবাদী দস্যুতা ভিন্ন আঙ্গিকে আবির্ভূত হচ্ছে। একটি সংবাদে দেখলাম, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, শিক্ষকরা যেন ক্লাসরুমে মোবাইল ফোন ব্যবহার না করেন। মোবাইল ফোন দিয়ে যেন ছাত্রছাত্রীর ছবি না তোলেন। আইটি ক্রাইম বাংলাদেশে খুব জঘন্যভাবে সংক্রমিত হচ্ছে। গোপন ওয়েবক্যাম স্থাপন করে অবৈধভাবে কারও ছবি তুলে বস্ন্যাকমেইল করার অনেক ঘটনা পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। এতে অনেকের সংসার ভাঙছে। কেউ কেউ আত্মাহুতিও দিচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে কঠোর আইন এখনো জারি করা হচ্ছে না। একটি জাতি যখন ডিজিটাল হওয়ার স্বপ্ন দেখে তখন তা হতে হয় চতুর্দিক থেকেই। নতুন ধরনের অপরাধপ্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ধরনের আইন প্রয়োগও জরুরি হয়ে পড়ে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে আজ পর্যন্ত দ্বিগুণ হয়েছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা। ভূমি বাড়েনি। বরং বাসস্থানের অন্বেষণ হরণ করছে ক্ষেতের জমি। তাই জনবহুল এ রাষ্ট্রে অভাব-অভিযোগ বাড়ছে। হয়তো আরও বাড়বে। তাই যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা, মননশীল সমাজ গঠন এবং আইনসিদ্ধ সামাজিক অবকাঠামো বিনির্মাণ ছাড়া এ সংকট থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। এ সত্যটি বিশেষ করে দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের অনুধাবন করতে হবে।
খুবই বেদনার কথা যারা ইভটিজিং করে, যারা ফতোয়াবাজি করে তাদের বিরুদ্ধে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় তীব্র প্রতিরোধ এখনো গড়ে উঠছে না। সমাজ সচেতন প্রতিটি মানুষের উচিত এসব দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে কথা বলা। ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সামন্তবাদের প্রথা যে বদলেছে তা অনুধাবন করতে হবে প্রজন্মকে। সে প্রথা এখন আর নেই। জমিদাররা শোষণ করেছে একভাবে আর এখন সমাজের তথাকথিত প্রতিপত্তিবানরা শোষণ করতে চাইছে অন্যভাবে। এ শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েই এ বাঙালি জাতি বারবার রক্ত দিয়েছে। মহান মুক্তি সংগ্রাম করেছে। কিন্তু আজ ঘুণাক্রান্ত হওয়ার কারণেই সামাজিক পতন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এ অচলায়তন ভাঙতেই হবে সম্মিলিত প্রয়াসে।
নিউইয়র্ক, ৬ অক্টোবর ২০১০
----------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ/ ঢাকা/ ৮ অক্টোবর ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×