ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ
ফকির ইলিয়াস
===========================================
দুর্গাপূজার উৎসব চলছে। পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় আয়োজন। প্রতিটি নাগরিক তার নিজ নিজ ধর্ম সম্মানের সঙ্গে পালন করবেন। এটাই ছিল ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। সেই চেতনায়ই গড়ে উঠেছে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। কিন্তু আমরা দেখছি, একটি মহল এই সামাজিক সম্প্রীতি ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে বিভিন্ন সময়ে। এরা বারবার কলুষিত করতে চেয়েছে বাংলাদেশের মাটি।
অতি সম্প্রতি, বাংলাদেশে সহিংসতা থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রক্ষায় সরকার যথেষ্ট তৎপর নয় বলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সহিংসতা থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে রক্ষায় সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ ‘প্রায়ই ধীরগতিতে’ কাজ করে। ২০১৪ সালে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার আলোকে করা ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সহিংস ঘটনা তদন্তে কর্তৃপক্ষের ‘অনীহার’ কথাও বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিশেষ করে হিন্দুরা হামলা ও লুটপাটের শিকার হন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
প্রতিবেদনটি বলছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের ওপর হামলা করা হয় নগ্নভাবে। ওই বছর মে মাসে ১২ বছরের একটি হিন্দু মেয়েকে জোর করে ধর্মান্তরিত করার ঘটনা তদন্ত করতে পুলিশ অনীহা জানায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের বরাত দিয়ে এতে বলা হয়, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা কখনো কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার উস্কানি দিয়ে থাকেন।
এর উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্রতিবেদনে দুই হিন্দু নারীকে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের স্বীকারোক্তি তুলে ধরা হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নারীরা ভোট দেয়ায় তারা ওই ঘটনা ঘটানোর কথা স্বীকার করে বলে এতে বলা হয়। যে প্রশ্নটি বার বার উঠছে, তা হলো এই অবস্থা দেখার জন্যই কী সব ধর্মের মানুষ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন? হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসীদের সমান্তরাল রক্তেই তো সেদিন ভেসেছিল বাংলার মাটি। তাই নয় কি?
ওয়াশিংটনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেছেন, বক্তৃতাবাজি নয়, ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে তা বাস্তবায়নের গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করাই যুক্তরাষ্ট্রের এই বার্ষিক প্রতিবেদনের লক্ষ্য।
“ধর্মীয় স্বাধীনতাহীনতা নয়, বরং এটা রক্ষা করেই সমাজ ভালো করতে পারে-এটা বুঝতে সরকারগুলোকে সহায়তা করাই আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।”-বলেছেন তিনি।
মিয়ানমারে কট্টরপন্থি বৌদ্ধদের মুসলিমবিরোধী অবস্থান এবং সেখানে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ
ওপর বিধিনিষেধের বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে কয়েক ডজন রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত না হওয়াকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা বলা হয়েছে এতে। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় দীর্ঘদিন থেকেই নানাভাবে অত্যাচারের শিকার। দেখা যায়, যখনই পূজা-পার্বণের সময় আসে তখন নানা অজুহাতে তাদের
ওপর হামলে পড়ে একটি শ্রেণি। সাম্প্রতিক একটি ঘটনা এখানে আবারও উল্লেখ করা যায়। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় মন্দিরের জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় ইছাপুরা সার্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটির সহ-সভাপতি ও সিরাজদিখান পূজা উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ভবন দাস (৪৫) নামে এক ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়েছেন।
ভবন দাসের ভাই তপন দাস বলেন, ‘বাড়ির ও মন্দিরের সীমানা সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে ইছাপুরা মন্দির কমিটি ও তাদের জমিদাতা মৃত বিনোদ দত্তের পরিবারের সঙ্গে প্রতিবেশী একই গ্রামের আ. হাকিম হাওলাদার ওরফে নান্নু হাওলাদারের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। এ বিরোধ আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হলেও আ. হকিম হাওলাদার তা মেনে নিতে পারেননি। আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে গেট নির্মাণ করতে গেলে হাকিম নিরঞ্জনের মিষ্টির দোকানের সামনে একা পেয়ে ভবন দাসকে লোহার রড, লাঠি ও লোহার মগ দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। গুরুতর জখম অবস্থায় স্থানীয়রা ভবন দাসকে উদ্ধার করে প্রথমে সিরাজদিখান স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।’
ইছাপুরা সার্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্রী কমল কৃষ্ণ পাল বলেন, ‘আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজাকে বন্ধ করার জন্য পরিকরিল্পতভাবে ভবন দাসকে মারধর করা হয়েছে। মামলায় হেরে গিয়েও সাম্প্রদায়িক শক্তির ব্যবহার করেছে। হাকিম মন্দিরের জায়গার মূল মালিক মৃত বিনোদ দত্ত ১৩২৪ দাগের এক একর ১৪ শতাংশ জায়গার মধ্যে সাড়ে ৮৪ শতাংশ ও ১৩২৪ দাগের ৩৬০ খতিয়ানের ৪৮ শতাংশ মোট ১৩২ শতাংশ জায়গা ২০ বছর ধরে জোরপূর্বক জবরদখল করে রেখেছে। এ পর্যন্ত হাকিম কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। তাই আদালতে তিনি মামলায় হেরে গেছেন। এখন গেট নির্মাণ করলে তিনি প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন। ভবন দাসকে মারপিটের সঠিক বিচার না হলে এবার দুর্গাপূজা বন্ধ থাকবে।’
এটি হলো একটি চিত্র। বাংলাদেশে পূজাম-প-মঠ-গেট-মূর্তি ভেঙে ফেলার ঘটনা নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। বাংলাদেশে একটি চক্র আছে, এরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনো খেলোয়াড় ভালো খেললেও তার বিরূপ সমালোচনা করে। কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী চাকরিজীবী প্রমোশন পেলে তারও বিরূপ সমালোচনা করে। নিতান্তপক্ষে বলে, ভারতের সুপারিশে ‘ওর প্রমোশন’ হয়েছে! কি আজব দীনতা নিয়ে বেঁচে আছে এই দেশের কিছু মানুষ।
বলতে দ্বিধা নেই, গোটা বাংলাদেশের প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে এগুলোর অনেকগুলোই স্থাপিত হয়েছিল হিন্দু জমিদার-রাজা-ধনাঢ্যদের দ্বারা। এখনও সেই সাক্ষ্য রয়ে গেছে আমাদের শিক্ষাঙ্গনে। সেই একই সময়ে যখন মুসলিম জমিদারদের কেউ কেউ মত্ত ছিলেন ভোগ-বিলাসে! এসব কথা বাংলাদেশের আজকের প্রজন্মের ভুলে গেলে চলবে না। জানতে হবে জাতিসত্তার মৌলিক ইতিহাস। বাংলাদেশের মাটি সব ধর্মের মানুষের। এটা ভুলে গিয়ে অনেক ক্ষমতাবান হামলে পড়ছে নিরীহ মানুষদের ওপর।
আবারও ফিরে যাই যুক্তরাষ্ট্রের সেই সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। ‘ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ বা ‘আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অধ্যায়ে আরো বলা হয়েছে, নির্বাচনের পর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা হয়েছে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি লুট করা হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। শত শত হিন্দু তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ও টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ২৩৭ পৃষ্ঠার দীর্ঘ ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ অংশে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব সহিংসতার পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু যে রিপোর্ট বেরিয়ে এসেছে তাতে দেখা যায় সরকার আক্রান্ত এলাকায় যেসব পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষীদের পাঠিয়েছে তারা সেখানে সহিংসতা বন্ধ করতে পারেনি। এমনকি কিছু এলাকায় তারা নিজেরাই সহিংসতায় অংশ নিয়েছে। দেশের ২০১১ সালের শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষই সুন্নি মুসলিম। মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯.৫ ভাগ হলো হিন্দু। বাকি শতকরা এক ভাগেরও কম রয়েছে খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ অন্য ধর্মের মানুষ। ইউনাইটেড স্টেট কমিশন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম (ইউএসসিআইআরএফ) প্রকাশিত ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে তাদের একজন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেন। রিপোর্টিংকালে ঢাকার রাজপথে আলাদাভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় দুজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারকে। তার একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিনি অভিজিৎ রায়। তাকে এ বছরের ২৬শে ফেব্রুয়ারি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তার স্ত্রীকে করা হয় মারাত্মক আহত। এ বছরের মার্চের শুরুতে এ ঘটনায় সন্দেহজনকভাবে একজনকে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ৩০শে মার্চ ওয়াশিকুর রহমানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে যে বিষয়টি আজ বেশি দরকার তা হলো ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে মানুষের সামাজিক-ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করা। মানুষের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য চাই সামাজিক ঐক্য। বাংলাদেশের সব মৌলিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে সামাজিক ঐক্য ও সম্প্রীতির সিঁড়ি বেয়ে। তা আজ ভূলুণ্ঠিত করতে চাইছে কারা? এদের চিহ্নিত করা দরকার। বিষয়টি শুধু স্বদেশে নয়, বিদেশেও কলুষিত করতে পারে আমাদের ঐতিহ্য-সভ্যতা-কৃষ্টির ধারাবাহিকতা। আমাদের বিশ্বাস মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের মূল প্রেরণা হয়েই থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
-----------------------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক আজকের পত্রিকা ॥ ঢাকা ॥ ২০ অক্টোবর ২০১৫ মঙ্গলবার প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১১:০৮