কারা যেন ছাগলের মত চেল্লাচ্ছে, সকালের ঘুমটা একদল ছাগল পুরো মাটি করে দিল।
কেন চেল্লাচ্ছে? কোন এক পুরোহিতকে কে বা কারা মেরে ফেলেছে, তাই নিয়ে লাফালাফি। তো চালাও তোমাদের লাফালাফি, আমার ঘুম ভাঙতে এসেছ কেন ভায়া?
ঘুম তো আর হলই না। ঝুপড়ির মা চা বানায় না জল ফোটায়, বোঝা যায় না। তাই গিলে গিলে সকালের পত্রিকায় রোদের আলো পড়ে। কি বিভৎস দৃশ্য, গলাকাটা লাশ! ওসব দেখে কি সকাল নষ্ট করব? আমি বরং বিনোদন জগতের পৃষ্ঠাখানা উল্টাই, একই খবর বারবার পড়ি, নাইকার লাস্যময়ী দেহ বারবার উপভোগ করি। কি আনন্দ! সকালটা এত আনন্দের কেন।
দেশটায় এককথায় যাচ্ছেতাই চলছে। তবুও আমি ভালো আছি, এ আর কম কিসে? নারকেল বোঝাই বস্তা নিয়ে বাজারে যেতে হবে, কানাই আর কলিমের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে আনতে পারলেই আমার কর্তব্য শেষ। তারপর শুধু পত্রিকায় নায়িকা দেখার পালা। আগে পত্রিকায় জ্বালাময়ী কলাম পড়তাম। বেশকিছু মানুষকে দেবতার মত শ্রদ্ধা করতাম। তারা এখন গৃহপালিত পশু। বুদ্ধিজীবীরা নিজের সময় ও সমাজ নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে পড়লেই পরিণত হয় গৃহপালিত পশুতে। এখন তারা পত্রিকায় গালভরা মিষ্টি খাওয়া আর ডাবের রস চোষার গল্প লেখে, পড়তে খারাপ লাগে না, কিন্তু ভেতরে একটা ঘৃণা জন্মে। একদিন সকালে ঘৃণার মাত্রা এত বেড়ে গিয়েছিল যে আমি রক্তবমি করেছিলাম, সারাদিন কিছু খেতেই পারিনি। তারপর থেকে আমি মিষ্টি খাওয়া আর ডাবের রস চোষার গল্প পড়িনা। পড়ি শুধু বিনোদনপাতা, দেখি শুধু নাইকার শরীর।
হাটে যেতে না যেতেই শুনলাম গতসকালের হত্যাকান্ডের খবর। আমার ওসব শুনতে ভালো লাগে না। তবুও যে কেন এইসব হাভাতের দল আমারই মুখের সামনে এসে মলবিসর্জন করে, যে জানে। শুনলাম, যে মারা গেছে, সে খুব ভালো মানুষ। কখনও কারও সাথে তার কোন বিবাদ ছিল না। হত্যাকারীরা ধরা পড়েনা। সামনে আরও খুন হবে। হত্যাকারীরা ধরা পড়বে না। যে কেউ খুন হতে পারে। কেউ নিরাপদ না …।
আমি ঢোক গিলি, কাউকে বুঝতে দিই না। যে কেউ খুন হতে পারে। কেউ নিরাপদ না। কথাগুলো বুকের ভেতর শুলের মত বেঁধে। তারমানে আমিও নিরাপদ না। তাহলে আর বাইরে বেরিয়েছি কি করতে। ঘরে যাই… মায়ের ছেলে চুপচাপ বেঁচে ফিরি, নিজে বাঁচলেই তো বংশের নাম।
সংসারে আয় নেই, তাতে কি। লাশ হবার ভয়ে আমি ঘর থেকে বেরোই না। পৃথিবী চুলোয় যাক্, আমার মরা যাবে না। দুনিয়ায় আগুন লাগে লাগুক, আমার ভালো থাকতে হবে। যক্তিতে টিকুক ছাই না টিকুক, আমার সুখী হতে হবে।
মৃত্যুভয় চেপে ধরে আমাকে। আমি আর পত্রিকার বিনোদনপাতাও পড়ি না। টেলিভিশনের খবর আর উন্নতির জোয়ার- গঙ্গা-মেঘনা ছাপিয়ে একসাথে ভাসছে। জোয়ারের পানি গলা উপচে উঠছে, দম বন্ধ হয়ে মরছে মানুষ। তবুও উন্নয়ন ভালো, উন্নয়ন আর নিরাপত্তা যে ভাইয়ের ভাই-বোনের বোন- একই সুতায় গাঁথা।
মাঝে মাঝে নিজের ভাবনা দেখে নিজেই অবাক হই আমি। এত সাহসী চিন্তা আমি কোত্থেকে করি। আমার তো এত সাহস নাই। যাই হোক, মনের সাহস মনেই থাক, বাইরে এলেই বিপদ অথবা মৃত্যু।
কিছুদিন পরপর বেয়াড়া লোকগুলো সকাল সকাল মিছিল নিয়ে বেরোয়। ওদের মিছিল শুনতে আগে বিরক্ত লাগত; এখন ভয় লাগে। আবারও বোধহয় কারও গলাকাটা গেল। ভয় গিলে ফেলে আমাকে। ভয়ে পত্রিকা খুলি না। ভয়ে বাজারে যাই না। এটা না স্বাধীন দেশ! কেন আমাকে এত ভয়ে থাকতে হবে? প্রশ্নের উত্তর কেউ দেবে না, বাঁচাতেও আসবে না কেউ। তাই, সাধু সাবধান, চুপ করে থাকো। কণ্ঠনালীর উপর দিয়ে ছুড়ি চলবে কথা ফুটলেই। যেন ফিরে যাচ্ছি চরম অত্যাচারের সময়গুলোতে, যখন পাকসেনারা ঘরে ঢুকে বউ-ঝি দের অত্যাচার করলেও মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হত। বুদ্ধিজীবীদের ডাবের রস চোষার গল্প শেষ হচ্ছে না, টেলিভিশনে উন্নয়নের রথ ওড়াওড়ির গল্প থামছেই না… তাহলে হত্যা আর ভয়ের গল্প কবে বলা হবে? কবে বুদ্ধিজীবীরা পশুর বেশ ছেড়ে মানুষ হবে? কবে আবার শেখ মুজিব আসবে? আবার কবে আমি পত্রিকার সবক’টি লেখা পড়তে পারব? আবার কবে সাহস নিয়ে বাজারে যেতে পারব?
অনেক রাত। শুয়ে পড়লাম। এখন প্রতিটি সকালেই আমি প্রস্তুত থাকি। এরপর কোন সকালে যদি মিছিল শুনি- আমি দৌড় দিয়ে মিছিলে যোগ দিব। কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে হত্যার বিচার চাইব। ভয় লাগবে হয়ত, হয়ত কোনদিন কণ্ঠনালীতে ছুরির আঘাত বসবে। হয়ত কোন বিচার হবে না। হয়ত উন্নয়ন ও হত্যাকান্ড একই থালায় ভাত খাবে- মিছিল হারিয়ে যাবে সন্ধ্যেবেলার শ্মশানঘাটে।
তবুও, আমি আছি, তোমাদের মিছিলের অপেক্ষায় আছি… ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১৬ দুপুর ১:০৯