somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিষণ্নতার বিষবাষ্প (ছোটগল্প )

০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




ঠিক সাতটায়, সান্ধ্য সময়ে সন্ধ্যাগুলো ভূতের মত কেমন করে চেপে বসে, তা আজহার আর আমার মত বিশদভাবে আর কেউ জানে না বলেই আমাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস। ঝুপ করে মর্ত্যে অন্ধকার নেমে আসে, আর আমাদের মাঝে একরাশ বিষণ্নতা ছড়িয়ে পরে। বিষণ্নতা ? নাকি হতাশা ? নাকি একাকীত্ব ? নাকি কেন আমরা বেঁচে আছি এই জাতীয় জীবন সম্পর্কে উচ্চমার্গীয় চিন্তাভাবনা ? নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে, একথা পরীক্ষিত সত্য যে, ঠিক ঐ সময় আমরা দুজনই ঝুপ করে চুপ হয়ে যাই। পলাশীর মোরে মিলন ভাইয়ের চায়ের দোকানের সামনের ফুটপাতে বসে আজহার নেভি সিগারেট এ টান দেয়, আমি দেই মেরিস সিগারেট এ। অনেকক্ষণ ধরে সিগারেটের আগুন, ক্রম ক্ষয়িষ্ণু সিগারেটের সাদা কাগজ এবং তাৎক্ষণিকভাবে ঝেড়ে ফেলা ছাই এর ধুলো এর সাথে মিশে যাওয়া, এইসব দৃশ্যাবলী মুগ্ধ হয়ে দেখি আমরা দুজন। “সৌজন্য রক্ষা” বলে কিছু আমার আর আজহারের মধ্যে থাকার প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু, কেন জানি না আজহার নীরবতা ভেঙ্গে বলে – তুই মেরিস খাস ক্যান ? এই প্রশ্নটা আজহার এর আগে বহুবার করেছে, ঠিক তেমনি এই প্রশ্নের জবাব ও আমি এর আগে বহুবার দিয়েছি, এবং এই ব্যাপারটা আমি এবং আজহার দুজনেই খুব ভালোমত জানি। কিন্তু, আমি জবাব দেই, সেই জবাব যা আমি বছরের পর বছর দিয়ে আসছি – মেরিসের দাম কম, ১২ টাকায় ১০ টা, আর তাছাড়া অর্ধেক পর্যন্ত এইটা গোল্ড লিফের লাহান টেস্ট করে, তারপর গাঞ্জার লাহান। দুইটাই লাভের।

আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। সেই দীর্ঘশ্বাস কিছুটা লেপ্টে যায় রিক্সার টুং টাং বেলের মাঝে, কিছুটা যায় কালোকাচ লাগানো বিলাশী প্রাইভেট কারের টায়ারে, কিছুটা লেপ্টে যায় জম্বিদের মত দুলতে দুলতে পথে চলতে থাকা ভাসমান জনগোষ্ঠীর লাল-সাদা শার্টে, গোলাপী ওড়নায়। আমার মনে পড়ে, শৈশবে প্রতিদিন স্কুল শেষে যখন আমি বাসায় ফিরতাম, তখন বারান্দায় খবরের পত্রিকা হাতে, চেয়ারে সুপার গ্লু দিয়ে আটকে থাকা আব্বা নামক প্রাণিটি প্রতিদিন জিজ্ঞেস করতেন – কিরে, স্কুল কেমন হল ? জবাবে আমি নির্বিকার ভঙ্গীতে “ভালো” বলে অন্দরমহলে চলে যেতাম। প্রত্যেকদিন তিনি একই প্রশ্ন করতেন, তার আদর্শ সন্তান ও প্রতিদিন একই জবাব দিত। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, কোনদিন যদি আমি বলতাম “স্কুল ফাউল হইসে, আইজকা মাইর খাইসি।” তাহলে কী হত ? আব্বা কী আমায় আদর করে দিতেন ? কিংবা বলতেন – “কোন মাস্টার তোরে পিটাইসে, ক খালি।” কিংবা চিৎকার করতেন “ও গো শুনেছ, তোমার সুপত্র আজকে মার খেয়ে ফিরেছে। দুপুরে ওর আর কিছু খাওয়া লাগবে না, ওর পেট ভর্তি।” ?

আজহারের গতানুগতিক প্রশ্নে এরপর থেকে সেইরকমই কোন এক্সপেরিমেন্টাল উত্তর দেয়া টা ঠিক হবে কি হবে না ভাবতে গিয়ে আমার উপলব্ধি হয়, এর কোন দরকার নাই। যেমন চলছে চলুক। আর তাছাড়া, আমার ভিন্ন কোন জবাবে আজহারের কিছু যায় আসে না, যেমনটা যায় আসে না আমার, ভিন্ন জবাব পেয়ে আজহারের ভিন্ন কোন অভিব্যক্তিতে। সুতরাং, আমাদের মাঝে কথপকথন বাড়ে না, আমরা দুজন নির্বিকার ভাবে ঘোলাটে চোখ দিয়ে বিভিন্ন যানবাহনের ক্রমঘূর্ণায়মান চাকার কারণে রাস্তায় পরে থাকা পটেটো চিপসের মোড়কের নৃত্যের উদ্ভব ও বিকাশ দেখি আর যথাক্রমে মেরিস এবং নেভি খাই। আমাদের মনে পরে যায় গৌতম বুদ্ধের কথা। আমরাও তার মত, কিংবা অন্যভাবে বললে তিনিও আমাদের মত নির্বিকার ভাবে বসে থাকতেন, তার মৌনতা এবং এক আশ্চর্য ভঙ্গিমায় বসে থাকাকে বলা হয় ধ্যান। আমরা এবং আমাদের মত বিশেষভাবে বিষণ্ন মানুষ মাত্রই জানে, আমাদেরটাও এক প্রকারের ধ্যান। কিছুক্ষণের জন্য কিছু সৌভাগ্যবান মানুষ আমাদের ধ্যানের কিছু নমুনা দেখে। তারা বিষণ্ন হয়, কিন্তু বিষাদের আসল স্বাদ ভোগ করার আগেই তাদের মধ্যে কারো কারো মুঠোফোনে জরুরী কল আসে, কারো কারো ঘোর ভাঙ্গে হর্নের শব্দে। কারো কারো মনে পরে যায়, এই মুহূর্তে বাসায় না গেলে পারিবারিক অশান্তির সৃষ্টি হবে, কারো কারো মনে পরে যায় বাজার করার কথা। কারো কারো অদূরের পরীক্ষা তাকে পড়ার টেবিলে যাওয়ার জন্য তাগাদা দেয়, কেউ কেউ পাওনা টাকার জন্য দৌড় দেয়। কেউ কেউ পাওনা টাকা ফেরত না দেয়ার জন্য সরে পরে।মোদ্দা কথা, পলাশীতে দুটো ফসিল পরে থাকে, যাদের নাম যথাক্রমে রাসেল এবং আজহার, যারা যথাক্রমে মেরিস এবং নেভি সিগারেট খায় একটার পর একটা। আমাদের মধ্যে কেউ একজন, কে সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না, কারণ যে কথা আজ আমি বলি, কোন কোন দিন সেই কথাটাই আজহার বলে, যে কথাটা আজ আজহার বলে, অন্য আরেকদিন আমি সেই কথাটিই দাঁড়ি-কমাসহ বলি; মূলত মাঝে মাঝে আজহার আমার চরিত্রে অভিনয় করে আর আমি আজহারের চরিত্রে এবং সেটা আমাদের মনের অজান্তেই; সে যাই হোক, সেই কোন একজন বলে ওঠে

-দোস্ত, আমাদের তো এই সময়ে এইভাবে জন্মগ্রহণ করার কোন ইচ্ছা ছিল না। আমাদের উপর আমাদের জন্ম জোর করে চাইপ্যা দেয়া হইসে । এইটা টোটালি অন্যায়। তোর আর আমার, অর্থাৎ আমার আর তোর, আমাদের মধ্যে একজনের হওয়ার কথা ছিল মহীন, আরেকজনের হওয়ার কথা ছিল ঘোড়া। আমাদের দুজনের কার্তিকের জোৎস্নার প্রান্তরে অবাধ ছুটাছুটি করার কথা। সবুজ প্রান্তর, রূপালী জোৎস্না, সেখানে অনন্তকাল ধরে ছুটে চলা কালো ঘোড়া, চকচক করা তার রঙ, সেই ঘোড়ার পিঠে সোনালী রঙের মহীন, তুই কিংবা আমি, আমি কিংবা তুই, আমার পিঠে তুই, কিংবা তোর পিঠে আমি। এমনটাই তো হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু, আমরা কোথায়?

-অত আগে না হলেও চলতো। অন্তত, জীবনানন্দের আগে, বিষ্ণু দে এর আগে জন্মাইতাম। তাইলেই আর ঐ শালারা আমাদের কবিতা চুরি করতে পারতো না। যেই কবিতা আমাদের লেখার কথা ছিল, সেইসব কবিতা শুধুমাত্র আগে জন্মানোর সুবিধা নিয়ে বাইনচোদের দল লিখ্যা ফালাইসে । বাজারে ঐসব কবিতা ওদের নামেই চলে। অথচ, ঐ কবিতাগুলি শার্টের বাম পাশের বুকপকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াইতাসি আমরা জন্মলগ্ন থেকেই।


আমরা আবার ঝুপ করে চুপ হয়ে যাই। সন্ধ্যা সাতটার সান্ধ্যকালীন বিষণ্নতা আমাদের গ্রাস করে। আমাদের মধ্যে কেউ একজন বিষণ্ন এর সন্ধি বিচ্ছেদ করে এইভাবে - বিষ + অন্ন। আরেকজন গ্রাস শব্দটির সাথে গুন্টার গ্রাস এর নামের অনাকাংখিত সাদৃশ্য খুঁজে পায়। তারপর, আমরা দুজন হাসি, অট্টহাসি হাসি, ঠা ঠা করে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসি।

এইভাবে, সিগারেট খেতে খেতে, মিলন ভাইয়ের বানানো লাল এবং দুধ চা পর্যায়ক্রমে খেতে খেতে পলাশীর মোড়ে রাত নামে, জোৎস্নায় প্লাবিত হয়। সেই জোৎস্নায় শুধু আমরা দুজন ভিজে গোসল করে ফেলি। আরো অনেকক্ষণ পর আমাদের মধ্যে একজন বলে – দোস্ত, চল উঠি দোস্ত, কাইলকা সক্কালে নারায়ণগঞ্জ যাইতে হবে, ভোরবেলা রওনা দিমু।
-ক্যান? নারায়ণগঞ্জ যাবি ক্যান?
-আরে, আগের চাকরিটা থিকা তো আমারে ছাটাই কইরা দিসে, জানস বোধহয়। নারায়ণগঞ্জ এ একটা চাকরির সন্ধান পাইসি। ইন্টারভিউ দিতে যামু কাইলকা।
-হ, আমারো কাইলকা ভোরে বাইর হইতে হবে । সাভারে একটা কামের তদারকি করতে হবে ।

এইভাবে, কর্মব্যস্ততার কথা চিন্তা করে, কিংবা কর্মব্যস্ততা পাওয়ার আশায় আমরা আমাদের ধ্যান ভেঙ্গে ফেলি। পলাশীর ফুটপাতে নেভি আর মেরিসের কিছু ফিল্টারের পাশাপাশি আমাদের বিষণ্নতা পরে থাকে, মানুষের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়। প্রস্তর যুগ থেকে মহীনের ঘোড়াগুলি শুধু ঘাসই খায়, যোগ্য আরোহীর অভাবে তারা জোৎস্নার প্রান্তরে দৌড়াতে পারে না।

বিভিন্ন যানবাহনের ক্রমঘূর্ণায়মান চাকার কারণে রাস্তায় পরে থাকা পটেটো চিপসের মোড়কটি তখনো নৃত্যরত।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:৪৪
৩০টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×