somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুত্তা ( গল্প )

০৮ ই মার্চ, ২০১২ দুপুর ২:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কুত্তা


দরজাটা খুলতেই বাতাসের ঝাপটায় নাকটা কুঁচকে ওঠে । একটা আসটে আসটে পাশুটে গন্ধ সামনের খোলা নর্দমাটার দুর্গন্ধকে ছাপিয়ে ফজল মিয়ার নাকের মধ্যে ঢুকে যায় । বিরক্তি বিরক্তি । ফজল মিয়া বিরক্ত হয়ে ওঠে । কাল সারাটা রাতও কেটেছে বিরক্তিতে ।আর এই সক্কালবেলা যখোন মনটার ভেতর একটা বাসনা গুতোগুতি করতে থাকে, নড়াচড়া দিয়ে ওঠতে থাকে ভালো কিছু দেখার জন্যে অর্থাৎ সকালের প্রথম যাত্রাটা যাতে শুভ হয় এইরকম ভালো কিছু একটা দেখার আশায় প্রত্যাশিত হয়েছিলো মনটা, তখ্খনি এই ধাক্কাটা খেতে হয় তাকে । একটা বিরক্তি । কাল রাতের বিরক্তিটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এই নতুন বিরক্তিটার উপর ঝাল ঝাড়তে চায় যেন । ফুঁসে ওঠে ফজল মিয়া,
‘হালা কুত্তার বাচ্চা, মরনের আর জায়গা পাওনা । মাঙ্গের পুত, আবারো এহানে আইছো মরতে !’
বলতে বলতে ঘুমঘুম চোখে সজোরে একটা লাথি হাকায় শুণ্যে । লাথিটা কোথায় গিয়ে লাগে বোঝা যায়না ।

যাকে নিয়ে এই খিস্তির শুরু সে ততোক্ষনে দরজা খোলার শব্দে ঘাড়টা উঁচু করে তাকিয়ে ছিলো মাত্র । সজোর লাথিটা খেয়ে সারমেয় গোত্রের নিদারুন পরাজয়ের পরিচিত নিনাদে কেঁউ-কেঁউ করে ওঠে মাত্র, সরে যায়না । যেন কিছু হয়নি এমোন একটা ভাব নিয়ে আবার নিশ্চিন্তে গা’টা এলিয়ে দিয়ে সামনের দু’পায়ের ফাঁকে মাথাটা রেখে পিটপিট করে ফজল মিয়াকে দেখতে থাকে ।
ভাবতে চেষ্টা করে ফজলু - ফজল মিয়া, যে এখানে এই ফজলু নামেই পরিচিত দশজনার কাছে । উঁচুতলার গন্যমান্য কেউ নয় তারা । আধা বস্তি এলাকার বাসিন্দা সব । ফজল মিয়া ওরফে ফজলুর প্রতিবেশী, ইয়ার-দোস্ত আর সাগরেদ । ভাবতে চেষ্টা করে মাথাটা খারাপ হয়ে যায়নি তো এই সাত সকালে ! বাতাস দিচ্ছে জোরে । দেবেই তো । এই বৈশাখের মাঝামাঝিতে দিনগুলো যেন তার মেজাজের মতোই মুখিয়ে থাকে । ভদ্দর লোকেরা বলে কাল-বোশেখী । কেমন যেন একটা ভয় মেশানো অনুভুতি । কখন যে কি হয় । কার ঘর উড়িয়ে নিয়ে যায় কে জানে । এই সুন্দর ফুটফুটে হাসিখুসি রোদ্দুর তো এই আকাশ কালো করে অভিমানী মেয়ের মতো মুখ গোমড়া হয়ে বসে থাকা । হঠাৎ হঠাৎ পিলে চমকানো বিজলীর তরবারী দিয়ে ফালাফালা করে দেয়া আকাশের আঙ্গিনা, সাঁই সাঁই বাতাস । আবার এক এক দিন সমুদ্দুরের মতো শান্ত – গভীর উজ্জল নীলাকাশ ।ঠিক যেন তার জীবনের মতো , এই আলো তো এই আঁধার । বায়স্কোপের মতো গড়গড়িয়ে ভাবনাগুলো এগুতে থাকে তার মাথার ভেতর ।
কতোদিন, কতোদিন হ’লো এই নিয়ে ! পাঁচ মাস – ছয় মাস ! নাকি তারও বেশী ! খোলা দরজার সামনে একচিলতে বারান্দার উপর শুয়ে থাকা কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আনমনে হিসাব করতে চেষ্টা করে সে । নাহ্ ভাবা যায় না । এ নিয়ে ভাবার কি আছে ! যা গেছে তাতো গেছেই । ভাবলেই কি সেটা আবার ফিরে আসবে ! কুকুরটার পাঁজরায় আরো একটা লাথি কষে বিড়বিড় করে ওঠে – ‘মাগীর বাচ্চা….’ । কুকুরটা অবাক হয় একটু । কেঁউ-কেঁউ করে একটু প্রতিবাদও করে আগের মতো কিন্তু সরে যায়না । কুঁতকুঁতে চোখ নিয়ে ঘাড়টা কাত করে দেখতে থাকে, বুঝতে চেষ্টা করে যেন ফজল মিয়াকেই ।

বৈশাখের মাঝামাঝি এখোন । হঠাৎ হঠাৎ একপশলা-দো’পশলা বৃষ্টির অত্যাচারে সামনের রাস্তা নামের একফালি জায়গাটুকু কাদা কাদা হয়ে আছে । সকালের আলোটুকুও পুরোমাত্রায় ফোঁটেনি এখোনো । এসময়ে ঘুম ভাঙ্গায় অভ্যস্ত নয় সে । চারদিকে কোথাও কোথাও ছোঁপ ছোঁপ অন্ধকার । আকাশটা লাল হয়ে উঠেছে ঠিকই কিন্তু সে পরিমান আলো আশেপাশের সেঁটে থাকা ঘরবাড়ীগুলোর ছাদ মাথা ডিঙ্গিয়ে তার ঘরে ঢুকতে সাহস পায়নি এখোনো । ঘুম ঘুম চোখে গুম হয়ে বসে থাকে সে । মনে মনে কি যেন বিড়বিড় করতে থাকে বোঝা যায়না । আধখোলা চোখের ফাঁকে কি যে সে ধরতে চাইছে নিজেই বুঝে উঠতে পারেনা । একটা আধা ঝুপড়ি মতো ঘর তার । মাথার উপরে টিনের ছাউনী, দরমার বেড়া খবরের কাগজ আর সিনেমার বড় বড় পোষ্টার দিয়ে ঢেকে দেয়া । মাটির মেঝে । সস্তা আমকাঠের একটা খাট, একটু বাহারী ।এখানে একটা চারপায়া ছিলো আগে, চটের দড়িতে বোনা । সেটা বাতিল হয়েছে । খাটের এক কোনায় চুপচাপ বসে থাকে ফজল মিয়া । একটু ঘ্রান নিতে চেষ্টা করে বাতাসে । বাইরে বৈশাখী পৃথিবী আর এই আধাবস্তির তেল-ঘাম-পেয়াজ-রসুন, নর্দমার গন্ধ সব মিলিয়ে ঘরের গন্ধটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা সে । তবুও একটা অল্প পরিচিত গন্ধ খোঁজার চেষ্টা করে ফজল মিয়া । না নেই । সেই গন্ধটা আর খুঁজে পায়না সে । একটু একটু করে রাগ চড়তে থাকে তার নিজের ভেতর । ছোবল মারার আগ মূহুর্তে সাপ যেমন করে ফুঁসে ফুঁসে শরীরের কুন্ডলী ছাড়াতে থাকে তেমনি করেই ভেতরের পাক খুলতে খুলতে ফোঁস ফোঁস করে ওঠে তার শরীর । তার নিজের উপর জমে থাকা রাগ একটু একটু করে তার সারা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে থাকে । হাত-পা নড়েচড়ে ওঠে, চোয়াল শক্ত হয়ে যায় । আধঘুম চোখ আগুনের হল্কা ফুটিয়ে লাল হয়ে থাকে । দরমার বেড়ার সাথে ঝোলানো দড়ির আলনায় রাখা কাপড় চোপড়ের উপর দৃষ্টিটা স্থির হয় তার ।
সে নয়, দড়ির আলনার ভেতর থেকে একটা রংচটা ব্লাউজ যেন তাকে তারিয়ে তারিয়ে দেখছে ।আরও একটা কি যেন, ঠিক ঠিক নাম জানেনা সে । তার অশিক্ষিত, অমার্জিত ভাষায় দুধ-ব্লাউজ নামের সেই একফালি ন্যাকড়ার মতো ময়লা জিনিষটাও আলনার কাপড়গুলোর ভেতর মুখটাকে ঢেকে যেন তার দিকে চেয়ে থাকে জুলুজুলু চোখে । হাসে খিকখিক করে, যেন বিদ্রুপের হাসি । পিত্ত জ্বলে যায় তার । এই এতোক্ষনে নিজের রাগটাকে ঝেড়ে দেয়ার মোক্ষম একটা অস্ত্র পেয়েছে সে । দস্যুর মতো ঝটিতি আলনার উপর থেকে ছিনিয়ে নেয় জিনিষদু’টো । দলা পাকায় আর সজোরে ছুড়ে দেয় বাইরের আলো অন্ধকারে, তার জীবনের সব ঘৃনা আর ধিক্কার একসাথে মিশিয়ে – ছেনাল মাগী … বেশ্যা ।
আর তখোনই ঘেউ ঘেউ করে ওঠে কুকুরটা । ফজল মিয়ার বুকের কোথাও যেন আর একটা মানুষ কেঁউ কেঁউ করে কেঁদে ওঠে তখোন ।

বেশ ভালোই যা্চ্ছিলো তার দিনকাল । কেন যে আব্বাস আলীর কথায় ওই কাজটা করতে গিয়েছিলো সে ! রাস্তার মোড়ে পান-বিড়ি আর সামান্য মুদির দোকান এর কাজে সে তো বেশ মানিয়ে নিয়েছিলো জীবনটাকে । নিজের সামান্য ব্যবসা, কোনও শরীক নেই । রোজগারপাতিতে তার একার জীবন কেটে যাচ্ছিলো তো কোনও না কোনও ভাবে । সেই দুপুরে ঘরে ফেরা । উনুন জ্বালিয়ে ভাত-সালুন রান্না । একফাঁকে স্নান । তারপরে খেয়েদেয়ে এটো-ঝুটো আধপোষা দেশী কুত্তাটাকে ছুড়ে দিয়ে ভাতঘুম একটানা । বিকেলে আবার দোকান খোলা । রাতে অনেক দেরী করে ফেরা । তখোন কুকুরটা ঘেউঘেউ করে উঠেও পরিচিত একটা গন্ধ পেয়ে থেমে যেত । তার ফেলে যাওয়া পদচিহ্ন শুকে শুকে যেন তৃপ্তির একটা নিঃশ্বাস পড়তো কুকুরটার । ফজল মিয়া মনে মনে ভেবেছে, বিনে পয়সার পাহাড়াদার । কতোদিন ফজল মিয়া ওটাকে ঠেঙ্গিয়েছে, লাঠিপেটা করে তাড়াতে চেয়েছে প্রথম প্রথম । তবুও ঘুরে ফিরে কুকুরটা আবার ফিরে এসেছে । প্রথম প্রথম রাগ থাকলেও এটো খাবারদাবারটা কিন্তু ঠিকই ছুড়ে দিয়েছে কুকুরটাকে । আবার রাতবিরেতে ঘেউঘেউ করে যখোন তার আয়েশের ঘুমটার বারোটা বাজিয়েছে তখোনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে – ‘হালার পুতেরে কাইল ই লরামু’ ।

‘য্যামোন তুমি হ্যামোন তোমার কুত্তাডা । হারাদিন ক্যাবোল কুত্তাডার লাহান ছোক ছোক করো । কুত্তার লাহান এ্যামোন ছুক্ ছুক্ মোর ভাল্লাগেনা ।’ এসব কথা তার নববিবাহিত বউ বলেছিলো তাকে অনেকবার । আর তখোনি রাজ্যের যতো রাগ গিয়ে পড়েছিলো ঐ কুকুরটার উপর ।
এসব কথা ভাবতে গিয়ে সদ্য পুরোনো স্মৃতির ধারালো করাতখানা যেন তাকে ফালাফালা করতে থাকে । রক্ত নয়, বটের আঠার মতো গাঢ় কষ্ট আর দুঃখের স্রোত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে থাকে তার বুকের কলস থেকে । তার বউ – নববিবাহিত বধু, একটা চটকওয়ালা শরীর, টানটান কালো চামড়া, মেদহীন কোমর – ভারী নিতম্ব, আটোসাটো ব্লাউজ গা’য়ে দেয়া সেই বউ আরো কতো কথাই তো তাকে শুনিয়েছে ।
- ভদ্দরলোহে কুত্তা পালেনা । যাগো সবাব কুত্তার লাহান গু-মুত খাওয়া হ্যারাই কুত্তা পালে । আমার কফালে এইডাই আছিলো, তোমার লাহান একটা কেডী কুত্তার লগে মোর বিয়া অইছে ।

জীবন এক এক সময় রঙীন হয় । কোথা থেকে যে সে রঙ আসে আগেভাগে বোঝা যায় কি ! ফজল মিয়াও বুঝতে পারেনা , কেবল ভেসে যায় তার তোড়ে । ভাসতে ভাসতে কোন অচিনদেশে গিয়ে ঠেকে তার নাও । আব্বাস আলীই ভাসায় তাকে ।
-দ্যাহো ফজলু মিয়া, কতোদিন তোমারে কইছি একটা বিয়াশাদী করো । জুয়ান মানুষ কদ্দিন একলা একলা থাকপা ।
উত্তরে হেসেছে ফজল মিয়া । কিন্তু ঐ যে, সবকিছুরই বোধহয় একটা অমোঘ নিয়তি থাকে । নইলে পাহাড়ী ঝর্ণা কেন নদী হ’য়ে ওঠে ! নদী যদিও বা হয় তবে বন্যায় দু’কুল ভাসায় কেন ! নাগিনীর মতো ফুঁসে ওঠে কেন । অমোঘ নিয়তি ফজল মিয়াকে হয়তো সেদিকেই টেনেছিলো । আব্বাস আলীর ছুঁড়ে দেয়া কথাটা তার ভেতর ধীরে ধীরে ফেনিয়ে উঠতে থাকে । একটা মেয়ে মানুষ । একান্ত ভাবে তার । যে তার রান্না করবে, তাকে খাওয়াবে- যত্ন করবে ।আর .. আর রাত্তিরে তার তপ্ত শরীরের আগুনকে আর একটা নরোম শরীরের আবরনে ঢেকে শীতল করে দেবে । এসব স্বপ্নের মতো কথাগুলো একসময় তার ভেতর ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে । আর তাতেই একসময় বাণ ডাকে । ভেসে যায় ফজল মিয়া ।
হ্যা, মোমেনাকে আব্বাস আলীর কথাতেই বিয়ে করেছিলো সে । আব্বাস আলীই যোগাযোগটা ঘটিয়ে দিয়েছিলো । নইলে এই আটত্রিশ বছরের আধবুড়ো ফজল মিয়া নধর, কঁচি - টস্টসে জামের মতো মোমেনার উনিশ বছরের শরীরটার আইনগত মালিক হ’তে পারতোনা ।
‘মালিক’, ফজল মিয়ার এখোন হাসি পায় কথাটা ভেবে । কতোদিন ? কতোদিন ? দু’মাস – আড়াই মাস নাকি আরো বেশী ? অল্প সময়, অথচ ফজল মিয়ার মনে হয় সেই অল্প সময়টাই তার বুকে হাযার বছর হ’য়ে মুদির দোকানের পাঁচ-সেরী বাটখাড়ার মতো ভারী হ’য়ে চেপে বসে আছে ।

নতুন বৌকে নিয়ে তার ঘরের রোয়াকে উঠতেই কোথ্থেকে ছুটে এসে কুকুরটা ঘেউঘেউ করে উঠেছিলো একটানা ।পছন্দ হয়নি হয়তো এমোন নতুন আগন্তুককে । চমকে গিয়ে আর ভয়ে আৎকে উঠে নতুন বৌ কোথায় ফজল মিয়ার গা’য়ের মধ্যে সেঁধিয়ে যাবে তা নয়, বরং চোখ বড়বড় করে বলে উঠেছিলো – ওম..মাঃ মাইনষে এমোন কেডিকুত্তাও পালে !
একটু বোকা বোকা হেসে জবাব দিয়েছিলো ফজলমিয়া -
- ‘ওডা আমি পালি না । অনেকদিন থ্যাকক্কিয়াই ওডা এহানে আছে । কদ্দিন লড়াইছি হালায় যায় নাই । ভয় নাই তোমার, তোমারে কামড়াইবেনা । ঘরে তো আর মানুষ নাই । কুত্তডায় ই পাহারা-টাহারা দেয় । এহোন তো ঘরে আরো জিনিষপত্তর আইছে, আরো আইবে । চোরচাট্টা আইতে পারবেনা কুত্তাডা থাকলে ।’
মুখে বললেও বোঝে ফজল মিয়া কুকুরটাকে তাড়ানো দরকার । তার ঘরের এই নতুন মনিবের পছন্দ নয় কুকুরটা । আর কুকুরটাও বোধহয় তাই । নতুন অংশীদার তারও পছন্দ নয় ।সমানে ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে গলা ফাটিয়ে । অগত্যা কুকুরটাকে হটাতে হয়, এই ভাগ্ ভাগ্ হারামজাদা ।
এখোন বোঝে ফজলমিয়া, ইতর প্রানীগুলিও মানুষের মনের গন্ধ শুকে শুকে ঠিকঠিক চিনে নিতে পারে মানুষটাকে এক লহমায় । কেবল মানুষ নামের বুদ্ধিমান প্রানীটিই কেবল নিজেদের প্রজাতির রং-গন্ধ চিনে উঠতে পারলোনা ।

প্রথম রাতে মোমেনার শরীরে হাত রেখে কতো স্বপ্নই তো সে দেখেছিলো সেদিন । দুজন মানুষের সংসার । তার একার সংসারের আগোছালোতা এবার একটি কোমল মমতাময়ী হাতের স্পর্শে গোছালো হয়ে উঠবে । শ্রী ফুটফুট করে উঠতে থাকবে চারদিকে । হোক সে পান-বিড়ি আর মুদী দোকানের মালিক, বউকে সে রাজার হালেই রাখবে । রেখেওছিলো । তিনদিনের দিন কুকুরটাকে লাঠিপেটা করে তাড়িয়েছিলো কারন-অকারনেই মোমেনাকে তেড়ে আসতো বলে । মোমেনাকে পাউডার কিনে দিয়েছিলো । দিয়েছিলো স্নো-আলতা, চুল বাধার রঙীন ফিতে, বাহারী স্যান্ডেল, জাফরী কাটা দুধ-ব্লাউজ না কি যেন । সময়ে অসময়ে দোকান বন্ধ করে প্রায়ই সিনেমায় নিয়ে যেতো ।নিয়ে যেতো এখানে সেখানে । সংসারের কাজের চেয়ে বাইরে বাইরে ঘুরতেই যেন মোমেনা আনন্দ পেতো বেশী । না্, নরম হাতে নয় একটা শক্ত হাতেই যেন পড়েছিলো ফজল মিয়া । রাশটানা ঘোড়ার মতো তেজী তার বৌ । গোলাপ নয়, মহুয়া ফুলের মাদকতা ছিলো তার ঠমকে গমকে । আর তাতেই মজেছিলো ফজল মিয়া । ইয়ার বন্ধু নিয়ে মাঝেমাঝেই খানাপিনার আসর বসতো ফজল মিয়ার একদা নিরব নিথর ঘরে । একটা মৌ মৌ জীবনের ছোয়া যেন একটানে তার যাপিত নিরানন্দ দিনরাতগুলোকে হিরন্ময় ভোরের আলোতে টেনে নিয়ে গেছিলো ।
আব্বাস আলীও থাকতো সে দলে, এমোনকি মাঝেসাঝে একাও । যদিও বয়সে আব্বাস আলী তার ছোট তবুও একই অঞ্চলে বাড়ী বলে একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো । সমবয়সী বন্ধুর মতো । ঘটনা এমোন দাঁড়িয়েছিলো যে সন্ধ্যে হলে দোকানের ঝাপ আর খুলতোনা ফজল মিয়া । নতুন বৌয়ের জন্যে এটা-সেটা নিয়ে ঘরে ফিরতো । দেখতো আব্বাস আলী বসে আছে ।
- দোস্ত তোমার লইগ্গাই বইয়া রইছি । এতো দেরী কইররা আইছো যে !
তারপরেই আড্ডাটা জমে উঠতো । ফজল মিয়ার আটত্রিশ বছরের রক্তে আঠারো বছরের বান ডাকতো ।
‘ভাবীসাবের খুব রস আছে । আমারে কয় বয়েন বয়েন, আমনহের দোস্তে যাইবে কই ? ঘরে মধু থুইয়া ভোমরা কি হারাদিন বাইরে থাকতে পারে । এইতো আইয়া পরলো বুইল্লা । ওডেন কই ?’ ফিচকে হাসে আব্বাস আলী ।
দোস্তের কথায় মোনটা খুশি হয়ে ওঠে ফজল মিয়ার । শরীরের মতো মোনেও রস আছে তাহলে মোমেনার ! এর হদিস তো তার জানা ছিলোনা । যখোনই ভালোলাগার তাগিদে একটু আধটু ছুঁতে চেয়েছে মোমেনাকে তখোনই রাইফেলের মতো গর্জে উঠেছে তার বৌ, ‘ কুত্তার লাহান ছুক ছুক করো ক্যা ? মোর ভাল্লাগেনা ।’
এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেছে ফজলমিয়া ।
আবার নিজেকেই শ্বান্তনা দিয়েছে, অল্প বয়স বউডার। দোষটাতো আমারই ।এত্তো জ্বালাতোন করলে হে তো রাগ অইতেই পারে ।
এখোন আব্বাস আলীর কথা শুনে মোনটা তার ঘুড়ির মতো লাট খেতে থাকে আকাশে, ফড়ফড় করে উড়তে থাকে ।
এভাবেই চলছিলো মাসখানেক । কি সুন্দর ছিলো দিনগুলো । তার দোকানে রাখা খেজুর গুড়ের মতো ঝাঁঝালো মিষ্টি এক একটা দিন । সেটাকে একটু গুটিয়ে রাখতে হলো । দোকান তো আর দীর্ঘদিন এই আধবেলা খোলা তো ওই আধবেলা বন্ধ রাখা যায় না । জীবন যেখানে সম্বল করা তার উপরে । ফলে মোমেনার নিত্যনতুন চাহিদা আর সংসারের খাই মেটাতে দিনরাত দোকান খুলে বসতেই হয় ফজল মিয়াকে । ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা বারোটা বেজে যায় কোনও কোনও দিন । দুঃশ্চিন্তা হয় তার মোমেনা একা আছে বলে । ইতিমধ্যে কুকুরটা ফিরে এসেছে বলে কিছুটা স্বস্তি পায় ফজল মিয়া । মোমেনাকে একা একা থাকতে হবেনা ভেবে । অন্তত কুকুরটা তো পাহারাদারের কাজটি করতে পারবে । দিনকাল যা পড়েছে তাতে মানুষকে আর বিশ্বাস কি। কতো লোক কতো মতলবেই যে ঘোরে । হঠাৎ কোনদিন যদি মোমেনাকে একা পেয়ে কেউ একটা অঘটন ঘটিয়ে বসে ! আর কিছু না হোক নিদেন পক্ষে চুরী-চামারী ও তো হতে পারে । নাহ্, শুধু কুকুরটার উপর ভরসা করা যায়না । আব্বাস আলীকে বলা দরকার সে যেন সন্ধ্যেবেলা তার ভাবীর একটু খোঁজখবর নিয়ে যায় ।
না, আব্বাস আলীকে বলতে হয়নি । যথারীতি সে ই প্রতিদিন হাজির হয়েছে সন্ধ্যের আগে আগে । দোকানে গিয়ে গোটাদুই তিলাপাতি জর্দা দেয়া পান মুখে দিয়ে শুধিয়েছে, যাই দোস্ত ভাবীসাবে একলা বাসায় । ভয়টয় পাইতে পারে । এট্টু খোঁজ নিয়া যাই ।তুমি তড়াতড়ি আইও ।
হ্যা, তার কদিন পর সে তাড়াতাড়িই বাড়ী ফিরেছে । তার মোন যতোটাই খুশি হয়ে উঠেছিলো আব্বাস আলীর প্রতি ঠিক ততোটাই কু’ও গাইছিলো । গাইবেই বা না কেন ? আজকাল আব্বাস আলী ফুরফুরে জামা গা’য়ে দেয় । একটু পাউডার কিম্বা আঁতরের গন্ধও আসে প্রতিদিন তার গা থেকে । তার উপর তার কথা বলার ঢংটাও পাল্টে গেছে কেমন যেন – তোমার তো যাইতে দেরী অইবে ফজলু মিয়া, যাই আমিই ভাবীর খবরডা লইয়া আই ।
তারপর থেকেই ফজল মিয়া অসময়ে দোকানের ঝাঁপ ফেলে বাড়ীতে ফিরেছে । দেখেছে মোমেনা আর আব্বাস আলী হেসে হেসে কথা বলছে । আর রোয়াকের সামনে দু’পা ছড়িয়ে মাথাটা তুলে ঘেয়ো কুকুরটা মাঝেমাঝেই চীৎকার করে উঠছে । তারপর ফজল মিয়াকে দেখে থেমেছে । মাথাটা নামিয়ে দিয়েছে ছড়ানো পায়ের উপর যেন নিশ্চিন্ত হওয়া গেল এবার ।

সূর্যটা উঠে গেছে অনেকখানি । ঠায় বিছানাতে বসেই থাকে সে । এতোক্ষনে তার ভেতরে কিছু একটা যেন পাক দিয়ে উঠতে থাকে । হরহর করে পেট ঠেলে বমি আসে তার, ভাসিয়ে দেয় মেঝেটা তীব্র কটু গন্ধে । যা কিছু ছিলো পেটে সব যেন উগড়ে দেয় সে । অনেকদিন আগে মোমেনার হাতে রান্না করা খাবারের অবশিষ্টাংশটুকুও যেন বেরিয়ে যেতে থাকে হেচকি টানে । ভালো, মোমেনার কোন চিহ্ন না থাকাই ভালো তার শরীরে কিম্বা জীবনে । তবুও বসে থাকে সে নোংরা শরীর নিয়ে ।শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে খানিক আগের জমে থাকা রাগের বেলুনটা কে যেন ফুটো করে দিয়েছে । স্থির বসে থাকে ফজল মিয়া । এতোক্ষন কিছুই দেখছিলোনা সে, এবার চোখ তুলে খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে কুকুরটাকে দেখতে থাকে আনমনে । কুকুরটাও যেন বুঝে গেছে কিছু এমন মনে হয় । তার অবলা চোখ দুটো সোজা ফজল মিয়ার চোখের মধ্যে ঢুকে যায় ।

‘বেডা বুড়া ভাম । বিয়া করছো বুল্লাই কি আমি তোমার কেনা গোলাম অইছি ? আমি আব্বাস বাইর লগে কতা কমু-হাসমু, পান খামু হেতে তোমার কি ? তোমার কাম কুত্তা পালনের ,মাইয়া মানুষ না ।’ মোমেনার পানে লাল হওয়া ঠোট আর শানিত জিহ্বা নড়েচড়ে যে বিষ উগড়ে দিয়েছিলো তা ফজল মিয়ার ফুলে থাকা নীল নীল শিরার ভেতর ঢুকে গিয়ে বুকের কাছের সচল যন্ত্রটায় ধুক্পুক্ আওয়াজ তুলেছিলো জোরেশোরে । এখোনও হয়তো কান পাতলে শোনা যায় তার আওয়াজ ।

স্বপ্নের গোছালো মুদীর দোকানের গুড়ের জালায় পিলপিল করে ঘাতক পিপড়েরা উঠতে থাকে । এই নিড়ম্বু উপবাসী জীবনে তার স্নেহ-ভালোবাসার গুড়, লাভের পিপড়েরা কুরে কুরে খেয়ে যেতে থাকে ক্রমাগত । ভেবে ভেবে কুল পায়না ফজল মিয়া, মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভেতরে এতো ক্লেদ আর ঘৃনা জমা হয় কোথ্থেকে! একই ছাদের নীচে থেকে, আইনের চোখে পরষ্পরের পরিপূরক হয়েও এতো অবিশ্বস্ততা কেন ! কই, ফজল মিয়া তো কোনদিন কাউকেই মালের ওজনে কম দেয়নি । ঠেকিয়ে বাড়তি দাম আদায় করেনি সুযোগ বুঝে ।নিজের পেশায় তো সে সৎ আর বিশ্বস্তই থেকেছে । অথচ তার ঘরের মানুষটা্ এরকম অবিশ্বস্ত হয়ে উঠলো কেন, বুঝে উঠতে পারেনা ফজল মিয়া । হতে পারে একটু বয়স হয়েছে তার । সে তো আর বাইরের কোনও খরিদ্দার নয় যে সুযোগ বুঝে ঠকিয়ে নিলেই হলো । আল্লা-খোদা স্বাক্ষী রেখে কলেমা পড়েই তো তাদের শাদী হয়েছে । তা না হোক একঘরে, একই বিছানাতে সাত আটটা মাসের মতো তো কাটিয়েছে দুজনে । একটা ইতর প্রানীও তো কাছে কাছে কদিন ঘুরঘুর করলে মানুষের একটা মায়া পরে যায় ।আর সে তো আল্লা খোদা স্বাক্ষী রাখা স্বামী । তার উপর এতোটুকুও মায়া হলোনা তার স্ত্রীর ! কে জানে, কে কাকে কখোন কেন পছন্দ করে, আবার কেনই বা ঘৃণা করে !

উঠে দাঁড়ায় সে এতোক্ষনে । আঁতিপাতি করে খোঁজে একটা কিছু যেন এদিক সেদিক । নাহ্ আর কোনও চিহ্ন নেই মোমেনার এখানে।একটা দয়ামায়াহীন, অকৃতজ্ঞ মেয়েমানুষের কোনও চিহ্ন না থাকাই ভালো তার জীবনে। একটা অবোধ কুকুরও তো কৃতজ্ঞতা-ভালোবাসা বুঝে গেছে ঠিক । বারবার লাঠিপেটা করে তাড়ালেও কিসের টানে যেন প্রতিবারই ফিরে এসেছে এই নোংরা গন্ধময় পরিবেশে, চালচুলোহীন ফজল মিয়ার কাছে ।

আর মানুষের কাছে নয়, একটা ঘেয়ো শুকনো রাস্তার কুকুরের কাছেই ভালোবাসা আর বিশ্বস্ততা চাইলো সে এতোক্ষনে –
‘ আয় আয় তুঃ তুঃ তুঃ…. ’








সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১২ দুপুর ২:৪২
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে দেখা - ১৩ মে

লিখেছেন জোবাইর, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:০৩

১৩ মে ২০০৬


দমননীতির অদ্ভুত কৌশল
সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের ওপর দমন নীতির আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুত বিচার আইন ও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×