হুমায়ুন আজাদ স্যার একবার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন "আমি যেই বক্তব্য দেই, সেটি দেখেই অনেকেই আমাকে সাহসী বলেন। করতালি দেন। আমি যেই বই লিখি তা পড়েও আমাকে সবাই সাহসী বলে থাকেন। আমাকে বীরোচিত বলে আখ্যা দেন। অথচ এই ব্যাপারটি আমাকে অত্যন্ত পীড়া দেয়। যে কথা গুলো বলাটাই একটা সভ্য সমাজের স্বাভাবিক রীতি হবার কথা ছিলো, এই দেশে সেটি বলতে পারাটাই একটা সাহসী কর্ম। বীরোচিত সংবর্ধনার ঘটনা"
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যে পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের সহায়ক শক্তিরা আমাদের দেশের সাধারন মুক্তিকামী মানুষের উপর যেই অত্যাচার আর নির্যাতন চালিয়েছে তা ইতিহাসের পাতায় এক বর্বরতম অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এই হত্যাকান্ডে ৩০ লক্ষ কিংবা তারো বেশী মানুষ নিহত হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের বেশীর ভাগ পরিবার-ই কাউকে না কাউকে হারিয়েছেন আমাদের এই মুক্তির সংগ্রামে। আমরা এমনই এক ত্যাগ আর রক্তের মিছিলে গড়া জাতি যে জাতির রক্তে রক্তে সেই কষ্ট প্রতি নিয়ত আমাদের অনুরণিত করে।
কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে ১৯৭১ সালের এই অপরাধের সাথে যারা যারা জড়িত ছিলো তাদের বিচার কখনই সফল ভাবে শুরু কিংবা শেষ হতে পারেনি বাংলাদেশে। ১৯৭২ সালে একবার দালাল আইনের মাধ্যমে বিচার শুরু হলেও ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে তা নষ্যাৎ হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘ পথ পরিক্রমা। মাঝে মধ্যে ১৯৮১ সালে কাজী নুরুজ্জামানের বিচ্ছিন কিছু আন্দোলোন, ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ঘাতক দালাল নির্মূলের আন্দোলন ছিলো উল্লেখ করবার মত।
২০০৭ সালে তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের যে দাবী উঠেছিলো তা পরিপূর্ণ ভাবে আওয়ামীলীগের মেনিফেস্টোতে উঠে আসে এবং তারা ক্ষমতায় এসে বিচারের উদ্যোগ গ্রহন করে ২০০৯ সালে। ২০১০ সালের ২৫ শে মার্চ ট্রাইবুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিচারের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। আর যে আইনের মাধ্যমে এই সকল অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার হচ্ছে সেটির নাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালস আইন-১৯৭৩, যেই আইনের বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ এনে এই পর্যন্ত ৮ জন ব্যাক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে ও তাদের বিচার চলছে। এরা হচ্ছে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা, আব্দুল আলীম ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।
বিচার শুরু হবার আগের থেকেই এই ধৃত ব্যাক্তিদের দল জামায়াতে ইসলামী ও বি এনপির এক্টিভিস্টরা মাঠে নামে এবং শুরু করে প্রোপাগান্ডা। তাদের হেড অফিস থেকে বড় বড় চাঁইয়েরা শুরু করে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং বহির্বিশ্বে এই আইন নিয়ে, এই বিচার নিয়ে তথা বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যে প্রচারণা ও প্রোপাগান্ডা। স্বাভাবিক ভাবেই একজন সাধারন নাগরিক হিসেবে আমি চাই এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক এবং তা খুব দ্রুত হোক। আমি ৩০ লক্ষ স্বজন নিহত করবার বিচার চাই। এই ৩০ লক্ষ নিহত মানুষের একজন আমার চাচা, কিন্তু বাকি ২৯ লক্ষ ৯৯৯ জন বা তারো বেশী মুক্তিকামী মানুষও আমার আপন জন। আমি বুকের ভেতর থেকে অনুভব করি সেই হত্যার মিছিলে আমার মা’কে, বোনকে, ভাইকে, বাবাকে। জন্মের পর থেকেই আমি এই অনুভূতির সাথে ও সত্যর সাথে লালিত হয়েছি। আমার পরিবার আমাকে সে শিক্ষাই দিয়েছে। আমার বাবা আমাকে সেই ছোটবেলাতেই রাজাকার-আলবদরদের ভূমিকার কথা বলেছে, বলেছে পাকিস্তানী হানাদারদের নৃশংস হত্যাকান্ডের কথা।
এই বিচার করা ছিলো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কেননা অপরাধ হয়েছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের নাগরিকের বিরুদ্ধে। যে মানুষরূপী পশুগুলোর কারনে আমরা আমাদের আপনজন হারিয়েছি সেই পশুদের বিচার করবে রাষ্ট্র তথা যেই সরকার ক্ষমতায় থাকবে তারা। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটা হয়নি কোনো সরকারের আমলেই। অথচ একজন সাধারন নাগরিক হিসেবে এই দাবিটি আমাদের সেই ৪১ বছরের পুরোনো। যে সরকার এই বিচার করবে আমরা সাধারণত তাকেই এই বিচার এগিয়ে নিতে সাহায্য করব, এটি বলা বাহুল্য। যদিও এই “যারাই বিচার করবে” এই তালিকায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই জামাত বাদ। কারন তারাই মূল আসামী। কিন্তু বি এনপি ও জাতীয় পার্টি বরাবরই এই বিচার এড়িয়ে গিয়েছে এবং রাজাকারদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর সাম্প্রতিক কালে তো খালেদা জিয়া বলেই দিয়েছেন যে যাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা নির্দোশ। সুতরাং হাতের পাঁচ বলতে বাকি থাকে আওয়ামীলীগ।
অনেকেই বলেন আওয়ামীলীগ বিচারের কথা বলে মুলো ঝুলিয়ে রাখে। আমি আগে এই বিশ্বাস স্থাপন করলেও এখন আর সেটি করতে রাজী নই। কেননা পৃথিবীর ইতিহাসে আমাদের ট্রাইবুনালই একমাত্র ট্রাইবুনাল যেটি অপরাধ সংগঠনের প্রায় ৪১ বছর পরে বিচার শুরু করে এত দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেছে। একজন আইনজীবি হিসেবে আমি এর লিগাল টার্ম, প্রসিজিওর, সব কিছু বিবেচনা করেই কথাগুলো বললাম। আমি পৃথিবীর অন্যান্য আইন ও বিচার প্রকিয়াও পর্যালোচনা করে দেখেছি।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই মুহূর্তে আমাকে বা আমাদের মত যারা এই বিচার সমর্থন করেন এবং এই বিচারের পক্ষে যারা কাজ করছেন, ক্যাম্পেইন করছেন তাদের সকলকেই প্রতিনিয়ত শুনতে হচ্ছে আমরা সবাই নাকি আওয়ামীলীগের দালাল। আমরা আওয়ামীলীগের পা চাটা কুকুর এবং আমরা আওয়ামী প্রোপাগান্ডাই নাকি বাস্তবায়িত করছি। আমি পাঠকদের কাছে শুধু কয়েকটা প্রশ্নই করতে চাই কেবল।
আমার বাবা, ভাই, বোন, মা হত্যার বিচার চাওয়া এবং সেই বিচার চাইতে গিয়ে ক্যাম্পেইন করা, কাজ করে যাওয়াটা কি আওয়ামীলীগের দালালি করা? আমি কি এই স্বাধীন দেশে আমার স্বজন হত্যার বিচার চাইতে পারব না? এই বিচার যেই সরকার কিংবা যেই ট্রাইবুনাল সম্পাদন করছে তা সুষ্ঠূভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবার পক্ষে কাজ করাটা কি তবে আওয়ামীলীগের দালালি করা? আমরা তো এই দাবীও তুলেছি যে আওয়ামীলীগের ভেতরে যুদ্ধাপরাধী থেকে থাকলে তাদের বিচারও আমরা চাই। এবং সেইজন্য বার বার ডিফেন্স টিমকে আমরা অনুরোধ করে আমরা বলছি আপ্নারা ট্রাইবুনালের কাছে আবেদন করেন যাতে সেই সকল ব্যাক্তির বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া হয় খুব দ্রুত। আমাদের একটা সহজ ও সরল দাবী। সেটি হচ্ছে, ১৯৭১ সালে যারা মানবতা বিরোধী অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা কিংবা যুদ্ধাপরাধের সাথে শংস্লিষ্ঠ ছিলো সবার বিচার করতে হবে রিগার্ডলেস সেই ব্যাক্তি যে দলই করুন না কেন। আজ যদি আমার বন্ধুকে কোনো সন্ত্রাসী খুন করে ফেলে চলে যায় এবং সেটির বিচার অনুষ্ঠিত হয় সুষ্ঠু ভাবে এবং আমিও সেই বিচারের দাবীতে দৃপ্ত আওয়াজ তুলি তবে কি আমি সেই বন্ধুর পরিবারের দালাল কিংবা যেই সরকার এই বিচার করবে আমি কি সেই সরকারের দালাল?
এই বিচার চাওয়াটা তো বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসাধারণের একটা সাধারন দাবী। এই বিচার তো শুধু কিছু দলীয় সমর্থক ছাড়া আর সকল মুক্তবুদ্ধির মানুষ প্রতিনিয়ত চান। তাদের এই চাওয়াটাই কি তবে আওয়ামীলীগের দালালি কিংবা পা চাটা? এই চাওয়ার মানেই কি হচ্ছে আমরা আওয়ামীলীগ থেকে মাসোহারা পেয়ে থাকি? প্রতিটি মানুষ একটি কথাই বলে থাকেন যে এইবার আওয়ামীলীগকে মানুষ ভোট দিয়েছে, বিশেষ করে তরুন সমাজ, কেননা তারা চায় একাত্তরে সালে সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধ যারা করেছে সেই অপরাধীদের বিচার।
এই তরুন সমাজের প্রত্যেকেই কি আওয়ামীলীদের দালাল? একটা সহজ এবং সাধারন চাওয়া চাইতে গেলেই বুঝি স্বাধীনতার ৪১ বছর পর যেই দল বিচার শুরু করেছে সেই দলের দালাল হয়ে যেতে হয়?
কেউ কি আমাকে এই প্রশ্নের উত্তরটি দয়া করে দেবেন?
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:২৯