somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সম্রাট জাহাঙ্গীর আর আনার কলি,মুঘল হেরেমে ঝড় তোলা প্রেমকাহিনী। কে ছিলেন এই আনার কলি?

০৯ ই নভেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




আনারকলি আর শাহজাদা সেলিমের প্রেম কাহিনী নিয়ে বাংলাদেশ,ভারত আর পাকিস্থানে কত যে সিনেমা নাটক আর সাহিত্য রচিত হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নাই। শত বছর ধরে মুখে মুখে ঘুরে ফিরেছে এই বিয়োগান্তক করুন প্রেম গাঁথা । ভারতে তৈরি হয় সর্বকালের সেরা মুভি ‘মুঘল-এ-আজম।‘আগস্ট ৫, ১৯৬০ সালে মুক্তির পর এই চলচ্চিত্র বক্স অফিসের অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে বলিউডের সর্বকালের সর্বোচ্চ আয় করা চলচ্চিত্রের তালিকায় স্থান করে নেয় যা ১৫ বছর অক্ষুন্ন ছিল। অন্যান্য অসংখ্য পুরস্কারের পাশাপাশি মুঘল-এ-আজম একটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং তিনটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জয় করে। প্রথম কোন ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে কালার ডিজিটাইলেজেশন করে, ২০০৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে পুনঃবার মুক্তি দেয়া হয় এবং আবারো ব্যবসায়িকভাবে সাফল্য অর্জন করে।


হিন্দি আনারকলি মুভিতে দিলিপ কুমার ও মধুবালা

নওরোজের কোন এক দিনে সবে মাত্র সূর্য অস্ত গেছে। স্বয়ং সম্রাট আকবরের উপস্থিতিতে সবাই আমোদ প্রমোদে ব্যাস্ত। এটাই তখন কার রেওয়াজ। বাংলা নববর্ষের আনন্দে সম্রাট নিজেই উপস্থিত থাকতেন। সম্রাটের জন্মদিনের পর এটাই সবচেয়ে জাকঝমক পূর্ন অনুষ্ঠান।
প্রিয়ভাজনদের নিয়ে জলসা ঘরে বসেছেন সম্রাট আকবর। ঘর জুড়ে লোবানের ঘ্রাণ।ফরাসী শরাবে সবাই একটু ঘোরগ্রস্ত। রাত প্রায় দ্বিপ্রহর, হঠাৎ আকবর আসন ছেড়ে দাঁড়ালেন, সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলো পাত্র মিত্র সভাসদ সকলেই। আকবর নাটকীয় ভঙ্গিতে জানালেন, আজ এই খুশির দিনে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো এক রক্ত গোলাপের সাথে। যার রূপ পাকা আনারের দানার মতো রক্তিম আর টসটসে। আর যৌবন রক্তজবার কলির মতো। আমি ভালোবেসে তার নাম দিয়েছি আনারকলি। তুরস্কের সুলতান আমার জন্য এই উপহার পাঠিয়েছেন। সবাই মৃদু করতালির মাধ্যমে খুশি প্রকাশ করলো। জলসা ঘরের মঞ্চে ছড়িয়ে পড়লো চন্দনকাঠের ধোঁয়া।

কে ছিলেন আনার কলি-



ইতিহাসে এই নারীকে নিয়ে অনেক মত, অনেক গল্প। কেউ বলে আনার কলি, আবার কেউ বলেন তার প্রকৃত নাম নাদিরা বেগম, কেউ বলে শার্ফ-উন-নেসা। তিনি ছিলেন এক ইতালীয় সওদাগরের সুন্দরী কন্যা। আনারকলি একদিন তার পিতার সঙ্গে আফ্রিকার উত্তর উপকূল থেকে সওদাগর জাহাজে করে যাত্রা করে, তখন তার বয়স মাত্র ১৫। জলদস্যুরা তার বাবাকে হত্যা করে তাকে অপহরণ করে এবং ইস্তাম্বুল ক্রীতদাস বাজারে বিক্রি করে। পরবর্তীতে মনোরঞ্জনের বিভিন্ন রকম তালিম নেয়ার পর তার অবস্থান হয় এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে । ওই ব্যক্তি তাকে কিছুদিন পর তুরস্কের সুলতানের কাছ নজরানা পাঠায়। এবং সর্বশেষ তুরস্কের সুলতান আনারকলিকে সম্রাট আকবরের কাছে পাঠান।

যাক, আমরা আবার সম্রাট আকবরের নওরোজ অনুষ্ঠানে ফিরে যাই।

বাদশাহর ঘোষণার পর রাজ ভৃত্যরা জলসা অনুষ্ঠানের চারিদিকে কৃত্রিম ধোয়া সৃষ্টি করলেন। যা ছিল চন্দন কাঠের তৈরী। সুবাসিত ধোয়ার মধ্য থেকে বের হয়ে আসল আনারকলি। একটি অর্ধ স্বচ্ছ ওড়নায় তার দেহের ওপরের অংশ আচ্ছাদিত। নীচে একটি ঢোলা পাজামা। আনারকলি তার দু বাহু ওপরে তুলে সমগ্র দেহটি দোলাতে আরম্ভ করল। নেই কোন বাদ্য যন্ত্র, কেবল তার হাতের চুড়িগুলোর সংঘর্ষে সৃষ্ট মূর্ছনা আর নুপুরের কিন্নরই তার সঙ্গী। বুনো সর্পিল ভাবে নেচে চলল আনারকলি।



আলোছায়ার মঞ্চে নূপুরের নিক্কন আর ঘোমটা টানা এই তন্বীর আলতা রাঙা দুটি পা, ইরানি কারুকাজের পোশাক পরা তন্বী সুর তুললো কণ্ঠে। এতো মিহি আর সুরেলা সে কণ্ঠ শ্রবণে তন্ময় হয়ে রইলো সকলে। মুগ্ধতার আরো বাকি ছিলো- নাচের এক পর্যায়ে যখন ঘোমটা টানা ওড়না বাতাসে ছুঁড়ে দিলো। আর সে ওড়না উড়ে গিয়ে পড়লো শাহজাদা সেলিমের (পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর) গায়ে । সেলিম তাকিয়ে দেখলো মঞ্চের এ তন্বী মর্তের কোন রমনী নয়। সে অন্য কোন গ্রহ থেকে আসা রূপসী। মোমবাতির প্রকম্পিত আলোতে শাহজাদা সেলিম দেখলেন তার গাঢ় নীল চোখ, ডিম্বাকৃতি মুখমণ্ডল, খাড়া নাক এবং অসাধারণ গুনাবলিতে প্রথম দর্শণেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন শাহজাদা সেলিম। তার হৃদস্পন্দন প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো। এতো রূপ কোন মানবী অঙ্গে থাকতে পারে সেলিম তা আগে কখনো দেখে নি। আর তার ওড়না থেকে যে ঘ্রাণ আসছে তাতে মোহগ্রস্ত হয়ে গেলো শাহজাদা সেলিম। মুগ্ধ হয়ে দেখলো তার নাচ, শুনলো গান। এ অপ্সরাকে তার পেতেই হবে। সেটা যে কোনো মূল্যেই হোক!
আনারকলিকে পেতে সেলিম ঘুষ দিয়ে হাত করেন সম্রাট আকবরের খাজানসারা (হেরেমের রক্ষী)কে।

আকবর তিন সপ্তাহের জন্য শিকারে গেলে খাজান সারা অতি গোপনে আনারকলিকে শাহজাদা সেলিমের খেদমতে হাজির করেন।পরবর্তীতে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, আনারকলিও তার প্রেমে মজেছিলেন। তারা অভিসারে যেতেন। তবে তাদের মধ্যকার দেখা সাক্ষৎ গোপন রাখা হতো। তাদের রোমাণ্টিক সম্পর্কের সময় আনারকলির বয়স ছিল চল্লিশের কোঠায় কিংবা তার চেয়ে বেশি। শাহজাদা সেলিমের বয়স ছিল ত্রিশের কোঠায়।
পরবর্তীতে সেলিম ও আকবরের জীবনি লেখক আকবরের অতি বিশ্বস্ত আবুল ফজলের বুদ্বিতে ধরা পড়ে যে আনারকলি আর সেলিম প্রেমে মজেছেন। সম্রাটের নির্দেশে বন্ধ হয়ে গেলো সেলিমের হেরেমে যাওয়া। কিন্তু যে গভীর প্রেমে মজে আছে সেলিম আর আনারকলি তাতে দূরত্ব মানা কঠিন, মানা কঠিন বাধা-বিপত্তি।
রাতের আঁধারে গোপনে তারা দেখা করবে নদীর তীরে ভাঙ্গা মন্দিরের ওখানে। এমনটাই চিঠিতে জানালো শাহাজাদা আনারকলিকে। আনারকলি চিঠি পড়ে অপেক্ষায় থাকলো রাত্রি নামার। রাতে আঁধার ঘন হলে হেরেমের রক্ষীর সহায়তায় আনারকলি বের হয়ে গেলো হেরেম থেকে।

তারপর ধীরে চলে গেলো পূর্ব নির্ধারিত স্থানে। মিলিত হলো প্রেমিক শাহাজাদা সেলিমের সাথে। কিন্তু, সম্রাট আকবর যেহেতু আগেই সব টের পেয়ে গিয়েছিলো তাই তার সেনাদের হাতে ধরা পড়ে গেলো সেলিম-আনারকলি।


আকবর বন্দী করে আনারকলিকে হেরেম খানায় নিয়ে যায় সেখানে সেলিমের উপস্থিতে আনারকলিকে জ্যান্ত কবর দেবার শাস্তি দেয় যেন আনারকলি তিলে তিলে মারা যায়। পরে জানা যায় সেলিমের অনুরোধে তার দাদী হামিদা সম্রাট আকবরের মা আনারকলিকে গোপনে বিষ সরবরাহ করে যেন কষ্ট পেয়ে না মারা যেয়ে এক বারে মারা যায়।


পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থিত আনার কলির মাজার

পরবর্তীতে সেলিম, আনারকলির স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক সমাধি সৌধ নির্মান করেন লাহোরে। আজো আছে সেটা। সৌধটি অষ্টভুজাকৃতি। আছে আটটি গম্বুজ। গম্বুজগুলো নির্মিত স্তম্ভের ওপর। একটি স্তম্ভে লেখা আছে আল্লাহর নিরানব্বইটি নাম আর দুই লাইনের একটি ফারসি কবিতা:



তা কিয়ামাত শুকর গুইয়াম কারদিগারি কিশ রা
আহ, গার মান বাজ বিনাম রু ইয়ার-ই-খুশ রা

“একবার, আর একবার দেখতে পাই প্রিয়তমার মুখ যদি
ঈশ্বর, তোমার নাম ডেকে যাবে হৃদয় কেয়ামত অবধি”


তথ্য সুত্র- Click This Link
http://cholontika.com/মুঘল-সালতানাতের-তিন-রমণী/
http://www.protikhon.com/মুঘল-সালতানাতের-সেলিম-আন/
http://www.priyo.com/2014/09/04/103304.html
https://bn.wikipedia.org/wiki/মুঘল-ই-আজম
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪১
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×