খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে রাজা গণেশ নামে এক হিন্দু জমিদার প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে বাংলায় মাথা ছাড়া দিয়ে উঠেন।ইনি ছিলেন দিনাজপুরের জমিদার।জন্ম বর্তমান ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার ভাতুরিয়া গ্রামে।(এখানে এখনো রাজা গণেশের গড় বিরাজমান)
রাজা গণেশের ষড়যন্ত্রে ইলিয়াস শাহী বংশের শেষ দুজন সুলতান নিহত হন।(১৪১১ সালে গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ ও ১৪১২ সালে ততপুত্র সাইফুদ্দিন হামজা শাহ) ১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা গণেশ সাইফুদ্দিন হামজা শাহ এর পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহকে হত্যা করে স্বয়ং বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। তিনিই একমাত্র হিন্দু যিনি পাঁচ শতাধিক বছরের মুসলিম শাসনের ভিতর ধূমকেতুর মত বাংলায় সল্প কালের জন্য হিন্দু রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
রিয়াজুস সালাতিন গ্রন্থ থেকে জানা যায়- সিংহাসনে বসে তিনি রাজ্য থেকে ইসলামকে সমুলে উৎখাত করার জন্য মুসলমান জ্ঞানী এবং ধর্ম ভক্তদের অনেককে হত্যা করেন। রাষ্ট্রে রাজা গণেশ ও তার সহকারীদের কতৃত্ব ও মুসলমানদের উপর তাদের অত্যাচারের দরুন বুজুর্গ নুর কুতুবে আলম বাধ্য হয়ে জৈনপুরের সুলতান ইব্রাহীম শাহ শার্কির নিকট পত্র লিখে সাহায্য প্রার্থনা করেন।
একই সময়ে মীর সৈয়দ আশারফ জাহাঙ্গীর সামনানীও অত্যাচারী রাজা গণেশের হাত থেকে মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য অনুরোধ করে সুলতানের নিকট পত্র লিখেন।
- পরবর্তিতে ইব্রাহীম শার্কি বিপুল সৈন্য সহযোগে বাংলার দিকে অগ্রসর হন। বাংলা সিমান্তে বিপুল সৈন্য সমাবেশ দেখে রাজা গণেশ ভীত হয়ে পড়েন।কারন এই বিশাল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পেরে উঠার মত সৈন্য শক্তি গণেশের ছিল না।উপায়হীন গণেশ আসন্ন বিপদ এড়ানোর জন্য বিনীত ভাবে নুর কুতুবুল আলমের মধ্যস্থতা কামনা করেন। দুজনের আলোচনায় গণেশ প্রস্তাব করেন তার পুত্র যদুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে ক্ষমতায় বসানো হবে।
- তদনুযায়ী যদু ইসলামে দীক্ষিত হন এবং জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ নাম ধারন পুর্বক সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। অতপর পরিস্থিতি ব্যাক্ষা করে নুর কুতুবুল আলম সুলতান ইব্রাহীম শার্কিকে তার অভিযান পরিত্যাগ করতে অনুরোধ করেন, এবং শার্কি অভিযান পরিত্যাগ করে জৈনপুরে ফিরে যান।
ইব্রাহীম শাহ শার্কি ও তার সৈন্য বাহিনী ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পরে রাজা গণেশ তদীয় পুত্র থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন। সাথে কি উপায়ে যদুকে পুনঃ হিন্দুতে রুপান্তর করা যায় এ বিষয়ে ব্রাহ্মণদের পরামর্শ চান।ব্রাহ্মণরা সম্মিলিত হয়ে পরামর্শ দিল,’স্বর্ণ ধেনু’ ব্রতের মাধ্যমে যদুকে হিন্দুতে রূপান্তর করা সম্ভব। স্বর্ণ দ্বারা গাই গরুর একটা বড় মুর্তি তৈরি করে স্বর্ণ ধেনু’ ব্রতের আনুষ্ঠানিকতা সারতে হবে এর পর সোনার গাভীটির সমস্ত অংশ ব্রাহ্মণদের মাঝে ভাগ করে দিতে হবে।
রাজা উক্ত শুদ্ধি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জালালুদ্দিনকে পুনরায় হিন্দু বা যদুতে পরিণত করেন।
রাজা গণেশ ১৪১৮ সালে মারা গেলে স্বাভাবিক নিয়মে যদু সিংহাসনে বসেন।সিংহাসনের বসার সময় ও পরবর্তিতে যদু ব্রাহ্মণদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েন।জাত কুল খুইয়ে মুসলমান হওয়া যদুকে মেনে না নিতে ব্রাহ্মণরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের মানুষদের উস্কানী দিতে থাকেন। এমতাবস্থায় রাজ্যে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে থাকা যদু এক ভোজ সভার আয়োজন করে রাজ্যের সমস্ত ব্রাহ্মণদের ভোজ সভায় আমন্ত্রণ জানান।
যথা সময়ে ভোজ সভা শুরু হয়, ভোজে সকলকে একটা মাত্র তরকারী পরিবেশন করা হয়,’গরুর মাংস’।
ততোক্ষণে ভোজ গৃহের ফটক বন্ধ করে দিয়েছে প্রহরীরা। রাজা যদু সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন, আপনারা আমাকে আধামন ওজনের স্বর্ণধেনু বানিয়ে শুদ্ধাচারের মাধ্যমে হিন্দুতে রূপান্তর করিয়েছেন।এখন আপনারাই আমার বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছেন ধর্মত্যাগী ম্লেচ্ছ বলে। আমি যদি ম্লেচ্ছই থেকে গেলাম, স্বর্ণের ধেনূটা আপনারা খেলেন কেন?যারা স্বর্ণধেনু ভাগ করে খেতে পারে তারা আসল ধেনু খেতে পারবেনা কেন? এখন আপনাদের সামনে দুটি পথ খোলা আছে। হয় আপনারা গোমাংস খাবেন অথবা গর্দান দেবেন।
বলা বাহুল্য গর্দান হারনোর ঝুঁকি নাকি কেউ নেন নি।
এই ঘটনার পরে যদু পুনর্বার ইসলাম গ্রহন করেন এবং পুর্ব নাম জালাল উদ্দীন মোহাম্মদ শাহ ধারন করে রাজ্য শাসন করেন। জালাল উদ্দীন মোহাম্মদ শাহ এর পরে তার পুত্র শামসউদ্দীন আহমেদ শাহ ক্ষমতায় বসেন।শামসউদ্দীন আহমেদ শাহ মৃত্যুবরণ করলে শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহের উত্তরশুরী নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ পুনরায় ইলিয়াস শাহী বংশ প্রতিষ্ঠা করেন।
সম্প্রতি ‘ভরত জনের ইতিহাস’ নামে একটা গ্রন্থ আমার হাতে এসেছে। বইটি ২০১৪ সালে পশ্চিম বঙ্গের নবম,দশম,একাদশ শ্রেনীতে পাঠ্য ছিল, হয়তো এখনো আছে। বইটির রচয়িতা রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার প্রাপ্ত লিখক শ্রী বিনয় ঘোষ।পুরো বইটিতে মুসলিম শাসকদেরকে এমন ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যা এক কথায় সাম্প্রদায়িকতার উস্কানী দান ও হিন্দুদের মুসলিম বিদ্বেষী হতে প্রলুব্দ করার প্রচেষ্টা।
বইটিতে সুলতান জালাল উদ্দীন মোহাম্মদ শাহ সম্পর্কে লিখা হয়েছে, তিনি ব্রাহ্মণদের জোর পুর্বক গো-মাংস খাইয়ে মুসলমান বানাতেন।কিন্তু এই ঘটনার পটভূমি এবং জালাল উদ্দীন মোহাম্মদ শাহ যে এক সময় ‘যদু’ ছিলেন এই তথ্য কোথাও উল্যেখ করা হয়নি।
(পোস্টে ব্যবহৃত রাজা গনেশের স্কেচটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া)
সুত্র-
উইকিপিডিয়া
বাংলাদেশের ইতিহাস-কে এম রইছ উদ্দিন
চেপে রাখা ইতিহাস-গোলাম মর্তুজা
বাঙ্গালাহ ও বাংলাদেশের ইতিহাস- একেএম এনামুল হক।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৮