মাটির ওপর জলের বসতি/জলের ওপর ঢেউ/ঢেউয়ের সাথে পবনের পিরিতি/নগরে জানে না কেউ…।
নাম তার হাওর। অপূর্ব সুন্দর এক জনপদ। শুকনো মওসুমে মাইলের পর মাইল ফসলি জমি, ধুলোউড়া মেঠোপথ, রুপালি নদী। আর বর্ষায়? এ রুপালি নদীগুলোই ফুঁসে ওঠে। দুই তীর ছাপিয়ে প্লাবিত করে ফসলি মাঠ। দেখতে সাগরের মতো। ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যর কারণে হাওরের সৌন্দর্য অন্যান্য এলাকার চেয়ে একটু ভিন্ন। ব্যতিক্রম এখানকার ঋতুবৈচিত্র্য। জানলাম, হাওরে বর্ষা থাকে বছরের প্রায় ছয় মাস। পানি আসতে শুরু করে বৈশাখ-জৈষ্ঠ থেকে। শেষ হয় আশ্বিন-কার্তিকে। বাকি কয় মাস এখানে শুকনো মওসুম হয়। সে হিসেবে মূলত হাওরে ঋতু হয় দুটি। একটি ‘বর্ষা’ ও অন্যটি ‘খরা’ বা ‘শুকনো’।
কথিত আছে, বৃহত্তর সিলেট ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের একটি বড় অংশ এক সময় ‘কালীদহ সাগর’ নামে বিশাল জলরাশিতে নিমজ্জিত ছিলো। পরে ভূপ্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে তা পিরিচ আকৃতির নিম্ন সমতল ভূমিতে পরিণত হয়, এ নিম্ন সমতলভূমিই এখন হাওর। বলছিলেন এলাকার কিছু সম্মানিত লোকজন। যদিও হাওর শব্দটি সাগর শব্দের অপভ্রংশ। সাগর থেকে সায়র, আর সায়র থেকে হাওর বলে জানা যায়।
কি শুকনো কি বর্ষাকাল। ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য সৌন্দর্যের বিপুল পসরা সাজিয়ে বসে থাকে এই হাওর। বর্ষার হাওর হয়ে ওঠে কূলহীন সাগর। বিশাল জলরাশির বুকে বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোর একেকটাকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো লাগে। দূর থেকে মনে হয়, কচুরিপানা হয়ে যেনো পানিতে ভাসছে গ্রামগুলো। হাওরজুড়ে গলা ডুবিয়ে থাকা হিজল গাছের সারি, মন কাড়ে যে কারো। পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা করচের বন, হাঁসের ডিমের মতো সাদা ফল নিয়ে দঁড়িয়ে থাকা বরুন গাছ, কিংবা গাঙ্গের মিঠা পানিতে শুশুকের লাফ-ঝাঁপ দেখলে বিনোদিত না হয়ে পারা যায় না।
রাতে হাওরের মাঝখানে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় কুপি বাতি জ্বালিয়ে জেলেরা যখন জাল দিয়ে মাছ ধরেন, এ দৃশ্য দূর থেকে দেখলে মনে হয় কারা যেনো শত শত প্রদীপ জ্বলিয়ে হাওরের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছে। রাতভর হাওরে ভেসে ভেসে জোসনা উপভোগ করাটা আরো আনন্দের বিষয়। অভিলাসী মনকে জোসনায় ঠাঁই দেয়ার এমন সুযোগ হাওর ছাড়া আর কোথায় আছে! হাওরে ট্রলারের ছাদে বসে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখাটাও অন্যরকম এক অনুভূতি। এখানে হিজল করচের মাথা ছঁয়ে সূর্য যখন ডুবে, দিগন্তজুড়ে হাওরের পানি রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। সূর্যের লাল-সোনালি-হলুদ আলো লেজার রশ্মির মতো রেখা ছড়িয়ে দেয় পুরো আকাশজুড়ে। এ এক অপূর্ব দৃশ্য বটে।
এখানে শুকনো মওসুমের চেয়ে বর্ষা মওসুমে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। প্রকৃতি ছাড়াও হাওরে পর্যটকদের দেখার মতো বেশ কিছু যায়গা রয়েছে। এ সময়ে এখানে চলে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। যা আপনাকে অনেক বেশি বিনোদিত করবে। এছাড়া কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের ‘দিল্লির আখড়া’ এর অন্যতম। এখানে রয়েছে শত শত হিজল গাছ। চার শ’ বছরের পুরনো এ আখড়া। হিজল গাছের সারি ৩০০ একরের পুরো আখড়া এলাকাজুড়েই। শত শত হিজল গাছ। সারা বর্ষায় এগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আখড়ার নির্জনতায় আপনারও মনে হবে, সত্যি এটি চমৎকার একটি স্থান বটে। মূলত সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ-এ সাত জেলা মিলে হাওরাঞ্চল।
এবার দুই দিনের একটি প্রোগ্রামে কিশোরগঞ্জে গিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হলো এখানের বিখ্যাত হাওরগুলো দেখে যাবো। লোক মুখেও অনেক শুনেছি হাওরের গল্প। যদিও চট্টগ্রাম যাওয়ার পথেও এমন দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। তবে এই সাত জিলার হাওরের মতো নয়। কিছুটা কম জলে ডুবে থাকা ঝিল বলেই মনে হবে। ব্যাস। আরো দুইদিন বেশ আয়েশ করে কয়েকটি রুটে হাওরে দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম, এবং দেখলাম হাওরের অপরুপ সৌন্দর্য। তবে সেখানে যাওয়ার জন্য সহজ হলো সায়েদাবাদ বা গেলাপবাগ থেকে বাসে অথবা কমলাপুর থেকে ট্রেনে সরাসরি কিশোরগঞ্জ শহরে। স্টেশনে নেমে রিকশায় মিনিট দশেক। এর পর একরামপুর। সেখান থেকে অটোরিক্সায় মরিচখালি বাজার। ব্যাস, এ বাজারটিই হলো এই পথে হাওরের দরজা। মরিচখালি বাজার মানেই হাওরের চৌকাঠ পেরিয়ে সোজা নৌকায়। এর পর শুরু হবে ধুকপুক ধুকপুক। মানে ইঞ্জিনের শব্দ। এ শব্দের ওপরই থাকতে হবে ২৪ ঘন্টার মতো। প্রথমে বিরক্তিকর মনে হলেও পরে কানের সাথে মানিয়ে যাবে আশা করছি কারণ আমার মানিয়ে গেছে। নৌকায় ওঠেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন আগে কোথায় যাবেন। সোজা ‘দিল্লির আখড়া’। দিল্লির আখড়া পরিদর্শন শেষে পরের সময়টা কাটাতে পারেন একেবারেই পরিকল্পনা ছাড়া।
সবকিছুই নির্ভর করবে পরিস্থিতি ও আবহাওয়ার ওপর। তবে সময়গুলো কাটবে হাওরের ভাসা পানিতেই। বৃষ্টি না হলে ট্রলারের ছাদেই রাত কাটিয়ে দিতে পারেন। তা ছাড়া ট্রলারের ভেতরে ঘুমানোর ব্যবস্থা তো রয়েছেই। ইচ্ছে করলে উপজেলা সদরের ডাকবাংলোতেও রাত কাটানো যায়। এরপর ভাসমান তাঁবু নিয়ে ধুকপুক করতে করতে নৌকার নাক ঘুরিয়ে দিতে পারেন হাওর উপজেলা ইটনা কিংবা অষ্টগ্রামের দিকে। এভাবে দেখে দেখে ফিরে আসতে পারেন আপনার গন্তব্যস্থলে।
সবশেষে বলবো- আপনার ভ্রমণ হোক আমার চেয়েও আনন্দের। অভিজ্ঞতার তথ্যভান্ডার ভরে উঠুক আপনার মেমরি চিফগুলো। আপনার সেই সংরক্ষিত তথ্যগুলো বিলিয়ে দিন অন্যর মাঝে, এমনটাই প্রত্যাশা। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এই কামনায়।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৪:১০