‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা…।’ বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি ও গর্বিত ঐতিহ্যের রূপময় ছটায় বৈশাখকে এভাবেই ধরাতলে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবির কিরণে হাসি ছড়িয়ে পুরনো বছরের সব গ্লানি, অপ্রাপ্তি, বেদনা ভুলে নব আনন্দে জাগবে গোটা জাতি। আজ পহেলা বৈশাখ। একটি নতুন দিন, একটি নতুন বছরের শুভ সূচনা। শুভ নববর্ষ। স্বাগতম ১৪২৫ বঙ্গাব্দ।
পহেলা বৈশাখে প্রকৃতিও যেনো নতুন জীবন ফিরে পায়। তাই এই দিনে সকলে পান্তা ইলিশ খেতে খেতে হয়তো সুর তুলে একসাথে গেয়ে ওঠে-‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল/আমাকে তুই বাউল করে সঙ্গে নিয়ে চল’। বৈশাখ বাঙ্গালীর জীবনে এক বড় সুখের সময়। এই সময় উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে জীবন। এই উদ্দীপনা শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। বাঙ্গালী হৃদয় ও মনে উৎসবের যে আমেজ ছড়িয়ে পড়ে তা নানা ধরণের কলুষতার মধ্যেও নবীন আবেগ সঞ্চার করে। প্রাণের আবেগ নিয়ে বেঁচে ওঠার প্রেরণা দেয়। বৈশাখের এই দিনে ঢাকার রাজপথ রঙ্গিন রুপ ধারণ করে। লাল, নীল আলোক সজ্জায় নয়, প্রকৃতির আলোতে সজ্জিত হয় জীবন। নুতন শাড়ি ও পাঞ্জাবী পড়ে হাজার হাজার নারী পুরুষ নানান উৎসবের মধ্যে দিয়ে নববর্ষকে বরণ করে নেয়। দেশের শিল্প ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই পহেলা বৈশাখ। আমাদের বুটিক হাউজগুলো বাংলা নববর্ষকে আরো সমৃদ্ধ, সুসজ্জিত করেছে তাদের নতুন নতুন দেশীয় ডিজাইনের মাধ্যমে। যা তরুণ-তরুণীদের সাজে আলাদা মাত্রা আনে। এটা ভাবতে বেশ গর্বিত লাগে যে, এই বৈশাখ উৎযাপন শুধু আমাদের বাঙ্গালীদেরই উৎসব।
আমাদের সংস্কৃতিতে বারো মাসে তেরো পার্বণের ব্যাপারটি মিলেমিশে আছে। বেশির ভাগ উৎসবই ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাকি সব উৎসব লোকজ চেতনার ওপর দাঁড়ানো। বাংলা নববর্ষ সে উৎসবের মধ্যে অন্যতম। ছায়ানটের বৈশাখী আহবানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ঢাকাই বৈশাখী উৎসব। রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাগরদোলা, ইলিশ পান্তা, মুড়ি-মুড়কি, খই, ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসা কাচের চুঁড়ি, ঢোল, একতারা, মাটির গয়না, ডুগডুগি আর বাঁশির শব্দে মুখরিত হয় আকাশ বাতাস। তারসাথে চরুকলার বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বর্ষবরণ আয়োজনকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। বাঙ্গালীর জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি মানুষের কাছে আরো সাবলীল ভাবে তুলে ধরে। প্রতিবারের মতো এবারেও বাঙ্গালী বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়াবে, পান্তা-ইলিশ খাবে। যেসব যায়গায় বৈশাখী অনুষ্ঠান হয় সেসব যায়গায় গিয়ে অনুষ্ঠান দেখবে। এটা বাঙ্গালীর একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। যদিও বর্তমান দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে বাঙ্গালী কি তাদের শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ভুলে থাকবে? এ বছর ভিন্ন প্রেক্ষাপটে উদযাপিত হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারী, স্বাধীনতা দিবস, নারী দিবস। সেভাবেই উদযাপিত হবে নববর্ষ। আশা করছি সবকিছু ঠিকঠাক মতোই হবে। প্রতিবারের মতো এবারো সবাই সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে উৎসবটি উদযাপন করবে। এই উৎসব সার্বজনীন। এই দিনে ভুলে যাবে সব ভেদাভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ।
চৈত্রের রুদ্র দিনের পরিসমাপ্তি শেষে আজ বাংলার ঘরে ঘরে নতুন বছরকে আহবান জানাবে সব বয়সের মানুষ। বাঙ্গালীর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন এই পহেলা বৈশাখ। আজ নব আলোর কিরণশিখা শুধু প্রকৃতিকে নয়, রঞ্জিত করে নবরূপে সাজিয়ে যাবে প্রত্যেক বাঙ্গালীর হৃদয়কোণও। নব আলোর শিখায় প্রজ্বলিত হয়ে শুরু হবে আগামী দিনের পথচলা।
হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আজ বাঙ্গালী হারিয়ে যাবে বাঁধভাঙ্গা উল্লাসে। উৎসব, আনন্দ আর উচ্ছাসে ভরে যাবে বাংলার মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। আজকের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো সব ঝরা গ্লানিকে মুছে ফেলে সকলে গেয়ে উঠবে নতুন দিনের গান। বৈশাখী উৎসবের মধ্যে দিয়ে যেন বাঙ্গালী তার শিকড় খুঁজে পায়।
১৪২৪-এর আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার হিসাব চুকিয়ে নতুন করে পথচলা শুরু হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সর্বজনীন উৎসবে নববর্ষ উদযাপনে একসঙ্গে গাইবে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’। গ্রাম থেকে শহর, গলি থেকে রাজপথ, আঁকা-বাঁকা মেঠো পথ থেকে অফুরান প্রকৃতি সবখানেই দোল দেবে বৈশাখী উন্মাদনা। মুড়ি মুড়কি, মণ্ডা মিঠাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে নাচে-গানে, ঢাকে-ঢোলে, শোভাযাত্রায় পুরো জাতি বরণ করবে নতুন বছরকে। কেউ কেউ সকালবেলা থেকেই মেতে উঠবে নগর সংস্কৃতির দান পান্তা-ইলিশ খাওয়ার উৎসবে। খোলা হবে বছরের নুতন হিসেব নিয়ে হালখাতা। চলবে মিষ্টিমুখের আসর।
যদিও এই বছর ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হবে। কারণ গত দুই মাসেরও অধিক সময় ধরে সারা দেশে চলছে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। নানা হাঙ্গামায় মানুষ নিহত হয়েছে এবং হচ্ছে। আহত হয়েছে অনেক নারী, পুরুষ, শিশু এবং এখনো হচ্ছে। রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। কোটা সংস্কার নিয়ে এক ধরণের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি চলমান। এছাড়াও আছে রোগ-শোকসহ নানান অস্থিরতা। তারপরেও নতুন বাংলা বছরের আবেদন সকলের কাছে আলাদা এক বৈচিত্রময়। নতুন বছর মানুষকে নতুন করে উজ্জীবিত করে বাঁচতে শেখায়। তাই, নববর্ষের প্রথম দিন সবাই উদযাপন করে প্রাণভরে। নববর্ষের প্রথম দিন সবার জন্য শুভ হোক এবং ভরিয়ে দিক সকলের প্রাণের চাহিদা, এমটাই প্রত্যাশা। সবাইকে শুভ বাংলা নববর্ষ-১৪২৫ বঙ্গাব্দ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১১:০৬