somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইথিওপিয়ার মানুষ-জাতি –ভাষা ৭

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২.১.৪ ওরোদের আদিম গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো- গডা (Gadaa- Indigenous Democratic system of Oromo, Ethiopia)

আফ্রিকায় ইউরোপীয়দের কাড়াকাড়ি কিংবা উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার আগে ওরোমো জাতি ছিল অনেক সুসংগঠিত। রাজনৈতিক –সাংস্কৃতিক কাঠামো ছিল প্রতিষ্ঠিত। গডা শাসন ব্যবস্হাপনার মাধ্যমে ওরোমোরা নিজ জনগনের কল্যান, নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করত। বর্তমানে তাদের কোন স্বায়ত্বশাসন কিংবা গনতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব নেই যার দ্বারা নিজেদের কে আলাদা করে শাসন করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে তারা আমহারা – তিগরেই জাতিগোষ্ঠী দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। ইথিওপিয়ান উপনিবেশিক শাসন ও গণহত্যার আরম্ভ হয় উনবিংশ শতাব্দির প্রারম্ভে। একবিংশ শতকেও এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে।

ভূমিতে ছিল স্বাধীন, সার্বভৌম। তাদের উপর বাইরের কর্তৃত্ব ছিলনা। ইতিহাস প্রমাণ করে, ওরোমোরা আবিসিনিয়া থেকে আমহারা –তিগরে অঞ্চল সহ- মোম্বাসা বন্দর পর্যন্ত, সোমালিয়া থেকে সুদান পর্যন্ত বিশাল এলাকা তাদের অধীন ছিল। তবে সুনির্দিষ্ট সীমানা রেখা ছিল না। ইউরোপীয়দের আফ্রিকা দখলের কাড়াকাড়ির আগপর্যন্ত ওরোমোদের হাতে এই ভূমি ছিল। ওরোমোদের সম্পর্কের জানার জন্য আমাদের কে তাদের প্রচলিত আদিম স্বভাবজাত গণতান্ত্রিক কাঠামো সম্পর্কে জানা আবশ্যক।

আফান – ওরোমো ভাষার লোকদের নিজস্ব শাসনতান্তিক কাঠামো ছিল। সামাজিক কাঠামো হিসাবে এই শাসন ব্যবস্হা ছিল, গণতান্ত্রিকধাঁচের। ঐতিহ্যগতভাবে সামাজিক লোকজ অভিজ্ঞতা থেকে গড়ে ওঠেছিল এই শাসন কাঠামো। সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, আর্থিক বিষয়াদি ছাড়াও, যৌথ সামাজিক বিষয়, যেমন বিরোধ মীমাংশা, ক্ষতিপূরন, নারীর অধিকার রক্ষা করার মত কাজ দেখাশোনা, তদারকি করত এই ব্যবস্হা। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, নৈতিক সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা করার একটা পদ্ধতি। সামাজিক সংহতির ভিত্তি মজবুত করা সহ যৌথভাবে সামাজিক দলের সংস্কৃতিকে লালন করাই ছিল প্রধানতম উদ্দেশ্যে।গদা হচ্ছে একটি শ্রেণী বিভাজিত প্রতিষ্ঠান। অনেকেই একে বয়স ভিত্তিক একটা কাঠামো বলে থাকেন। গডার যিনি প্রধান থাকে তাঁকে বলা হত হেডম্যান বা চেয়ারম্যান।

এই চেয়ারম্যানের একটা পরিষদ আছে,কর্মচারি আছে। এই শ্রেণীর লোকেরা শাসক শ্রেণী। প্রত্যেকটি স্তর একটি নির্দিষ্ট নিয়মতান্ত্রিক কাঠামর ভেতর দিয়ে যেতে হত। নেতা বা কর্তৃত্ব দেয়ার আগে তাদের এই অনেক নিয়ম কানুন জানতে হত। সাধরণত পুরুষের গদার সদস্যপদ উন্মুক্ত থাকত। অন্যদিকে গদা সদস্য হবার জন্য উত্তরাধিকার কে প্রাধান্য দেয়া হয়। যাদের পিতা আগে থেকেই সদস্য তাদের জন্য এই পদ প্রাপ্তি ছিল সহজসাধ্য বিষয়। প্রতি আটবছর পর নিয়ম অনুযায়ী বদল হত। গুমি গায়ু নামক জনসভার মাধ্যমে পরবর্তি আট বছরের জন্য বিভিন্ন নিয়ম কানুন প্রতিষ্ঠিত হত। জনকথক বা লোকজ ইতিহাসবিদেরা মৌখিকভাবে সমাজের ইতিহাস গদার লোকদের কে শিক্ষাদিত। আচার আচরণ, নিয়মনীতি, নৈতিকতা, আইন কানুন, বিচার, ইতিহাস ঐতিহ্য, সমাজের মিথ, মহাকাশ সম্পর্কে ধারণা সবই থাকত এই সব শিক্ষার মধ্যে। সাধারণত ডুমুর জাতীয় গাছের নীচে সভাসমাবেশ, আচার-অনুষ্ঠান হত। ডুমুরগাছ কে গদার প্রতিক হিসাবে মানা হয়। শিশুকে গদার সম্পর্কে জ্ঞান শিক্ষার দায়িত্ব নেয় পরিবার, সমাজ ও স্কুল। ওরোমোদের ধর্মীয় ও রাজতৈক সংস্কৃতিকে বুঝার জন্য গদা কাঠামো সম্পর্কে জানা আবশ্যক। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন,গদাকে বাদ দিয়ে ওরোমো সমাজকে বুঝার চেষ্টা করা মানে হল, কংকালবিহীন কোন মানুষকে নিয়ে গবেষণা করা।

ওরোমদের এই স্বতন্ত্র সমাজ কাঠামো, শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি বিস্তার গবেষণা হয়েছে।অনেক সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলোচনার বিষয়। আফ্রিকান সমাজে এই গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার বিকাশকে আধুনিক অনেক সভ্য সমাজের চেয়ে বেশ অগ্রগামী ছিল বলে মনে করেন। এই ব্যবস্থাকে তাদের সংবিধান হিসাবে দেখা হয়। সামাজিক নিয়ন্ত্রনের মাধ্যম ছিল এই গডা কাঠামো। এই কাঠামো গড়ে উঠেছিল ১১টি বয়সভিত্তিক স্তর নিয়ে। প্রতিটি স্তর আট বছরে একটা স্তরে বিভক্ত। পাঁচটা আট বছরের স্তরের একটা প্রজন্মস্তর নির্ধারিত হয়। (চল্লিশ বছরের ব্যবধান)। প্রথম পাঁচটি আট বছরের স্তর থাকে, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, সামরিক সেবা প্রদানের জন্য। এই স্তর গুলো অতিক্রম করার সময় অর্থনৈতিক দায়িত্বও পালন করতে হত। পরবর্তি ৬টি স্তর নির্ধারিত আছে, প্রাপ্ত বয়স্ক গডা সদস্যদের জন্য। তারা মূলত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও বিচারিক দায়িত্ব পালন করত। এদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হত গডা পরিষদ ও তাদের প্রধান নেতা। তবে এখানে উল্লেখ্য যে প্রতিটি আটবছরের স্তর অতিক্রমকালে তাদের একটা আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হত। এই আনুষ্ঠানিকতার ভেতর দিয়ে পরবর্তি স্তরে উন্নিত হয়। দীর্ঘ সময়, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ শেষে তাদের মধ্য থেকে রাজ্য শাসনের মত উপযুক্ত ব্যক্তি নির্বচন করার এই পদ্ধতি। অনেক আধুনিক সমাজেই বিরাজমান নয়। গডা শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে তাদের আদিম ধর্মবিশ্বাস থেকে। তাদের আদিম ধর্মের ঈশ্বের নাম ওয়াকা (Waaqa)। তাদের ভাষা ‘গ’ মানে হল আইন আর ‘ড’ মানে হল ওয়াকা ( ঈশ্বর)। সাধারণ অর্থে গডা মানে হল ঈশ্বের আইন( সিরা ওয়াকা- Seera Waaqaa)

গডা ব্যবস্থায় প্রজন্ম, বয়স, লিঙ্গ, এবং শ্রণীকে শ্রমবিভাজনের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হিসাবে ধরা হয়। শ্রমবিভাজন গডা কাঠামোর একটা স্বতন্ত্র ও কেন্দ্রীয় বিষয়। এখানে কাজ করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় শ্রমবিভাজনের ভিত্তিতে। এই শ্রমবিভাজন ও কর্মবিভাজন সামাজিক –সাংস্কৃতিকভাবে আরোপিত বিষয়। ওরোমো সমাজ সমতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। তথাপী শাসনতান্ত্রিক স্তর বিন্যাসে বয়সভিত্তিক, প্রজন্ম স্তরে উন্নতির জন্য নারীদের অংশগ্রহন ছিল না। শারীরিক কসরত আর পেশিবহুল শক্তি সামর্থ্য দরকার বয়সভিত্তিক গডা ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে পরবর্তি স্তরে উন্নীত হওয়া। শিকার করা, সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়া, যুদ্ধ করা, পরিবার, গৃহ থেকে দূরে থাকার মত কাজের নারীদের অংশগ্রহন সহজসাধ্য ছিলনা বিধায় তাদের কে এই সব কর্মের বাইরে রাখা হত। কাজের ধরন, সক্ষমতা বিবেচনা করেই লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজনই ছিল যুক্তি যুক্ত। নারীর বঞ্চিত হয়েছে সত্য। গডা ব্যবস্থা কার্যকরি ছিল ওরোমোদের সমাজ ও আইন সম্পর্কে তাদের জ্ঞাত ধারনা ধারা। এই ধারনা দুইটি দিক ছিল, একটি হচ্ছে ক) বিকুসমা আডা(Beekumsa aada) মানে হল প্রথাগত জ্ঞান আর খ) বিকুমসা সিরা (Beekumsa Seera) মানে আইনের জ্ঞান। আইনের জ্ঞান কে আবার দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে, যেমন ১) সিরা ওয়াকা ( Seera Waaqa) মানে ঈশ্বরের তৈরি আইন এবং ২) সিরা নামা (Seera Nama) মানুষের তৈরি আইন। ঈশ্বরের তৈরি আইন অপরিবর্তনীয় আর মানুষের তৈরি আইন পরিবর্তনশীল। ওরোমদের প্রথাগত জ্ঞান জনসাধারনের অভিজ্ঞতা ভেতর থেকে গড়ে উঠে।
এই জ্ঞান উন্মুক্ত, সবার সাথে ভাগাভাগি করা যায় এমন। জনমতের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক উপায়ে এই প্রথাগত জ্ঞান কে আইনে পরিবর্তন করা হত। আবার প্রয়োজনে তা প্রত্যাহার করা হত। নতুন আইন জায়গা নিত। এখানে সমাজের প্রয়োজনীয়তা প্রাধান্য দেয়া হত। গডা ব্যবস্থায় একটা শিশুর জন্মের পর থেকেই তার বয়সভিত্তিক স্তরের বিন্যাস আরম্ভ হয়।সার্বজনীন ধারনার মত তাদেরও একই অভিমত যে শিশুরা নিষ্পাপ। ওরোমো সমাজেও শিশুদের কে নিষ্পাপ হিসাবেই দেখা হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১৯
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×