নারায়নগন্জ্ঞে সংঘটিত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৭ জন অপহরণ, হত্যা ও পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে আমরা সকলেই উৎকন্ঠিত। বিশেষ করে এর ন্যায়বিচার হবে কি না, র্যাব এর ৩ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হবে কি না, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হবে কি না এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা করছি। বরাবরের মতই আমরা যা শুনছি তার কোন প্রমান আছে কি না বা তা যুক্তিসংগত কি না তা না ভেবেই বিভিন্ন উক্তি করছি। এসব উক্তির পেছনে যুক্তির চেয়ে আবেগ, রাজনৈতিক মতাদর্শ অনেক বেশী কাজ করছে।
এবার আমি পাঠকদের বিনীতভাবে অনুরোধ করবো আমাকে ভুল না বুঝতে। আমি কাউকে বাচানোর চেষ্টা করছি না, কাউকে ফাঁসানোর চেষ্টাও করছি না। আমার মনের মধ্যে কতগুলো প্রশ্ন উঠেছে তা আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। আমি আরও অনুরোধ করবো আপনারা আবেগ, রাজনৈতিক মতাদর্শের উর্ধ্বে উঠে গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনায় অংশগ্রহণ করবেন।
প্রথমেই মূল তথ্যগুলো পূনর্ব্যাক্ত করি।
এক। উদ্ধার হওয়া মৃতদেহসমূহ যে দড়ি দিয়ে বাধা হয় তা হচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর অস্ত্র পানিতে ডুবে গেলে সহজে উদ্ধারের জন্য ব্যবহৃত ইজ্জতের রশি।
দুই। লাশগুলো যে ইটের সাহায্যে ডুবানো হয়েছিলো সেই ইট র্যাবের অফিসের ৫০ গজ দুরে একটি নির্মানাধীন ভবনে পাওয়া যায়।
তিন। নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন র্যাব এর তৎকালীন অধিনায়ক ও অন্যান্য কর্মকর্তারা আরেক সন্ত্রাসী নূর হোসেনের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে নজরুল ইসলামসহ ৭ জনকে অপহরণ ও হত্যা করেছেন।
চার। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস্) কর্ণেল জিয়া নুর হোসেনের কোলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার তথ্য দিলে শহীদ কমিশনার এবার অভিযোগ করেন যে কর্ণেল জিয়া নুর হোসেনকে কোলকাতায় পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন।
পাঁচ। ডঃ কামাল হোসেনের রীটের পরিপ্রেক্ষিত্তে মহামান্য আদালত র্যাবের সাবেক ৩ কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ প্রদান করেন এবং বলেন তাদের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ নাও পাওয়া যায় তাহলে যেন তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়।
এবার আমার প্রশ্নসমূহ আপনাদের সম্মুখে রাখবো। আমার ভুলও হতে পারে। তবুও চলুন এর উপরে যুক্তিপূর্ণ আলোচনা করি।
ক। নিঃসন্দেহে নুর হোসেন একজন সন্ত্রাসী। কিন্তু নিহত নজরুল ইসলাম কেমন লোক ছিলেন?
খ। নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান একজন সাবেক জনপ্রতিনিধি। আমাদের জনপ্রতিনিধিদের মাশা-আল্লাহ যে অবস্থা তাতে প্রশ্ন উঠে শহীদ চেয়ারম্যান নিজেই কেমন লোক?
গ। লাশের সাথে পাওয়া রশি মোটেই ইজ্জতের রশি নয়। ইজ্জতের রশি খুবই চিকন প্লাস্টিক/নাইলনের রশি। পূরুত্ব ১ মিমি এর মত। এটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১০০ গজের মত হয়। এই রশিটি একটি এক ফুট লম্বা এবং ১ বা ২ ইন্চি ব্যাসের কাঠ বা বাঁশের সাথে এক প্রান্তে বেঁধে এমন ভাবে প্যাচানো থাকে যে সামান্য টান পড়লে রশিটি খুলে যায়। এই রশির অপর মাথা অস্ত্রের সাথে বাঁধা থাকে। এই রশির মূল লক্ষ্য হলো কোন কারনে জলযানডুবি বা অন্য কারনে অস্ত্র নদীতে পড়ে গেলে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সময় টানে রশিটি খুলে যাবে এবং পানিতে ডুবে যাওয়ার পর ইজ্জতের রশির অপর প্রান্তে বাধা কাঠ বা বাঁশটি ভেসে থাকবে। এটি দেখে অস্ত্রটির অবস্থান বোঝা যাবে এবং ঐ রশির সাহায্যে ডুবুরি না নামিয়েই সহজেই অস্ত্রটি উদ্ধার করা যাবে। কিন্তু ছবিতে পাওয়া রশিটি যথেষ্ট মোটা। তাহলে কে বা কারা এই রশিকে ইজ্জতের রশি বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে? নাকি ভুল ছবি বিভিন্ন জায়গায় দেওয়া হচ্ছে? হয়ে থাকলে কারা কি জন্য এটা করছে।
ঘ। লাশ ডুবাতে যে ইট ব্যাবহার করা হয়েছে সেই ইট ভাটার মালিক কি শুধুমাত্র র্যাবের অফিসের ৫০ গজ পাশের নির্মানাধীন ভবনেই ইট সরবরাহ করেছে? আর কোথাও করেনি? আর ঐ ইটভাটার অবস্থান কোথায়? এটা কি শীতালক্ষ্যার পাড়েই? ঐ ইটভাটার লোকজনকে কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে? করা হয়ে থাকলে কি তথ্য বেরিয়েছে?
ঙ। শহীদ চেয়ারম্যান কি করে ৬ কোটি টাকা লেনদেনের ঘটনাটি জানলো? এবং সে কিভাবেই বা সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাংকের নাম বললো?
চ। শহীদ চেয়ারম্যান কি করে জানলো যে কর্ণেল জিয়া নূর হোসেন কে ভারতে পালাতে সাহায্য করেছে?
ছ। শহুীদ চেয়ারম্যানের নামে নাকি নিহত নজরুল ইসলাম জিডি করে রেখেছিলেন। এটি সত্য হয়ে থাকলে কেন নজরুল ইসলাম নিজ শ্বশুরের নামে জিডি করবে? সেক্ষেত্রে শহীদ চেয়ারম্যান কি কিছু লুকানোর বা কিছু সাজানোর চেষ্টা করছে?
জ। র্যাব কি নিজের ইচ্ছায় ক্রসফায়ার বা গুম করে? র্যাবের কি সেই সক্ষমতা আছে? নাকি উপরের নির্দেশ/অনুমোদন পাওয়ার পরে করে? মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন কিন্তু এটা। এই ঘটনায় রয়াব জড়িত থাকলে সেটা কি তাদের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের অংশ? নাকি ব্যাক্তিগত লোভের তাড়নে এমনটি করেছে?
ঝ। সেনা ও নৌবাহিনী কেন তাদের কর্মকর্তাদের অকালীন/বাধ্যতামূলক অবসর দিলো? তারা প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে জড়িত এমন কোন প্রমান কি বাহিনীদ্বয়ের কাছে আছে? নাহলে অবসর কেন দিবে?
ঞ। মহামান্য আদালতের অভিযোগ না থাকলে প্রয়োজনে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করার আদেশ দেয়াটা কি পরবর্তীতে নিরপেক্ষ মানদন্ড বজায় রাখতে স্ববিরোধী হয়ে যাবে না তো? ব্যাপারটা এমন দাড়াচ্ছে না, সে অমুককে ধরে আনো, আমি তারই বিচার করবো? আবার একদিক দিয়ে দেখলে ঠিকই আছে যে আদালত শক্ত অবস্থান না নিলে হয়ত র্যাবের সাবেক ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হয়ত কোন ব্যবস্থাই নেওয়া হত না। আদালত যদি "কেন তাদেরকে আসামী হিসেবে নথিভুক্ত ও গ্রেফতার করা হবে না" মর্মে রুল জারি করত, তাহলে কি নিরপেক্ষ মানদন্ড বজায় রাখতে সুবিধা হতো না?
ত। নূর হোসেনের সাথে ডিসি-এসপিদের ছবি দেখার পরেও আদালত তাদের বিষয়ে কোন রুল কেন জারি করলো না? এ ব্যাপারে রীট দায়ের না হওয়া কারন হতে পারে কি না? সেক্ষেত্রে ডঃ কামাল হোসেন ব্যাপারটি কেন এড়িয়ে গেলেন?
থ। নুর হোসেনের মত লোককে একাধিক অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ঘটনা কেন আদালত আমলে নিলো না? এ ব্যাপারে রীট দায়ের না হওয়া কারন হতে পারে কি না? সেক্ষেত্রে ডঃ কামাল হোসেন ব্যাপারটি কেন এড়িয়ে গেলেন?
ঠান্ডা মাথায় এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা খুব জরুরী। একটা জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমাদের দেশে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিচারের চেয়ে এই হত্যাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ব্যাবসা বেশী হয়। হতভাগা ৭ জন রাজনৈতিক ব্যাবসার মূলধনে পরিনত হচ্ছে না তো?
চলুন, পক্ষ না নিয়ে ভালোভাবে আলোচনা করি।