somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্যক্তি, সিনেমা আর ঋত্বিক

২২ শে নভেম্বর, ২০১২ সকাল ৭:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটি সাক্ষাত্কারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘চলচ্চিত্র নির্মাণে কী ভাবে উদ্বুদ্ধ হলেন?’ উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘‘আমি একটি ‘জিগজ্যাগ’ পথ ধরে ফিল্মে এসে পড়েছি। বাবার ইচ্ছে পূরণ হলে এক জন ‘ইনকাম-ট্যাক্স অফিসার’ হতাম। কিন্তু সেই চাকরিটি পেয়েও আমি ছেড়ে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিই। চাকরিতে থাকলে আজ কমিশনার বা অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল হতাম, হয়তো। কিন্তু এখন আমি শুধুই একটি ‘রাস্তার কুকুর’।’’ নিজের সম্পর্কে অবলীলায় এমন মোহহীন কথা যিনি বলেছিলেন এ বারের অতীতের তাঁরায় অদ্বিতীয় সেই ঋত্বিক ঘটক।
চলচ্চিত্রের আকাশে যে ক’টি বাঙালি নক্ষত্র তার নিজস্ব দ্যুতি নিয়ে যথেষ্ট উজ্জ্বল, তাদেরই অন্যতম ঋত্বিক।
যাঁর পরিচালিত প্রতিটি চলচ্চিত্র— ‘নাগরিক’ থেকে ‘যুক্তি তক্ক আর গপ্পো’— বাংলা সিনেমার এক একটি মাইল ফলক, তিনি ঋত্বিক।
যে তরুণটি এক সময় গল্প লিখত, চুটিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি করত, গণনাট্যের কর্মী হয়ে শহরে-বন্দরে ঝোড়ো হাওয়ার মতো ঘুরে বেড়াত, একটার পর একটা নাটক লিখে যেত, সেও ঋত্বিক।
পদ্মার ধারে রূপকথার দেশের স্বপ্ন দেখে যে জীবনের শুরু, তার পর যুদ্ধ-মন্বন্তর-দাঙ্গা-দেশভাগ পার করে দুই বাংলার ক্ষতবিক্ষত রাজপথে হেঁটেছিলেন যিনি, তিনিও ঋত্বিক।
শেষপর্যন্ত ‘একসঙ্গে লক্ষ মানুষের কাছে নিজের কথা এখুনি বলতে চলচ্চিত্রই একমাত্র মাধ্যম’ বলে মনে করতেন যিনি, বাংলা সিনেমার তিনিই ‘ঋত্বিক’।

যুগসচেতন চলচ্চিত্রকার, গল্পকার, নাট্যকার, অভিনেতা সেই মানুষটি সারা জীবন ধরে আসলে ভেবেছেন মানুষের কথা। মানুষের হয়েই কথা বলে তাঁর প্রতিটি সৃষ্টি, আজও। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর। এখনকার বাংলাদেশের ঢাকার জিন্দাবাজারে জন্মেছিলেন, তিনি ঋত্বিক ঘটক।

পরিবার ও রাজশাহী
ঋত্বিকের বাবা সুরেশচন্দ্র ঘটক, মা ইন্দুবালাদেবী। ৯ ভাইবোনের মধ্যে ভবা (ঋত্বিকের ডাক নাম) ও ভবি (প্রতীতি) ছিলেন শেষ যমজ সন্তান। সুরেশবাবু পেশায় ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। বদলির চাকরি। সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেফিরে শেষে অবসরের পর রাজশাহীতে গিয়ে বাড়ি করেন। সেই বাড়িটিই এখন ‘ঋত্বিক ঘটক হোমিওপ্যাথিক কলেজ’। ঋত্বিকের শৈশবের একটা বড় অংশ কেটেছে রাজশাহীতে। সেখানকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, পরে রাজশাহী কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বিএ পাশ।

সাহিত্য, নাটক ও গণনাট্য
বাড়িতে ছিল সাংস্কৃতিক ধারা। বাবা সুরেশচন্দ্র ঘটক প্রতি দিন সকালে গাইতেন ‘তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করো...’, মা ইন্দুবালা সন্ধেবেলায় বাইরের ঘরে পিয়ানো বাজাতেন। পরিবারের ছেলেমেয়েরা সেখানে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকত।

ছাত্রাবস্থায় লেখক হিসেবে ঋত্বিকের বেশ পরিচিতি ছিল। ‘অভিধারা’ নামের একটি কাগজও প্রকাশ করতেন। নিজের লেখা ছোটগল্প ‘অয়নান্ত’ অভিধারায় ছাপা হয়েছিল। তাতে একটি লাইন লিখেছিলেন— ‘আমার বাইরের রহস্যটা জানতে হলেও তো আগে চাই নিজের সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান’। সে কারণেই হয়তো, ওই বয়সেই বাড়ি থেকে দু’তিন বার পালিয়েছেন ঋত্বিক। কানপুরে একটা টেক্সটাইল ডিপার্টমেন্টেও কাজ করেছেন কিছু দিন। শেষে ১৯৪২ সালে, কানপুর থেকে বাড়ির লোকজন ঘরে নিয়ে এলেন। মাঝখানে দু’বছর পড়াশোনাও দিলেন ছেড়ে। বাবা সুরেশচন্দ্র ঘটক বলেছিলেন, ম্যাট্রিক পাশ করলে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়। নতুবা মিস্ত্রি। হঠাৎ পড়াশোনায় মন আসে। এরই মধ্যেই রাজনীতিতে তাঁর ঢুকে পড়া!

১৯৪৩-৪৫ সাল— চারদিকের নানা ঘটনার প্রতিবাদ ঋত্বিকের গল্পের প্রেক্ষাপট হয়ে উঠল। ‘মাই কামিং ইনটু ফিল্মস’ শীর্ষক একটি লেখায় ঋত্বিক লিখছেন, “শুরুর দিকটায় লেখক ছিলাম। কেরিয়ার শুরুর সময়ে, সেই ১৯৪৩ সাল পরবর্তী সময়ে আমি প্রায় শ’খানেক ছোটগল্প ও দু’টি উপন্যাস লিখি। তখন চারদিকের নানা পরিস্থিতি আমায় সব সময় ভীষণ ভাবে অস্থির করে তুলত।”

দেশভাগের সময় কালেই ঘটক পরিবার বাংলাদেশ থেকে এ পারে চলে আসে।

ঋত্বিকের বড়দা মণীশ ঘটক ছিলেন কল্লোলযুগের নাম করা কবি। সেই সুবাদে বাড়িতে একটা সাহিত্যের পরিবেশ ছিল। শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, গোপাল হালদার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়রা বাড়িতে আসতেন। এখান থেকেই ‘নবান্ন’ নাটকের দিকে ঝুঁকলেন ও আইপিটিএ-র সদস্য হলেন।

১৯৪৮ সালে ঋত্বিক তাঁর প্রথম নাটক ‘কালো সায়র’ লিখেছিলেন। ওই বছরেই বিজন ভট্টাচার্য ও শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় নতুন আঙ্গিকে ‘গণনাট্য’ প্রযোজিত ‘নবান্ন’ নাটকে অভিনয় করেন। বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ দেখে গণ আন্দোলনে তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর লেখা ‘কলঙ্ক’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্তের সঙ্গে ঋত্বিক। ওই সময় কালে অর্থাৎ ১৯৪৮-৫৪ সাল পর্যন্ত ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল ঋত্বিকের। লাভ করেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদও। হাজরার প্যারাডাইস কাফেতে সে সময় নিয়মিত আলোচনা হত সিনেমা-নাটক নিয়ে। সেখানে আসতেন হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, নবেন্দু ঘোষ, মৃণাল সেন, বিজন ভট্টাচার্য, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, উমানাথ ভট্টাচার্য, ঋত্বিকেরা। ১৯৪৯ সালে নিজের নাটকের দল গড়েন ঋত্বিক— নাট্যচক্র। সেখানে নীলদর্পণ নাটকে অভিনয়ও করেন। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের প্রযোজনায় ঋত্বিক পরিচালনা করেছিলেন নাটক ‘ঢেউ’ (বীরু মুখোপাধ্যায়), ‘জ্বালা’, ও ‘ম্যাকবেথ’।

চলচ্চিত্র ও ঋত্বিক
১৯৪৮ সাল থেকেই চলচ্চিত্র আন্দোলনে একজন ‘কর্মী’ হিসেবে ঋত্বিক জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৯ সালে মনোজ ভট্টাচার্যের ‘তথাপি’ নামক ছবিতে তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এর পরের বছরই নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’-এ ঋত্বিক শুধু সহকারী পরিচালক নন, অভিনয়ও করলেন যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে। তবে একক ভাবে তাঁর প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’ (১৯৫২)। আর্থিক কারণে, তখন তো বটেই, এমনকী ঋত্বিকের জীবদ্দশাতেও ছবিটি মুক্তি পায়নি। ১৯৭৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নিউ এম্পায়ারে ছবিটি মুক্তি পায়। ১৯৫৮ সালের মে মাসে ‘অযান্ত্রিক’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

অল্প ক’টি ছবি পরিচালনা করেছিলেন, তবে ঋত্বিকের মুক্তিপ্রাপ্ত সব ক’টি ছবিই বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল— ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ (১৯৫৯), ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০), ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১), ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬২), ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশে তাঁর তৈরি ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ইত্যাদি। ১৯৭৪ সালে নির্মিত তাঁর শেষ ছবি স্বরচিত কাহিনি অবলম্বনে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে মিনার-বিজলি-ছবিঘরে মুক্তি পায়। পাশাপাশি মুম্বইতে হিন্দি চিত্রনাট্য রচনার কাজও করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। বিমল রায়ের ছবি ‘মধুমতি’র চিত্রনাট্যকারও ছিলেন তিনি। ১৯৬৬-৬৭ সাল নাগাদ বেশ কিছু দিন তিনি পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ভাইস-প্রিন্সিপাল পদে কাজ করেছেন শিক্ষক হিসেবে।

হঠাত্ সিনেমায় কেন
ঋত্বিকের চলচ্চিত্র জগতে আসার অনেকগুলো কারণ ছিল। তাঁর মেজদা (সুধীশ ঘটক) ছিলেন ‘টেলিভিশন এক্সপার্ট’। তিনি গ্রেটব্রিটেনে ডকুমেন্টারি ক্যামেরাম্যান হিসেবে ছ’বছর কাজ করেন। পরে সুধীশবাবু নিউ থিয়েটার্সে যুক্ত হন। বহু ছবিতে ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করেছেন তিনি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাননবালা-সায়গলের ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’। বাড়িতে আসতেন বড়ুয়াসাহেব থেকে বিমল রায় পর্যন্ত অনেকেই। আর পাঁচজন যেমন ওঁদের ছবি দেখেন তেমনই ঋত্বিক ওই সব ছবি দেখে বিশেষ উৎসাহ পেতেন। কারণ দাদার সঙ্গে তাঁদের আড্ডা চলত বাড়িতেই।

‘পরিবার’ সংবাদ
ঋত্বিক ঘটক ১৯৫৫ সালের ৮ মে বিয়ে করেন। স্ত্রী সুরমা ঘটক ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। নবদম্পতি প্রথমে হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে থাকার পরে ‘বোম্বে’র গোরেগাঁওয়ের একটি ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিল। তাঁদের দুই কন্যা— সংহিতা ও শুচিস্মিতা এবং একমাত্র পুত্র ঋতবান।

শেষের সে দিন
লিভারের রোগে ভুগছিলেন দীর্ঘ দিন। ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার শেঠ সুখলাল করোনারি হাসপাতালে এই বিশিষ্ট শিল্পীর মৃত্যু হয়। মারা যাওয়ার সময় স্ত্রী সুরমাদেবী কাছে ছিলেন না। তিনি তখন সাঁইথিয়ার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন তাঁকে খবর পাঠান— Ritwik Ghatak expired.

‘ঋত্বিক’ সম্পর্কে তাঁদের কথা
শক্তিপদ রাজগুরু (লেখক): সাত বছর আমি ঋত্বিকের সঙ্গে ঘর করেছি। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ‘কুমারী মন’, ‘কোমল গান্ধার’ ও ‘সুবর্ণরেখা’ পর্যন্ত ওঁর সঙ্গে ছিলাম। পরে আমি অন্য কাজে মুম্বই চলে যাই শক্তি সামন্তের কাছে। আমাদের একটা জমাটি টিম ছিল। কোমল গান্ধারের পর থেকে টিম ভাঙতে শুরু করে। অনিল চট্টোপাধ্যায় অজ ফিল্মস্-এর সহকারী পরিচালক ছিলেন। ঋত্বিক ওকে প্রথম ব্রেক দিল ‘মেঘে ঢাকা তারা’য়। শিলং-এ শ্যুটিং করতে গিয়ে আমি আর অনিল এক ঘরে থাকতাম। তখনও কিন্তু ঋত্বিক ওই সব হাবিজাবি পান করত না। সিগারেট পর্যন্ত খেত না। দিনে ২-৩ বান্ডিল বিড়ি লাগত। তখনই দেখেছিলাম ওঁর মধ্যের স্বকীয়তা। সিনেমা ছাড়া সাহিত্য নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা ছিল। আমাদের মধ্যে নানা বিষয়ে গভীর আলোচনা হত। ছবি নিয়েও অনেক আলোচনা হত। আমি সাহিত্যের ব্যাপারে এখান থেকে উপকৃত হতাম। আমাকে প্রায়ই বলতেন, ‘‘অথর, চিত্রনাট্য লেখাটা শেখো, আখেরে কাজ দেবে।’’ মুম্বই ও ঋত্বিকের স্কুলিং মিশিয়ে আমার চিত্রনাট্য শুরু হল। ঋত্বিক রিডিং পড়ত খুব ভাল। রিডিং পড়া ও শোনার জন্য একটা পরিবেশ তৈরি করত। ঘরের সব আলো নিভিয়ে মাঝখানে একটা টেবলে, টেবল ল্যাম্প জ্বালিয়ে ও পড়ত। আমরা শুনতাম সেই ‘রাজকাহিনী’, ‘আরণ্যক’...। আমি, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বৌধায়ন চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে-সহ আরও অনেকে।


মহাশ্বেতাদেবী (লেখিকা ও ঋত্বিকের ভাইঝি): ঋত্বিক আমার কাছে ভবা। ঠাকমা-ঠাকুরদাদার শেষ সন্তান ভবা। আর আমি ঋত্বিকের বড় দাদার প্রথম সন্তান। সেই সূত্রে আমরা দু’জন ছিলাম বন্ধু। ভাইবোনের মতোই মানুষ হয়েছি। ও আমাদের বাড়িতে থাকত। মা ওকে বকেঝকে স্কুলে পাঠানোর চেষ্টা করতেন। ভীষণ দুরন্ত আর দুষ্টু ছিল। খেলার পাশাপাশি অসম্ভব বই পড়তে ভালবাসত। আমাদের খুব বড় পরিবার ছিল। পিসিদের উৎসাহে বাড়ির ছাদে চৌকি তুলে মঞ্চ তৈরি করা হত। থিয়েটার করতাম সকলে। ভবার হাতের আঁকাও ছিল খুব ভাল। গান-পাগল মানুষ। সব ধরনের গান শুনত। সংসারকে অসম্ভব ভালবাসত। কি উচ্চতার সব সিনেমা করেছে! খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম, ফলে তার চলে যাওয়া মর্মান্তিক ছিল আমার কাছে। সেই দিনটা মনে পড়ে, বাবা তখন থাকতেন বহরমপুরে। আমি আর মা বাইরের ঘরে বসে আছি, বাবা এসে বললেন, ‘‘আজ আর আমাকে মাছ-মাংস খেতে দিও না। ভবা চলে গেছে।’’


গৌতম ঘোষ (চলচ্চিত্র পরিচালক): ঋত্বিকদা অনেক দিন হল আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তবুও তাঁর ছবিগুলি আজও সমান মূল্যবান আমার কাছে। ছবির মূল সুর যেন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে। আমার বা আমাদের বাড়ির সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ ছিল তাঁর। বাড়িতে খুব আসতেন। আমার বাবা ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা চলত। উনি বাবাকে আশ্বস্ত করেছিলেন আমার ফোটোগ্রাফি নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে। আমি তখন ডকুমেন্টারি করছি আর ওঁর চ্যালা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ‘ইউনিক’ এক মানুষ ছিলেন। ওঁর সঙ্গে থেকে অনেক শিক্ষা লাভ করেছি। এক বার মুম্বইয়ের এক হোটেলের ঘরে ছিলাম। আমার ‘হাঙরি অটাম’ ডকুমেন্টারি দেখে বেরিয়ে এসে পশ্চাৎদেশে একটি পদাঘাত করে বলেছিলেন, তুই এগিয়ে যাবি। ঋত্বিকদার সিনেমা সেই সময়কার তুলনায় অনেক আধুনিক ছিল। নিজস্ব দৃষ্টিকোণ ছিল। সেই সময় অনেকেই সমালোচনা করেছিলেন ওঁর সিনেমায় ‘মেলোড্রামা’ ছিল বেশি। কিন্তু আমার তা কখনওই মনে হয়নি। ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’য় চরিত্রের যে চূড়ান্ত যন্ত্রণার পরিচয় পাওয়া যায়, এমন ঘটনা খুব কম ছবিতেই দেখা যায়। তাঁর কাজে মুন্সিয়ানা ছিল। ‘মাইথোলজি’ বা লোকগাথার প্রতি তাঁর টান ছিল নিবিড়।


ব্রাত্য বসু (নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক): চলচ্চিত্র এবং প্যাশন এই শব্দ দু’টি এখন পরস্পরবিরোধী। একটা সময় ছিল যখন এই দুই শব্দের মধ্যে এক অন্তরঙ্গ ও নিবিড় যোগাযোগই প্রধান নিয়ন্ত্রক ছিল। আর এই নিয়ন্ত্রণের সর্বতম স্মারক ঋত্বিক ঘটক। প্রথম ছবি থেকেই যে পরিচালক নিয়তি-নির্ধারিত হয়ে যান, ‘নাগরিক’ মুক্তির জন্য যাঁকে অপেক্ষা করতে হয় দশকের পর দশক, তাঁর পক্ষে পরবর্তী কালে ওই রকম এলোমেলো, বেহিসাবি, আমাদের আনাপাই জগতে খাপ খাওয়াতে না পারা, এক লাগামহীন বুনোঘোড়া হয়ে ওঠাই কি ঋত্বিকের পক্ষে স্বাভাবিক ছিল না?



ঋত্বিক ঘটক
অভিনয়
সিনেমা— ‘তথাপি’, ‘ছিন্নমূল’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘কুমারী মন’, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’।
নাটক— ‘দলিল’ ‘ভাঙাবন্দর’, ‘বিসর্জন’, ‘জ্বালা’, ‘সেই মেয়ে’।

কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: নাগরিক, কোমল গান্ধার, বগলার বঙ্গদর্শন (অসম্পূর্ণ), দুর্বার গতি পদ্মা, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো ইত্যাদি।

চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: অযান্ত্রিক, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘কত অজানারে’ (অসম্পূর্ণ), ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান’ (তথ্যচিত্র), ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘আমার লেনিন’।

অন্যের ছবিতে চিত্রনাট্য লিখেছেন:‘মধুমতি’ (হিন্দি, বিমল রায়), ‘মুসাফির’ (হিন্দি, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়), ‘স্বরলিপি’ (বাংলা, অসিত সেন), ‘কুমারী মন’ (বাংলা, চিত্ররথ), ‘দ্বীপের নাম টিয়া রঙ’ (বাংলা, গুরু বাগচী), ‘রাজকন্যা’ (বাংলা, সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘হীরের প্রজাপতি’ (বাংলা)।

ঋত্বিক রচিত চিত্রনাট্য বা খসড়া: ‘সাত লহরী’, ‘যাদের কেউ মনে রাখে না’, ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’, ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’, ‘আরণ্যক’ ‘বলিদান’-সহ ২১টি।

স্বল্প দৈর্ঘের ছবি: ‘সির্জাস’, ‘ফিয়ার’, ‘রাদেভুঁ’, ‘সায়েন্টিস্ট অফ টুমরো’, ‘পুরুলিয়ার ছো-নৃত্য’, ‘আমার লেনিন’, ‘দুর্বার গতি পদ্মা’, ‘ইয়ে কিঁউ’।

পুরস্কার: পদ্মশ্রী, ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড রজত কমল, সেরা গল্পের জন্য (যুক্তি-তক্কো আর গপ্পো), সেরা পরিচালক (বাংলাদেশ) (তিতাস একটি নদীর নাম)।

প্রবন্ধ: ১৯৬৬-৬৭ সালে লিখেছিলেন বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল ‘আমার ছবি’, ‘চলচ্চিত্র চিন্তা’, ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক চিত্র ও আমি’, ‘আজকের ছবির পরিণতি’, ‘শিল্প ছবি ও ভবিষ্যৎ’

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১২ সকাল ৭:১৩
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×