আমার জন্ম কোন দেশের কোন কারখানায় হয়েছে তা সম্পর্কে আমার খুব একটা স্পষ্ট ধারণা নেই । বডি লাগানোর পর থেকে(আপনারা যাকে বলেন জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ) নিজেকে অন্য জ্ঞাতি ভাইয়ের সাথে স্টেশনারী স্টোরে নিজেকে আবিস্কার করেছি । সেখানে অত্যন্ত একঘেয়ে দিন কাটছিল । এরপর একদিন আমার বক্স খুলল(আপনাদের ভাষায় কপাল খুলল) । একজন লোক এসে আমিসহ আমার দশ জ্ঞাতি ভাইকে কিনে নিতে এল । এরপর আমরা দশ ভাই একটি হলুদ পিকআপে করে আমাদের নতুন ঠিকানায় রওনা দিলাম ।
সেখানে পৌঁছবার পরে আমাদেরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মেঝেতে রাখা হল । যখন আমরা বুঝতে পারলাম আমাদেরকে এখন আলাদা করে নানা জায়গায় পাঠিয়ে দেয়া হবে তখন আমরা একজন আরেকজনকে উদ্দেশ্য করে শেষবারের মত ইনডিকেটরের কাঁটাটা খুব সূক্ষভাবে নেড়ে দিলাম । সূক্ষ মানে আসলেই সূক্ষ, মানুষের চর্মচোখে তা কিছুতেই ধরা পড়বে না । এরপর যথারীতি আমরা আলাদা হয়ে গেলাম ।
আমাকে যে কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল যেখানে অনেক যন্ত্রপাতি দেখতে পেলাম । কিছুদিন যাওয়ার পর বুঝতে আসলে এই কক্ষটি একটি অপারেশন থিয়েটার । অপারেশন থিয়েটার হলেও সকালবেলার দিকে অনেক ভিড় থাকে । ডাক্তার, ইন্টার্নি, এপ্রন পরিহিত একগাদা ছাত্রছাত্রী, সিস্টার, ব্রাদার সবাই মিলে এক বিশাল অবস্থা । মেডিকেল স্টুডেন্ট আপু-ভাইয়ারাই আমার সবচেয়ে বেশি কাছে থাকেন । তারা যখন আমার ইন্ডিকেটরকে ‘শূন্য’দাদার সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকতে দেখেন, তখন তাদের বেশিরভাগই নিজেদের আর সামলাতে পারেন না । আমার রিডিং নিয়ে রোগীকে ওটি টেবিলে ওঠানোর পরপর স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভয়াবহ অসচেতন ব্যক্তিরাও তাদের বিশাল বপু নিয়ে আমার ছোট্ট দেহের ওপর চেপে বসেন । এক-দুজন হলে তাও এক কথা ছিল, কিন্তু একজনের দেখাদেখি পর্যায়ক্রমে সবাইকে রিডিং দিতে বাধ্য হই আমি ।
সবাই অনেক উৎসাহ নিয়ে একজনের পর আরেকজন আমার ওপর দাঁড়িয়ে রিডিং দেখে, ৭০/৮০/৯০ কেজি রিডিং দেখেই তাদের বেশিরভাগের মুখ কালো হয়ে যায় । তখন আমার একধরণের পৈশাচিক আনন্দ হয় । হবেই না কেন বলুন, আমি মানুষ না হতে পারি কিন্তু এত চাপাচাপি আর কাহাতক সহ্য হয়? সহ্য না হলেও উপায় নেই, শুক্রবার ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই চলে এই অত্যাচার ।
তবে সত্যি কথা বলতে, আমি হয়ত আপু-ভাইয়াদের সন্তুষ্ট করতে পারি না কিন্তু আমি রিডিং দেয়ার পর যেসমস্ত রোগীর অপারেশন হয়, তাদের সুস্থ হয়ে বাড়ি যেতে দেখলে নিজেকে কিছুটা হলেও স্বার্থক মনে হয় । প্রতিদিনের কাজের ‘চাপ’ এর মাঝে এটাই আমার একমাত্র তৃপ্তি ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১৬