somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওয়াকা ওয়াকা –ট্যুর আফ্রিকা

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কর্মসূত্রে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভরিকোস্টে আছিগত মাস দশেক ধরে। এ বছরে আমার ব্যক্তিগত পরিকল্পনা ছিল ইউরোপ ট্যুরে যাওয়ার। সে অনুযায়ী ‘সেঞ্জেন’ ভিসা পর্যন্ত নেয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যথাসময়ে বাধ সেধে বসল অনিবার্য ব্যক্তিগত অসুবিধা, যে কারনে ইউরো ট্যুর ক্যান্সেল করে আমাকে সরাসরি বাংলাদেশ চলে যেতে হয়েছে। ছুটি শেষে দেশ থেকে ফিরে ভাবলাম, ইউরোপ ট্যুর যখন হলনা কি আর করা? নাইবা গেলাম ইউরোপ,এখন দুধের সাধ ঘোলে মেটানো যাক। আশে পাশের কয়েকটা আফ্রিকান দেশ ঘুরে দেখলে কেমন হয় ? ইউরোপে তো সবাই যায়, কিন্তু এ দিকটায় তেমন একটা আসেনা কেউ। অতএব আফ্রিকা ভ্রমনের এ বিরল অভিজ্ঞতা মিস করা যাবে না। ফেসবুকের কল্যাণে অনন্ত জলিলের ‘ইউ পম গানা’ ডায়লগটা তো এখন সব জায়গায় সুপার ডুপার হিট।

এ কারনে ঘানা দেশটা দেখার প্রচণ্ড আগ্রহবোধ জন্মাল মনে। সিদ্বান্ত নিলাম; সড়ক পথে লাইবেরিয়া যাব। সেখান থেকে আকাশ পথে ঘানা, এরপর টোগো-বেনিন হয়ে নাইজেরিয়া। যেই ভাবা সেই কাজ। ছয় জনের একটা অভিযাত্রী দল তৈরি হয়ে গেল আমাদের। অভিযাত্রী বলার কারণ সড়ক পথে চড়াই উৎরাই, দুর্গম পথ পেরিয়ে যেভাবে আমরা লাইবেরিয়া পৌঁছুলাম, এর সাথে একমাত্র চন্দ্রাভিযানেরই তুলনা চলে! সে প্রসঙ্গে আসছি পরে।

আমাদের যাত্রার দিন নির্ধারিত হল ২৮ নভেম্বর ২০১২। এরআগেই আমরা সকল ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেললাম। আমাদের দলের নেতৃত্ব রয়েছেন আনোয়ার সাহেব। এ ট্যুরের সার্বিক সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেওয়া হল সহকর্মী মামুন সাহেবকে। ইন্টারনেট ঘেঁটে তিনি বিস্তারিত প্ল্যান করে ফেললেন কোথায় কোথায় ঘুরবো আমরা। অতি উৎসাহী সহকর্মী মোহাম্মদ সাহেব তথ্য দিলেন- নেট ঘাঁটাঘাঁটি করে তিনি টোগো-বেনিনে কোন টুরিস্ট স্পট খুঁজে পান নি।

আমরা বললাম, সেটা পরে ভেবে দেখা যাবে, আগে ঘানা পর্যন্ত যাওয়া যাক। ও হ্যাঁ, এ ট্যুরে আমি পেয়েছি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব। অল রাবিশ!
নির্ধারিত দিনে দুপুর সাড়ে বারোটায় আইভরিকোস্টের ‘মান’ শহর থেকে আমরা যাত্রা শুরু করলাম ‘দানানে’র উদ্দেশ্যে। ওখানে থাকেন আমাদের প্রাণপ্রিয় সহকর্মী মামুন সাহেব। মান থেকে দানানে যাওয়ার পথে আশে পাশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য অবলোকন করলাম বিমুগ্ধ নয়নে।

কত রকমের যে নাম না জানা জংলী ফুলের সমারোহ রয়েছে ঝোপ ঝাড়ের ভেতরে তার কোন ইয়ত্তা নেই।

বিভিন্ন ধরনের গাছ গাছালীতে দেখলাম দৃষ্টি নন্দন রং বেরঙের পত্র পল্লবের সমাহার। এ যেন চির বসন্তের দেশ। এ সব অপূর্ব দৃশ্য দেখলে মন আপনা থেকে হয়ে উঠে প্রফুল্ল। মান-দানানে এলাকাটি অসংখ্য পাহাড়, টিলা আর অজস্র বৃক্ষরাজীতে পরিপূর্ণ।

রাস্তার সন্নিকটে লোকালয়ের দেখা মেলে কম। উদাস মনে দূরের দিগন্ত রেখায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে চোখে পড়ে উঁচু পাহাড়, পেজা তুলোর মত মেঘ আর ঘন অরণ্যের ত্রিমুখী মিতালীর এক রোমাঞ্চকর দৃশ্য।
আমাদের গাড়ি চলছে সাঁই সাঁই করে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে। ফরাসীরা এ দেশ থেকে অনেক সম্পদ লুটে নিলেও রাস্তাঘাট গুলো তৈরি করে দিয়েছে ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ডে।

মসৃণ ফিট ফাট রাস্তা পেয়ে গাড়ির গতি যেন ক্রমান্বয়ে আরও বাড়ছিলো। অবশ্য রাস্তার দুই পাশ অবৈধ দখলের কবলে পড়ে চওড়া রাস্তাটাও হয়ে পড়েছে সংকুচিত! না এ অবৈধ দখলদার কোন কোন ফুটপাথের হকার কিংবা মনুষ্য সন্তান নয়। এরা হল রাস্তার দুই পাশে বেড়ে উঠা ঘন জংলী গাছ! এদের আগ্রাসনে রাস্তার বাঁক গুলিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে চালককে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো। কিছু বিজ্জনক মোড়ে বিপরীত দিক থেকে আসা কোন গাড়ি দেখা যাচ্ছিলোনা। অগত্যা দুর্ঘটনা এড়াতে এসব মোড়ে চালককে গাড়ি চালাতে হয়েছে শম্বুক গতিতে। মাঝে মধ্যে দুই একটা সাপকে দেখলাম গাড়ির সামনে দিয়ে বিপদজনক ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে রাস্তা পার হতে। গাঢ় সবুজ ওদের গায়ের রং। লম্বায় প্রায় ৩/৪ ফুট। গাড়ির নিচে চাপা পড়েও প্রায় সময় কিভাবে যেন ওরা চাকা এড়িয়ে বেঁচে যায়।
এ এলাকার অধিকাংশ বাড়ি ঘরই মাটির তৈরি।

কাঠ কিংবা পাম গাছের ডাল দিয়ে তৈরি বেড়ার উপর এঁটেল মাটির আস্তর দিয়ে তৈরি হয় ঘরের দেওয়াল। ঘরের আকৃতি হয় গোলাকার আর উপরে থাকে পাতার ছাউনি। অবশ্য কিছু স্কয়ার আকৃতির দোচালা বাড়িও নজরে আসলো আমার।


মহাসড়কের পাকা রাস্তার পাশে এক আইভরিয়ান কিশোরীকে দেখলাম আপন মনে ধান শুকাচ্ছে রোদে, ঠিক যেভাবে রূপসী বাংলার গৃহবধূরা বাড়ির উঠানে ধান শুকাতে দেয়। ছবি তুলছি টের পেয়ে মেয়েটা কেমন যেন একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল। গ্রাম্য বালিকা তো , তাই হয়তো একটু লজ্জ্বা পেয়েছে। কিছুদূর যাবার পর একই ভাবে রাস্তার উপর কোকো, কফি আর কাশাভা ও শুকাতে দেখলাম।


যেতে যেতে সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা এ দেশটির সাথে কল্পনায় তুলনা করছিলাম নিজের দেশকে। মনে পড়ল একটি দেশাত্ববোধক গান –
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে
পাবে নাক তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে
আমার জন্ম ভূমি...।
আপন মনে ভাবলাম, দেশে যে হারে কৃষি জমি বিলুপ্ত হচ্ছে আর বনাঞ্চলের বৃক্ষ নিধন চলছে বেপরোয়া ভাবে, তাতে রূপসী বাংলার চিরায়ত সবুজ শ্যামল রূপের কতটুকুই আর অবশিষ্ট আছে আজ।

কথা প্রসঙ্গে সেদিন এক সহকর্মী তো বলেই ফেললেন – বাংলাদেশের সে যুগের কবি সাহিত্যিকগণ নিশ্চয় তেমন বিদেশ ভ্রমণ করেন নি। যদি করতেন তাহলে রূপসী বাংলার বন্দনা এরকম একতরফা ভাবে প্রকাশ করতে তারা দ্বিতীয় বার চিন্তা করতেন। আমি অবশ্য তাঁর সাথে ভিন্নমত পোষণ করলাম। স্বদেশ বন্দনা কিংবা দেশাত্বমুলক কবিতা ও গান লেখা হয় আবেগ আর দেশপ্রেমের অনুভূতি দিয়ে। তাই এতে উপমার আতিশয্য থাকা অস্বাভাবিক নয়।


রাস্তার ঢাল আর পাহাড়ের পাদদেশে ফুটে থাকা নাম না জানা বিভিন্ন ধরণের জংলী ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কখন যে দানানে চলে আসলাম টের পেলাম না। গিয়ে দেখি মামুন সাহেব আমাদের জন্য ব্যাপক ভুরিভজের আয়োজন করে রেখেছে। ভোজন রসিক হিসাবে উনার বেশ সুখ্যাতি আছে। উনি নিজেও একজন পাকা রাঁধুনি। তাঁর রান্নার হাত বেশ ভালো। কিন্তু কে জানত আমাদের জন্য একটা দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে ওখানে। এতে আমাদের ভ্রমণের উৎসাহে ব্যাপক ভাটা পড়ে গেল। মামুন সাহেব নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁর রুমে গিয়ে দেখি একটা পা হাতে নিয়ে খাটের উপর বসে আছেন তিনি। পা টা ভীষণ রকম ফোলা। হাঁটুতে নাকি ইউরিক এসিড জমেছে। ডাক্তারের কড়া বারণের কারনে এ অবস্থায় তিনি ট্যুরে যেতে সাহস পেলেন না। ট্যুরের মধ্যমণিকে হারিয়ে বেশ হতাশা জন্ম নিল সবার মধ্যে। অগত্যা আমরা বাকি পাঁচ জন কোন রকম লাঞ্চ সেরে রওনা দিলাম লাইবেরিয়ার ‘লগুয়াতু’ বর্ডারের উদ্দেশ্যে।

(চলবে)
১২টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×