হিমুর সাথে কিছুক্ষণ (প্রথম অংশ)
বাংলাদেশের একটা রীতি হচ্ছে এইদেশে কিছু দিন পরপর নানা রকম বাবার উদ্ভব হয় । যেমন ঃ নাংগু বাবা,মাটি বাবা, ফু বাবা ইত্যাদি ইত্যাদি । সম্প্রতি এমনই এক বিস্ময়কর বাবার সন্ধান পাওয়া গেছে । তার নাম লোহা বাবা । তাকে স্বপ্নে পাওয়া গেছে । বিরাট ক্ষমতাধর ব্যক্তি । তিনি পানি বা অন্যকিছুতে ফু দেন না । তার কাছে বড়ো বড়ো লোহার টুকরা নিয়ে যেতে হয় এবং তিনি তাতে ফু দিয়ে দেন । সেই লোহা যদি কেউ গিলে খেতে পারে তবে,সে যা চাইবে তাই পাওয়া যাবে । আর রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া ? সেটা তো তুচ্ছ ব্যাপার । তবে লোহা বাবা কাউকে কখনো বলে দেন নি যে,এত বড়ো আস্ত লোহার টুকরা কি করে খাওয়া সম্ভব । আমি ভাবছি লোহা বাবার কাছে একবার যাবো,তবে লোহার টুকরা নিয়ে নয় । আমি যেটা নিয়ে যাবো সেটা দেখতে লোহার মতোই হবে তবে,আসলে সেটা হবে প্লাস্টিকের ।
আমি এখন লোহা বাবার আস্তানায় । আমি ভেবেছিলাম তিনি খুব সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবেন কিন্তু,এখন দেখছি তিনি আর একটু সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হলে তাকে তাল পাতার সেপাই বলা যেত । লোহা বাবাকে নাংগু বাবার আধুনিক সংস্করন মনে হচ্ছে । কাপড় সংকট মোকাবেলায় তিনিও যথেস্ট ভুমিকা রাখছেন । তিনি কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করছেন আর পাথর জাতীয় কি যেন কপকপ করে খাচ্ছেন । তার মুল্যবান “ফু” পাবার জন্য মানুষ গিজগিজ করছে । বাবার আশেপাশে কিছু মুরিদও দেখা যাচ্ছে । সম্ভবত,যৌথ বাহিনী এই ক্ষমতাধর বাবার সন্ধান পায় নি,পেলে বাবা এখন জেল হাজতে বসে তার লীলাখেলাগুলো দেখাতে পারতেন পুলিশ মামাদের সাথে । চারদিকে বিশাল লাইন করা হয়েছে । আমি লাইনের মাঝে দাড়িয়ে গেলাম । প্রায় ৪৫ মিনিট পর আমার সিরিয়াল এলো । আমি বাবার সামনে গিয়ে দাড়ালাম । লোহা বাবা খুব রেগে আছেন বলে মনে হল ।
বাবা ধমকের সুরে বললেন,তুই কি চাস ?
আমি বললাম,তোর কাছে আর কি চাইবো ? তুই কিই বা দিতে পারবি ?
বাবা বললেন,তোর মাথা ফাটামু । ফাটা মাথা দিয়া ফুটবল খেলুম ।
আমি বললাম,তার আগেই তোকে হাজতে পাঠাবো । এখন চুপ করে এই প্লাস্টিকের টুকরাটাতে একটা ফু দে,তা না হলে চড় দিয়ে তোর দাত ফেলে দেবো । আর জামা কাপড় পড়ে সোনামুখ করে বসে থাক । ওকি ! হাদার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিস কেন ?
ধমকে কাজ হল । বাবা চুপচাপ একটা ফু দিলেন । আমি সেই ফু বিশিস্ট টুকরা নিয়ে সেখান থেকে কেটে পরলাম । টুকরাটা নাতাশাকে একফাকে দিয়ে আসতে হবে। হাজার হোক এটা হচ্ছে লোহা বাবার অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন ফু বিশিষ্ট টুকরা।
মেসে এসে দেখি ম্যানেজার সাহেব আশরাফ সাহেবের সাথে জগড়া করতে করতে হাতাহাতির কাছাকাছি পৌছে গেছেন । আমি মাঝখানে গিয়ে দেয়ালের মত দাড়িয়ে পরলাম ।
ম্যানেজার সাহেব বললেন,হিমু ভাই সরে যান,আমি আজ এর শেষ দেখবো ।
আমি বললাম, ঠিক আছে অবশ্যই দেখবেন,কিন্তু আগে আমাকে শুরুটা বলুন । শুরু থেকেই তো শেষ তাই না ? শুরু না দেখেই শেষ দেখতে চাইলে তো হবে না ।
আশরাফ সাহেব চেচিয়ে উঠে বললেন,আমি মেস ছারবো না ।
ম্যানেজার সাহেব বললেন, তোর বাপ ছারবে । ৫ মাসের ভাড়া বাকী,আবার বলে কিনা মেস ছারবে না ।
আমি বাদলের কাছ থেকে নেয়া পাচ হাজার টাকা পকেট থেকে বের করে ম্যানেজার সাহেবকে দিয়ে বললাম,এই যে ম্যানেজার সাহেব এটা হলো আশরাফ সাহেবের বকেয়া ভাড়া,সাথে কিছু অগ্রীমও দেয়া হলো । এবার আপনি যেতে পারেন । নেক্সট টাইম এইসব হাউকাউ যেন না শুনি । আপনি তো মেসটাকে চাল-ভাতের বাজার বানিয়ে ফেলেছেন ।
আশরাফ সাহেব আর ম্যানেজার সাহের দুজনেই আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছেন যে,আমি যেন দেবতা গোছের কেউ,ভুল করে মেসে চলে এসেছি । আমি আমার সেই বিখ্যাত বিভ্রান্তিকর হাসি দিয়ে আমার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম ।
ঘরে এসে বিছানায় আধশোয়া হলাম । মনে কেন জানি আনন্দ হচ্ছে খুব কিন্তু, কারণটা ধরতে পারছি না । আমি কারণটা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করছি । খালুর হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি,এটাই কি কারন ? মনে হয় না । তবে এই আনন্দের পেছনে কোনো কারন নাও থাকতে পারে । মাঝে মাঝে প্রকৃ্তি বিনা কারনেই মানুষকে আনন্দ দেয় । অবশ্য বিনা কারণে দেয় বললেও ঠিক হবে না কারণ,উদ্দেশ্যহীনভাবে পৃ্থিবীতে কিছুই হয় না । আসলে প্রকৃ্তি মানুষকে সেই আনন্দটা দেয় কারণ,সে কিছুক্ষণ পরেই ওই মানুষটাকে বড় ধরণের কোনো দুঃখ দেবে বলে । এভাবে প্রকৃ্তির ইকুইলিব্রিয়াম প্রসেস ঠিক রাখা হয় । আমাকেও হয়তো সেজন্যই দেয়া হচ্ছে । আমি খুব অসহনীয় কোনো দুঃখ পাবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হলাম ।
দুঃখটা কেমন হবে ? কোনো প্রিয়জনকে হারানোর ? নাকি শারীরিকভাবে সেটা দেয়া হবে ? সেটা কি মেয়ে বিষয়ক নাকি ছেলে বিষয়ক ? এটা কি এখনি দেয়া হবে নাকি একটু পরে ? এসব ভাবতে ভাবতে আমার তন্দ্রার মত এসে গেল । কে যেন আমার সাথে কথা বলতে শুরু করলো ।
হিমু, তুমি কি চিন্তিত ?
না ।
মিথ্যে বলছ কেন ?
আমি মিথ্যে বলছি না ।
তোমাকে যে কষ্ট দেয়া হবে সেটা কি মেনে নিতে পারছো না ?
হিমুরা এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ভাবে না ।
তাহলে ভেঙ্গে পড়ছো কেন ?
আমি ভেঙ্গে পড়ছি না ।
ভালোবাসা নিজের ভেতর গোপন করে রাখলেই কি মহাপুরুষ হওয়া যায় ?
আমি জানি না ।
তোমার বাবা কি মহাপুরুষ ছিলেন ?
হ্যা ।
তাহলে তিনি ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়ে কেন বিয়ে করেছিলেন ?
আমি জানি না ।
তোমার কি ঘুম পাচ্ছে ?
না ।
কেন পাচ্ছে না,জান ?
না ।
কারণ,তুমি তো ঘুমিয়েই আছ ।
আচ্ছা ।
এখন তুমি আমার সাথে যাবে ।
কোথায় যাব ?
আমি মানব মনের ব্যাপারটা তোমাকে এখন বুঝিয়ে দেব ।
আমি বুঝতে চাই না ।
অবশ্যই চাও । চল,চল ।
না, আমি যাবো না ।
হঠাৎ করে মোবাইল বেজে উঠল । রিংটোনের শব্দে আমার তন্দ্রা কেটে গেল । নাম্বার অপরিচিত । আমি রিসিভ করে বললাম,হ্যালো ।
অপাশ থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ বলল,আপনি নাতাশা নামে কাউকে চিনেন ?
আমি বললাম,কেন ?
তিনি বললেন,আজকে সকালে নাতাশার কার অ্যাক্সিডেন্ট হয় । তাকে হাসপাতালে আনার পর একবার জ্ঞান ফিরেছিল,তখন সে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিল আপনাকে দিতে । তার পর পরই ও আবার জ্ঞান হারায় । আপনি কি হাসপাতালে এসে ওর দেয়া চিঠিটা নিয়ে যাবেন ?
আমি বললাম,নাতাশা এখন কোথায় ?
তিনি বললেন,দুপুর দুটোর দিকে ও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে ।
আমি বললাম,ও মাই গডনেস,আমি এখুনি আসছি ।
আমি হাটছি ডাক্তারের দেয়া হাসপাতালের ঠিকানাকে গন্তব্য করে । কেন জানি মনে
হচ্ছে হাসপাতালে গিয়ে দেখব নাতাশা বসে আছে । আমাকে দেখে বলবে , আপনি আবারো এসেছেন ? এবার কিন্তু আমি আপনাকে সত্যিই বিয়ে করবো ।
কোনো অজানা কারণে আমার হাসপাতালে যেতে ইচ্ছে করছে না । নিজের মধ্যে বন্দী করে রাখা আবেগগুলো যেন বুক চিরে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে । আমি এলোমেলো ভাবে হাটছি,মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবো । এমন কেন হচ্ছে আজ ? আমি কি আমার নিয়ত্রন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি ? আমি বুঝতে পারলাম,প্রকৃ্তি আজ আমাকে কঠিন পরীক্ষার সামনে এনে দাড় করিয়েছে ।
পরিশিষ্ট
রাত কয়টা বাজে বুঝতে পারছি না , কারণ সময় দেখার মত কোনো কিছু আমার কাছে নেই । মোবাইলের ঘড়ি কাজ করছে না। আকাশের তারা দেখে সময় বোঝার চেষ্টা করছি কিন্তু,পারছি না । তবে এটা যে মধ্যরাত তাতে কোনো সন্দেহ নেই । আজকের রাতটা কেন যেন খুব বেশী নিশ্চুপ মনে হচ্ছে । রাতটা যেন অন্য যেকোন রাত্রি থেকে আলাদা । কিন্তু সব কিছুই তো আগের মতই আছে । একফালি চাদ মেঘের ফাক দিয়ে উকি দিচ্ছে । তারাগুলোও বিলীন হয়ে যাচ্ছে কোথায় যেন । বাদলের কথা ভেবে খারাপ লাগছে কারণ নাতাশাকে সে ভালোবাসত। আমি এখন নদীর ধারে বসে আছি নাতাশার রেখে যাওয়া চিঠি নিয়ে । চিঠিটা লাল একটা খামের ভেতর ভরা। চিঠি পড়তে ইচ্ছে করছে না । হালকা আলো এসে পরেছে আমার উপর । কিসের আলো এটা ? আকাশে তো কোনো চাদ নেই এখন,পুরোটাই মেঘে ঢেকে গেছে,তাহলে ? এই আলোতে ইচ্ছে করলে চিঠিটা পড়া যায় । কিন্তু পড়ে কি লাভ ? চিঠি কি পারবে বাস্তবকে বদলে দিতে ? তার চেয়ে বরং আলোটা যেমন রহস্যময়,চিঠিটাও তেমন করে রহস্যই থেকে যাক না । সারাটা জীবন একটা রহস্য নিয়ে কাটানোতেও তো আলাদা একটা মজা আছে,তাই না ? আমি সেখান থেকে উঠে পরলাম । হটাৎ করে আসা আলোটা আবার হটাৎ করেই চলে গেল । অন্ধকার আবার আমায় গ্রাস করে নিল। প্রকৃ্তিও নিশ্চয় চায় না আমি চিঠিটা পড়ি । আমি চিঠিটা নদীতে ফেলে দিয়ে মেসের দিকে রওনা হলাম । পেছন থেকে মনে হলো নাতাশা আমাকে ডাকছে কিন্তু আমি পেছনে তাকালাম না । কারণ, তাকালেই মায়ায় বাধা পড়ে যাবো,যে মায়াকে তুচ্ছ করা হিমুদের পক্ষেও সম্ভব নয় । তখনি পকেটে রাখা মোবাইল বেজে উঠলো । আমি মোবাইল বের করে দেখি নাতাশার নাম্বার থেকেই কলটা এসেছে । তৎক্ষনাৎ মোবাইলটা পানিতে ছুড়ে ফেলে দিলাম । হয়তো সবটুকুই আমার অবচেতন মনের কল্পনা ছিল তবুও, হিমু হয়ে আমি মায়ার কাছে হেরে যেতে চাই না । আকাশের দিকে তাকালাম। চাদটা আবার উকি দিচ্ছে মেঘের ভেলার ফাক দিয়ে। ঠিক যেন কল্পনার রাজ্য। বড় সুন্দর লাগছে দেখতে।
.......................................
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০১০ দুপুর ১২:০১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



