বিশাখাপটনম রেলওয়ে স্টেশন
ভারতের দক্ষিনে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষে বিশাখাপটনম নগরী যা কিনা ভাইজাগ নামে বহুল পরিচিত।নাব্যতার জন্য তীরের অত্যন্ত কাছে এসে জাহাজ ভীড়তে সক্ষম এই বন্দরটি একারণে শুধু ভারত নয় সমগ্র পৃথিবীতেও সুপরিচিত। পোর্টটি আগলে রেখেছে যে পাহাড় তার আকৃতি অনেকটা ডলফিনের নাকের মত। তাই এটা ডলফিন নোজ নামেই পরিচিত।
সন্ধ্যার ঘন আঁধারে বরুন বীচে আমি, পেছনে ডলফিন নোজকে নিয়ে
এছাড়াও এখানে রয়েছে ভারতের দক্ষিন অঞ্চলীয় নেভীর হেড কোয়ার্টার। যখন জানলাম বিশাখাপটনম আমাদের ট্যুর তালিকায় আছে, জানতে চাইলাম কি আছে সেখানে দেখার? শুনলাম অনেক কিছুই আছে তার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষনীয় লাগলো যা শুনে তা হলো সাবমেরিন মিউজিয়াম।আমি জীবনে অনেক বিখ্যাত মিউজিয়াম দেখেছি কিন্ত এটা ভিন্ন রকম।
আমি যখন ব্যারেন্ট সাগরের কান্না (প্রথম পর্ব) পোষ্টটা লিখি তখন আমাকে লিখতে গিয়ে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছিল, অনেক কল্পনা, অনেক তথ্য ঘাটতে হয়েছিল। তারপরও একটা অতৃপ্তি থেকে গিয়েছিল।তাই এই মিউজিয়ামের কথা শুনে আমার মনটা আনন্দে নেচে উঠলো।নাই বা হলো সেই পোষ্ট লেখার আগে দেখা।
গ্র্যান্ড হোটেল
খুব ভোরে সেকেন্দ্রাবাদ থেকে বিশাখাপটনম নামলাম। হোটেল নিলাম বীচের পাশ দিয়ে যে রাস্তা চলে গেছে তার পরের রাস্তায়। নাম গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল হোটেল। ম্যানেজারের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বের হোলাম আশে পাশে কি আছে দেখার। উনি অনেকগুলো বীচের নাম বল্লো যেমনঃ রুশি কুন্ডা, বরুন আর রামকৃষ্ণ বীচ। আর এই রামকৃষ্ণ বীচেই রয়েছে ভারত বিখ্যাত সাবমেরিন মিউজিয়াম।
সকালে রুশিকুন্ডা বীচ ঘুরে বিকালে হাজির হোলাম দুজন আমার সেই কল্পনার মিউজিয়ামকে বাস্তবে দেখতে।বীচের পাশ দিয়ে যে রাস্তা সেখান থেকেই সাবমেরিনটিকে দেখা যাচ্ছিল।
মিউজিয়ামে রুপান্তরিত সাবমেরিন কুরসুরা
মিউজিয়ামে প্রবেশ ফী ভারতের বাইরের পর্যটকদের জন্য ৫০ টাকা।ক্যামেরার জন্য আলাদা টাকা দেয়া লাগে।এটা দুপুর দুটো থেকে রাত নটা পর্যন্ত খোলা, তবে সোমবার বন্ধ। অপেক্ষমান পর্যটকদের জন্য বাইরে প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা। টিকেট কেটে আমরা গিয়ে বসলাম চেয়ারে।আরো অনেকে বসে আছে।
ইতিহাস বলার জন্য গাইড পালাক্রমে তেলেগু আর হিন্দী দুটি ভাষা ব্যবহার করতে শুনেছি।ইংরেজীতে বলে কিনা তার জন্য আর অপেক্ষা করি নি। তাই এবিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। হিন্দী ভাষায় যারা জানতে চায় তাদের যখন আহ্ববান করেছে তখন আমরাও ঢুকেছি। এক একবারে ২৫/৩০ জনের বেশী লোকের স্থান সংকুলান না হওয়ায় আমরা অপেক্ষা করছিলাম। হটাৎ নজরে পড়লো সামনেই বোর্ডে ইংরাজীতে লেখা সাবমেরিন কুরসুরার জীবনী। আমি এগিয়ে গিয়ে পড়তে লাগলাম।
ইন্টারেস্টিং তথ্য আই এন এস কুরসুরা সম্পর্কে।
১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়তে ইউনিয়নের রিগা শহরে তৈরী হয় ১-৬৪১ ক্লাস আই এন এস কুরসুরা। ১৯৭০ সালের মে মাসে সাবমেরিনটি ভারতীয় নেভীতে যোগ দেয়। ৯১.৩ মিটার লম্বা, ৮ মিটার চওড়া, সাতটি চেম্বারে ভাগ করা এই সাবমেরিনটির ওজন ১৯৪৫ টন।২২ টি টর্পেডো আর প্রতিটি ৬৫২ কেজি ওজনের মোট ৪৪৮ টি ব্যাটারী দিয়ে চালানো এই সাবমেরিনে সাতজন অফিসার এবং ৭২ জন নৌসেনা কর্মরত ছিলেন।১৫.৫ নট গতিতে চলা এই সাবমেরিনটি ৩১ বছর দেশ সেবা করার পর অবসরে যায় ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০০১ সালে।
এর পর একে একটি মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করার চিন্তা ভাবনা করে নৌবাহিনী। ছয় কোটি রুপী ব্যায়ে পানি থেকে ডাংগায় টেনে আনা হয়।সে এক বিশাল ইতিহাস।
পাশেই বিল বোর্ডে লেখা কুরসুরার মিউজিয়াম হয়ে উঠার ইতিহাস
প্রথমে পানিতে ভাসমান সাবমেরিনকে মাটিতে স্থাপন করার জন্য এর নীচে দুদিকে লোহার কাঠামো তৈরী করা হয় ।এরপর টেনে আনার জন্য বাইরে আংটা লাগানো হয়।এরপর সাবমেরিনটিকে বিচে বসানোর জন্য ৯০ মিটার লম্বা ৪ মিটার দীর্ঘ এবং ৪ মিটার গভীর গর্ত করা হয়।টাগবোটের সাহায্যে একে তীরের কাছে টেনে আনা হয়।তারপর হেভী হাইড্রোলিক যন্ত্রের সাহায্যে স্টীলের তার দিয়ে তীরে উঠানো হয়।
টেনে আনছে তীরে কুরসুরাকে
এই টেনে আনার মাঝে সাবমেরিনটি একবার বালিতে গেথে যায়। অনেক শ্রমসাধ্য কষ্টের পর শেষ পর্যন্ত সিমেন্ট আর রবারের তৈরী ভিত্তির উপর একে স্থাপন করতে সক্ষম হয়।টেনে আনতে গিয়ে এর বাইরের আবরনের অনেক জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেগুলো আবার ঠিকঠাক করে রং দিয়ে নতুন করে তুল্লো উদোক্তারা ।
রং করা নতুন হয়ে উঠা কুরসুরা
৯ ই অগাষ্ট ২০০২ সালে অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্র বাবু নাইডু এই অভিনব মিউজিয়ামটির উদ্বোধন করেন আর ১৪ই অগাষ্ট ২00২ এটা জনগনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।ইতিহাস জেনে আবার এসে চেয়ারে বসলাম
চেয়ারে প্রতীক্ষারত দর্শক
তেলেগু ভাষী দর্শকরা নেমে আসছে, আমাদের ডাক পড়লো।
ভেতরে প্রবেশ করলাম কুরসুরার সামনের দিক দিয়ে।সাবমেরিনে ঢোকার দরজা থাকে ছাদের উপর। গোল এয়ারটাইট দরজা।সেটা দিয়ে সিড়ি বেয়ে নীচে নামতে হয়। কিন্ত পর্যটকদের সুবিধার জন্য তারা সামনে আর পেছনে লেজের দিকের মাঝ বরাবর কেটে দরজা বানিয়েছে।লোহার সিড়ি দিয়ে উঠতে হয় ভেতরে। ভেতরে ঢুকতেই ডান দিকে চোখে পড়লো শত্রু জাহাজ বিদ্ধংসী অস্ত্র টর্পেডোর চেম্বার ।আহারে মানুষ মানুষকে মেরে ফেলার জন্য কতই না প্রচেষ্টা।
টর্পেডো রাখার চেম্বার
এত ছোট জায়গা,চারিদিকে যন্ত্রপাতি তার মধ্যে মানুষের ভীড় আমরা সরু প্যাসেজ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি সামনের দিকে।প্রথমেই নজরে পড়লো ক্যাপ্টেনের রুম। আমারতো হার্টফেইল করার অবস্থা।ভদ্রলোক যদি একটু লম্বা-চওড়া হন তবে সেখানে আটার প্রশ্নই উঠে না। ছোট্ট একটা রুম, সরু একটা বিছানা, ততোধিক ছোট এক পড়ার টেবিল। উপরে চার পাচটা বই রাখার মত একটা শেল্ফ।মানুষের ধাক্কায় সেই রুমটার একটা ছবি তুলতে পারিনি, আফসোস।কিন্ত অফিসার আর নাবিকদের রুমের ছবি তোলার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্ত এই রুমগুলো স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে আটকানো যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে।
অফিসারদের ঘুমানোর জন্য বরাদ্দ রুম
আট জন অফিসারের জন্য একই রুমে মনে হলো চারটা বান্ক দেখলাম।তারা পালাক্রমে রুমটি ব্যাবহার করতো বলে গাইড জানালো আমাদের।
চীফ ইন্জিনিয়ার আর অফিসারদের ঘুমানোর জন্য রুমে এক ডামি অফিসার বিশ্রামরত অবস্থায়
শুয়ে আছে ডামি এক নাবিক তাদের নির্ধারিত রুমে।
এই ডামিটি এত বাস্তব লাগছিল যে প্রথম অবস্থায় আমি চমকে উঠি সত্যিকার মানুষ ভেবে।
সাবমেরিনের সত্তর জন নাবিক আর আটজন অফিসারের রান্নার জন্য ৪ফিট বাই ৬ ফিট রান্নাঘরে কর্মরত থাকতো ২ জন বাবুর্চী। একই সাথে ডাইনিং ।
একপাশে বাবুর্চীরা রান্না করছে অপর পাশে বসে নাবিকরা খাচ্ছে।
সবচেয়ে আশ্চর্য হোলাম শুনে এই ৭৭ জন লোক মাসের পর মাস ধরে একটি টয়লেট আর একটি ওয়াশবেসিন ব্যাবহার করতো।
রেডিও রুমে দেখলাম এক ডামী অফিসার যন্ত্রপাতির সামনে বসা
ভেতরে আশে পাসে উপরে নীচে কত কলকব্জা, যন্ত্রপাতি, মেশিন পত্র বলে শেষ করা যাবে না। অনেক কিছু আমি চিনতেও পারিনি কোনটা কি কাজে লাগে। সে সময় নিউক্লিয়ার পাওয়ারের ব্যাবহার ছিলনা সুতরাং সাবমেরিন চালানোর জন্য বিশাল বিশাল ব্যাটারী ব্যাবহার করা হতো ।৬৫২ কেজি ওজনের এক একটা ব্যাটারী মনে হয় সব জায়গা দখল করে আছে।
এগিয়ে যাচ্ছি আমরা সাবমেরিনের শেষ প্রান্তের দিকে
একটি চেম্বার থেকে আরেকটি চেম্বারে যাবার জন্য সাবমেরিনে যে গোল গোল এয়ারটাইট দরজা যেগুলো সম্পুর্ন ভাবে বন্ধ করা যায়। বর্তমানে পর্যটকদের সুবিধার জন্য ঐ দরজাগুলো কেটে ওভাল শেপের করা হয়েছে।
সবকিছু দেখে বের হয়ে আসলাম আমরা একে একে অজানা অচেনা বিভিন্ন রাজ্যের পর্যটকদের সাথে।
সাবমেরিন কুরসুরা সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন যে কথাটি আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই, তাহলো ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের নৌ বাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতের এই সাবমেরিনটি সাফল্যের সাথে অংশগ্রহন করেছিল।
বের হয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে পেছন ফিরে তাকালাম।পানির নীচে একদা দ্রুত গতিতে চলা ঐতিহাসিক সাবমেরিন কুরসুরা অনড় দাড়িয়ে আছে বালিয়াড়ির উপর সমুদ্রের গা ঘেষে। আর তখন নিজেকে সত্যিই আমার অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল।
জলবাসী খুব দুরে যায় নি সে জল ছেড়ে ,পাশেই আছে চিরচেনা সমুদ্র
পানি কেটে এগিয়ে যাবার জন্য প্রপেলার
পেছন থেকে সাবমেরিন কুরসুরা
ছবিগুলো সব আমাদের ক্যামেরায় আমাদের নিজেদের তোলা
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




