প্রিয় বকুল,
অনেকদিন পর আজ তোকে চিঠি লিখতে বসলাম। যদিও আজকাল চিঠি লেখাটা বড্ড সেকেলে হয়ে গেছে। কিন্ত তোর নিশ্চয় মনে আছে কলেজ লাইফে ছুটির সময় আমরা যখন দেশের বাড়ীতে বেড়াতে যেতুম সেসময় কত চিঠিই না লিখেছি এক জন আরেক জনাকে।সেই দিনগুলো আজ কোথায় চলে গেছে তাই ভাবি এক একসময়।
আমি আজ কিছু দিন হলো দেশের বাইরে আছি। তোর জামান ভাই সকাল বেলা অফিসে চলে যায় আমি সারাদিন একাই কাটাই। সেই সাথে রান্না বাড়া ঘর গুছানো টুকটাক লেগেই আছে। তুইতো জানিস আমি সেই তখন থেকেই একটু খুতখুতে স্বভাবের।
শপিং আর কি করবো বল ? এখানেতো আর শাড়ী, থ্রিপিস পাওয়া যায় না। ব্যাগ, জুতো, কসমেটিক্স আর কত! তাই ভেবে চিনতে ল্যপটপ টা নিয়ে এসেছি, তাতে কখনো তাস খেলে কখনোবা টুকটাক লেখালেখি করে সময় কাটছে।
এবার আসার সময় দুটো মোটা মোটা ঈদ সংখ্যা ম্যাগাজিন নিয়ে এসেছি । গত বারের মত এবার আর ভুল করিনি। সেবার বাংলায় লেখা কোন কিছু না পড়তে পেরে কিযে কষ্ট হয়েছিল। আমি আবার কম্পিউটার থেকে ডাউনলোড করে কিছু পড়ে আরাম পাইনা। ওতে বেশ অনেকগুলো গল্প আর ইন্টারেষ্টিং প্রবন্ধও রয়েছে বুঝলি। একটাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে বিভিন্ন নারী নিয়ে একটি গল্পও আছে। মৃনালিনী দেবীর জন্য কষ্টই লাগলো। এটা পড়তে গিয়ে তোর কথা মনে হলো।
তোর কথা বল ? কেমন আছিস ? ছেলেমেয়ে সব ভালোতো? যদিও তারা দুজনই বিয়ে হয়ে সংসারে থিতু হয়েছে তাতে কি? ওরাতো আমাদের কাছে সেই ছোট্ট শুভ আর রিমি হয়েই আছে তাই না ?
স্বপন ভাই এর কথা আর জানতে চাচ্ছি না। যদিও তুই কোনদিন স্বীকার করিসনি, ভেঙ্গে গেছিস, কিন্ত মচকে যাসনি। তোর এই আত্মমর্যাদার ব্যাপারটা আমি সন্মান করি । কোন মেয়ে স্বীকার করতে চায় যে তার স্বামী কন্যার বয়সী মেয়েকে নিয়ে প্রকাশ্যে স্বামী স্ত্রীর মত সংসার সাজিয়ে বসেছে।
এটা যে তোর জন্য কত লজ্জাস্কর আমি বুঝি বকুল। এত ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী হয়েও অল্প বয়সে প্রেমে পড়ে লেখা পড়া সব ছেড়ে গৃহিনী হয়ে বসলি। এত ভালোবাসার পাত্রের এই আচরণ বড় কষ্টদায়ক। তুই হয়তো নিভৃতে জ্বলতে জ্বলতে খাক হয়ে এখন অঙ্গারে পরিনত হয়েছিস। তোর এই আত্মত্যাগের কথা আমি প্রায়ই ভাবি।
সেজন্যই তো ইদানীং আমি তোর বাসায় খুব কম যাই। আমার স্বামী সোহাগী হাসি হাসি মুখটা তোকে দেখাতেও আমার কেন জানি ভীষন অপরাধী মনে হয়। তারপর ও তোর সাথে আমার নিয়মিত ফোনে কথা হয়। মনে মনে ভাবি ‘যাক আমার মুখটাতো আর দেখতে হচ্ছে না ওকে’। বুকটা হাল্কা হয়ে আসে তখন।
আসার আগে গিয়েছিলাম লতার সাথে মনিরার বাসায়। ওকে দেখে আমার কি যে খারাপ লাগছিল বলে বোঝাতে পারবোনা। তোর সাথে মনে হয় অনেকদিন ওর যোগাযোগ নেই। তাইতো বলছিল মনিরা। ওকে দেখলে তুই চিনতে পারবি না বকুল। হাড়ের উপর শুধু চামড়া কিন্ত সেই মিষ্টি হাসিটা আজও তেমনি আছে জানিস। এক বছর আগে পিছে স্বামী সন্তান হারানো ! এতবড় দুটো শোক সামলে ও যে কি করে বেঁচে আছে তাই ভাবতে অবাক হই।
সেলিম ভাই বড্ড অকালে ওকে ফেলে চলে গেল না ফেরার দেশে। কে ভেবেছিল কালোকুলো বেটে মনিরাকে দেখে এমন লম্বা চওড়া সুপুরুষ সেলিম ভাই পাগল হয়ে যাবে। সেদিন মনিরার একটি কথায় আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়ি। কি বলেছিল জানিস বকুল ?
সেলিম ভাইয়ের কথা উঠতেই বল্লো,
'তোদের সেলিম ভাইয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, আমি তাকে সবসময় বলতাম “ভাগ্যিস সেলিম তুমি আমাকে যেচে বিয়ে করেছিলে, নইলে কতবার কত পাত্রপক্ষের কাছে যে আমাকে বাতিল হতে হতো, তুমি অন্তত সেই অপমান, সেই লজ্জা থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছো"।
মনিরার কথা শুনে আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। কি নির্বিকার ভাবে নিজের কথাগুলো বলছিল ভাবতেও পারবি না। মনে হলো আমাদের সমাজের কালো মেয়েদের ভয়ংকর দিকটা কি সহজ ভঙ্গীতেই না তুলে ধরলো।
ঘরের ভেতর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। বারান্দায় গিয়ে দাড়ালেই দেখা যায় ঐ যে দূরে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে হলদে বাতি জ্বালিয়ে ভীষন জোরে ছুটে চলেছে অফিস ফেরত লোকজন।দুপুর পর্যন্ত সুর্য্যদেব মাথার উপর চড়া রোদ বিলিয়ে গেছে ।মাঝে মাঝে রোদের ভাপে উষ্ণ হয়ে ওঠা মাটি থেকে মিষ্টি এক সুঘ্রান জানালা ফুড়ে এসে আমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছিল যেন।
পথের ওপাশে সার দেয়া গাছগুলো কেমন যেন ফিকে হতে হতে এক একবার ঝাপসা হয়ে গেল, আবার এসে হাজির তার সবুজাভ স্নিগ্ধতা নিয়ে।
জানিস বকুল, তারপর বিকেল থেকেই কিন্ত আকাশজুড়ে রোঁদ আর মেঘের খেলা চলছিল । সাদার সাথে ছাই, কখন যে তার রঙ পাল্টে কৃষ্ণ বর্ন ধারন করলো সেটা চোখেই পরেনি আমার। আর দেখ এখন সন্ধ্যা নামতেই শুরু হলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। বিদেশ বিভুই আমি একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে চাইছি বিদেশী বৃষ্টিকে।
হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখলুম একটু খানি । ঠিক ঠিক আমার দেশের মতই শীতল পরশ বুলিয়ে দিল আমার কোমল করতলে। আবার ঝুপ করেই শেষ হয়ে গেল সেই অঝোর বর্ষন। এখন আবার নিকষ কালো রাতের আকাশ, আর তা থেকে ঝুলে থাকা উজ্জ্বল তারা গুলো যদি দেখতি, এত কাছে এসে দাড়িয়েছে মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ছোয়া যাবে তার টুলটুলে গাল।
আমি বসেছি গল্প লিখবো বলে। কত কিছু ভেবে সারা হলো কিন্ত লেখার মত মাথায় কোন কিছুই আসছে না। বৃষ্টির অঝোর ধারার মত আমার মাথা থেকেও সব কিছু যেন সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
কর্তা অফিস থেকে এখনো ফিরেনি । কি জানি এত দেরী করছে কেন বুঝতে পারছি না। রান্নাবাড়া শেষ। মুরগীর ঝাল ঝাল তরকারী তার খুবই পছন্দ। আজ তাই রান্না করেছি সাথে আলু আর বেগুন মিশিয়ে ভাজিও করেছি। সব ঢাকা দেয়া আছে। আসলেই চট করে মাইক্রোওভেনে গরম করে নিলেই হবে।
পুরোনো দিনগুলো আজকাল বড্ড উদাস করে দেয় । ফাঁক পেলেই চিরুনী চালানোর মত দুহাতে স্মৃতি হাতড়ে চলি। দু একটা তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আবার রেখে দেই মনের মনিকোঠায় যত্নের সাথে,যেন এক টুকরো হীরক কুচি।
আজ এখানেই শেষ করি কেমন। অনেক ভালো থাকিস।
শুভেচ্ছান্তে
মিলি
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ৮:২৩