সুন্দরবন ট্রিপে আমাদের মোট ৪৫জন পর্যটকের মাঝে অপুর্ব মায়াময় চেহারার মিষ্টি দুটো মেয়ে ছিল আমাদের সহযাত্রী। বড়টির বয়স বছর সাতেক, ছোটটি চার। ওদের মা বাঙ্গালী, বাবা মার্কিনী শ্বেতাংগ । সাথে ছিল বাচ্চা দুটোর দাদা -দাদী। আমি প্রায়ই দেখতাম এই বয়সেও অসম্ভব সুন্দরী স্কুল শিক্ষিকা দাদী লাউঞ্জে অথবা ডেকে বসে বাচ্চা দুটিকে কাছে বসিয়ে পিঠে হাত রেখে অত্যন্ত স্নেহের সাথে হাসিমুখে গল্পের বই পড়ে শোনাচ্ছে কখনোবা স্ক্রাবল বা দাবা খেলছে।
পরিচয়ের পর্বের সময় জানতে পেলাম বড় মেয়েটির নাম 'দরিয়া' আর ছোটটির নাম 'নুর' । পরদিন বাচ্চা দুটোর মা খুব উত্তেজিত ভাবে আমাকে এসে বল্লো, ' আপনি কি জানেন 'দরিয়া ই নুর' বলে পৃথিবীতে বিশাল এক হীরা আছে! আমি তো জানতামই না, একটু আগে একজন আমাকে বল্লো!'
আমি বললাম ' জানি, তবে আপনার মেয়ে দুটোতো সেই হীরার চেয়েও দামী' ।
সুন্দরবনের কটকার জঙ্গলে আমাদের সাথে হাটি হাটি পা পা করে যাওয়া এই দলবলেই রয়েছে দরিয়া আর নুর
এককালে বিশেষ করে মুঘল আমলে হীরার খনির জন্য বিখ্যাত ছিল ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ। বিখ্যাত হীরক খন্ড কোহিনুর সাথে এখানেই আবিস্কৃত হয়েছিল দরিয়া ই নুর। যেহেতু ভারত বর্ষের মসনদে তখন মুঘল রা স্বাভাবিক ভাবেই সেই সাম্রাজ্যের সমস্ত ধন সম্পত্তির অধিকারী ছিল মুঘল সম্রাটরাই । আকারে এবং রঙ্গে বিখ্যাত কোহিনুরের পরে আজও দরিয়া ই নুরের অবস্থান।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলিম অভিজাতরা একে একে বিভিন্ন রাজ্য দখল করে নিজেদেরকে স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষনা করতে থাকে আর সেই সাথে মধ্য আর উত্তর ভারতের বিশাল একটি অংশও হাত ছাড়া হয়ে যায় হিন্দু মারাঠাদের কাছে ।
দুর্বল মুঘল সম্রাট মুহাম্মাদ শাহ ভাঙ্গনের হাত থেকে সাম্রাজ্য রক্ষা করতে ব্যার্থ হন। ।ঠিক সে সময়ই আফাসারিয় বংশের প্রতিষ্ঠাতা নাদির শাহ ছিলেন ইরানের সিংহাসনে। মুঘল সম্রাটদের অগাধ সম্পত্তি ও ধন রত্নের খ্যাতি তাকে আকৃষ্ট করেছিল ভারত আক্রমন করতে।
প্রথমেই নাদির শাহ মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহকে কাবুলের চারিদিকে মুঘল সীমান্ত বন্ধ করতে বলে। কারন আফগান বিদ্রোহীদের আক্রমন করলে তারা যেন কাবুলে পালিয়ে যেতে না পারে। মুঘল সম্রাট বিনা বাক্যব্যায়ে তার এই অনৈতিক প্রস্তাব মেনে নেন। ফলে নাদির শাহ খুব সহজেই তার চির প্রতিদ্ধন্দী আফগানদের পরাজিত করে।
বিদ্রোহীরা হিন্দুকুশ পর্বতের দিকে পালিয়ে যায়। এরপর নাদির শাহ ছোট ছোট শহর গজনী, কাবুল, পেশোয়ার, পাঞ্জাব দখল করে ৫৫ হাজার দুধর্ষ সৈন্য নিয়ে ভারত এর সিন্ধু নদের তীরে উপনীত হয়।এখানে মুঘল সম্রাট তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে কার্নালে নাদির শাহের মুখোমুখি হয়। সময়টি ছিল ১৭৩৯ এর ১৩ই ফেব্রুয়ারী। দুর্বল মুঘল সম্রাট মুহাম্মাদ শাহ নাদির শাহের কাছে অসহায়ভাবে আত্নসমর্পন করে এবং দিল্লী শহরের চাবি নাদির শাহের হাতে তুলে দেয়।
২০শে মার্চ ১৭৩৯ নাদির শাহ দিল্লীর লাল কেল্লায় প্রবেশ করে সম্রাট শাজাহানের রাজকীয় কক্ষ দখল করে।সেদিন বিজিত সম্রাট নাদির শাহের নামে দিল্লীর জামা মসজিদ সহ অন্যান্য মসজিদে প্রার্থনা করা হয় এবং পরদিন তিনি রাজকীয় সভার আয়োজন করে। পারস্যদের মুঘল সাম্রাজ্য বিজয়ের ফলে সমস্ত দেশ জুড়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। জনগনের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিলে নাদির শাহের সৈন্যরা বাজারে দোকানদারদের জিনিস পত্রের দাম নিয়ন্ত্রনের জন্য চাপ দিতে থাকে। দুদলের মধ্যে শুরু হয় গন্ডগোল যার ফলশ্রুতিতে কয়েকজন পারস্যবাসী মৃত্যবরন করেন। এই খবর পাওয়ামাত্র ক্ষুদ্ধ নাদির শাহ তার সৈন্যদের নগরবাসীদের উপর যা খুশী করার নির্দেশ দেন । রাজার প্রতিশ্রুত উপঢৌকন আর লুটপাটের লোভে হাজার হাজার পারস্য সৈন্যের তলোয়ার ঝনঝনিয়ে উঠলো। সেই খোলা তলোয়ারের এর ঝংকার আর গোলাবারুদের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো একদা মুঘলদের শৌর্য্য বীর্যের কাহিনীতে ভরা দিল্লী নগরী। তাদের এই পৈশাচিক, নারকীয় হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে রক্ষা পায়নি নিরস্ত্র, অরক্ষিত নগরবাসী, যার মধ্যে ছিল নারী পুরুষ থেকে শিশু এবং হিন্দু, মুসলিম, শিখ ধর্মের মানুষরা।
দীর্ঘক্ষন চলার ধরে চলা তান্ডবলীলায় সম্পুর্ন দিল্লী শহরটি ভস্মীভুত হয়। এ সময় মুঘল সম্রাটের বারংবার করুন মিনতিতে ছয় ঘন্টা ধরে চলা এই ধ্বংসলীলা বন্ধ হয়। পারস্য সৈন্যদের এই এক পেশে আক্রমনে ২০ থেকে ৩০ হাজার নিরীহ নগরবাসী মৃত্যু বরণ করে।
পুরো শহরটি ধ্বংসস্তুপে পরিনত করার পর নাদির শাহ ক্ষতিপুরন বাবদ ভারতীয়দের কুড়ি মিলিওন রুপী দাবী করে। হায় কি সেলুকাস এই রাজনীতি। নত শির মুঘল সম্রাট মুহাম্মাদ শাহ ধন সম্পদের পরিপুর্ন রাজকীয় কোষাগারের চাবি তুলে দিল নাদির শাহের হাতে। সাথে সাথে অত্যাচারী নৃশংস পারস্য রাজ নাদির শাহ মুঘল সম্রাটদের গৌরবের প্রতীক ময়ুর সিংহাসন ছাড়াও পৃথিবী বিখ্যাত কহিনুর এবং দরিয়া ই নুরের সাথে অজস্র মনি মানিক্য ধন রত্নের মালিক হন।
পারস্যের সৈন্যরা নাদির শাহের নেতৃত্বে ভারত ত্যাগ করেন ১৭৩৯ সালের মে মাসে। যাবার সময় সৈন্যদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি হাতী ঘোড়া উট ইত্যাদিও।
যাই হোক পরবর্তীতে বহু হাত ঘুরে রক্তাক্ত এই কোহিনুর আর দরিয়া ই নুর নামে অত্যন্ত বর্নিল বিশাল হীরক খন্ড দুটি যথাক্রমে বৃটিশ আর ইরান রাজার মুকুটে শোভা বর্ধন করে আছে এখন পর্যন্ত ।
আরেকটি মতানুসারে ভারতীয় শিখ রাজা রঞ্জিৎ সিং পারস্যের হাত থেকে দরিয়া ই নুর আর কোহিনুর দুটো হীরক খন্ডই উদ্ধার করতে সক্ষম হন। কিন্ত ১৮৪৯ সালে বৃটিশ শাসকের হাতে পাঞ্জাবের পতন হলে সেই পৃথিবী বিখ্যাত হীরে দুটোর মালিকও হন .ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী । ইতিহাস থেকে জানা যায় যে বৃটিশ সরকারের নির্দেশে ১৮৫২ খৃষ্টাব্দে হ্যামিল্টন এন্ড কোঃ অন্যতম আকর্ষন দরিয়া ই নুরকে নিলামে তুললে ঢাকার নবাব খাজা আলিমুল্লাহ তা কিনে নেন। অপুর্ব এই হীরক খন্ডটি দেখতে ১৮৮৭ সালে ভাইসরয় লর্ড ডাফরিন ছাড়াও ১৯১২ সালে কলকাতায় রাজা পঞ্চম জর্জ ও তার স্ত্রী এটা দেখতে যান।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দরিয়া ই নুর কলকাতা থেকে ঢাকা চলে আসে। আর তারপর থেকেই ১৮২ ক্যারেট ওজনের হাল্কা নীলচে গোলাপী আভার চারকোনা সেই 'দরিয়া ই নুর' বাংলায় বলা যায় 'আলোর সাগর' রয়েছে আমাদের দেশের সোনালী ব্যাংকের ভল্টে ! একদল হীরক বিশেষজ্ঞ পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে মতামত দিয়েছে যে এটাই আসল দরিয়া ই নুর ।
আর একটি সুত্র থেকে জানা যায় যে বিখ্যাত এই দরিয়া ই নুর হীরক খন্ডটি নাদির শাহের আমল থেকেই ইরান তথা পারস্যের রাজ পরিবারের দখলেই ছিল এবং তাদের রাজপরিবার শাহের মুকুটে শোভা পাচ্ছে। তবে ইরানে রাজতন্ত্রের পতনের পর থেকে এই মুকুট বর্তমান ইরানের সেন্ট্রাল ব্যংকের জিম্মায় রয়েছে।
এখন কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা ইতিহাসই বলতে পারে।
আর আমার ক্ষনিক পরিচয়ের দরিয়া আর নুর কোন ভল্টে নয়, তারা রয়েছে তাদের দাদা, দাদী, ছাড়াও বাবা মা এর আদরে আঁচলে সেই সুদুর বিদেশে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:১৮