somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সেক্টর ২ রনাঙ্গনে সক্রিয় অংশগ্রহনকারী এক বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বহস্তে লেখা দিনলিপি ( শেষ পর্ব ) )

১৫ ই এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ১০:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পরে জেনেছিলাম ঐ গ্রামে পাক বাহিনীরা আমাদের উপর আক্রমন পরিচালনার জন্য একটি বিরাট সুবিধা পেয়েছিল। তা হলো যুদ্ধ বিমান থেকে ফেলা বোমা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নদীর পারের গ্রামবাসীরা বাড়ির উঠানে লম্বা লম্বা করে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে রেখেছিল।সেই ট্রেঞ্চে পাক বাহিনী অবস্থান নিয়ে আমাদের ছোঁড়া গুলি থেকে সেদিন নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল।
মনে আছে ঐদিন বিকেল পর্যন্ত উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলে, এরপর তারা পিছু হটতে বাধ্য হয় কারণ সন্ধ্যা নেমে আসছিল। তারা ভালো করেই জানতো সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসলে সেই আলোহীন জলাশয়ে ঘেরা গ্রামে লুকিয়ে থাকা মুক্তিসেনাদের মুখো মুখি হওয়া কতখানি বিপজ্জনক।
সারাদিনব্যাপী এই যুদ্ধে আমাদের মাঝে শুধু একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিল আর সে ছিল আমাদের নৌকার সদ্য যুবক মাঝিটি যে সর্বদাই আমাদের অনেক কাজের সঙ্গী ছিল ।
এদিকে যুদ্ধ চলছে, বেলা তখন দুপুর, ক্ষুধার যন্ত্রনায় সে হামাগুড়ি দিয়ে ক্যাম্পে গিয়েছিল খেতে। খাবার আগে থালাটা ধুয়ে পানিটা দরজার বাইরে ফেলতে যাবে, খেয়াল ছিল না, সামান্য দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সাথে সাথে পাক সেনার গুলি এসে তার পা আর হাতে আঘাত করে। তাড়াতাড়ি তাকে নৌকায় করে পাশের গ্রামে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। কিন্ত হানাদার বাহিনীকে ফিরে যাবার সময় পাঁচটি লাশ বহন করে নিয়ে যেতে দেখেছি আমরা।
সারাদিনের এই যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে ক্যাম্পে ফিরে উপলব্ধি করেছিলাম সম্মুখ যুদ্ধ কি জিনিস! ভাবলাম যারা এই ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত তাদের উপর দিয়ে কি ভয়ানক ঝড়টাই না বয়ে যায়।সারাক্ষন কাঁধে বন্দুক ঠেকিয়ে রাখতে রাখতে কাঁধ অবশ হয়ে এসেছিল।তার উপর এল এম জিতে ১০০ রাউন্ড গুলি ছোড়ার পরই ব্যারেলটা গরমে লাল হয়ে উঠছিল।তখন ওটাকে আবার পাল্টাতে হচ্ছিল। অন্যান্য অস্ত্রের বেলায় সে উপায়ও ছিল না অর্থাৎ ব্যারেল পাল্টানোর সিস্টেম ছিল না ফলে অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। পাক বাহিনী যেন আমাদের এই দুর্বলতা বুঝতে না পারে তার জন্য আমরা এস এম সি দিয়ে কিছুক্ষন পর পর ব্রাশ ফায়ার করে আমাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলাম।
ক্যাম্পে ফিরে আসার পর তখনই বসে সব অস্ত্রের হিসাব নিকাশ মিলিয়ে রাখলাম। তারপর খেয়ে দেয়ে ঘুমানোর আগে একটা ছোট মিটিং এ বসলাম। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল পাক বাহিনী আমাদের ক্যাম্পের ব্যাপারে খুবই চিন্তিত। দুবার আক্রমন করেও আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারে নি। হয়তো তাদের পরবর্তী আক্রমন হবে আকাশ থেকে যুদ্ধ বিমানের মাধ্যামে।
এরপর থেকে আমরা খুব সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতাম এবং বেশিরভাগ সময় ক্যাম্পের বাইরে থাকতাম। চারিদিকে পাহারার বন্দোবস্ত করা হলো।অস্ত্র ছাড়া চলাচল না করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
১৯৭১ সালের নভেম্বরের তখন শেষ দিক, সে সময় আমরা প্রায়ই সন্ধ্যার পর গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে শহরে উঠতাম আর বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ন লক্ষ্য বস্তুতে গ্রেনেড হামলা চালাতাম। দেশের ভেতরে চারিদিক দিক থেকে পাক বাহিনীর উপর আক্রমনের ফলে তারা তখন ভীষন ভাবে কোনঠাসা হয়ে পরেছিল। এমন কি খোদ ঢাকা শহরেও তাদের চলাচলও অনেকটা কমে এসেছিল।
এদিকে সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাসহ ভারতীয় সৈন্যদের চলাচল অনেক বেড়ে যায়।সেই সাথে দেশের ভেতরে থাকা আমাদের অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতাও দারুনভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে পাক বাহিনীর অনেকটাই দিশেহারা অবস্থা। সে সময় খবর আসলো ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের স্বাধীনতার স্বপক্ষে জোরালো ভুমিকা রাখছে।ফলে আমাদের মনবল ও দিন কে দিন বেড়ে যাচ্ছিল।
আর ঠিক তখনই আমাদের অর্থাৎ বাকী ইউনিটের ভাগ্যে এক বিশাল বিপর্যয় নেমে আসলো।
৩রা ডিসেম্বর ১.১৫ কি ২টা বাজে আমি আর নান্নু আরো দুজন সঙ্গী নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসলাম। দেখি বাকী এবং মুক্তিযোদ্ধা বাবুল(বাকীর ঢাঃবিঃ বন্ধু) কাপড়চোপড় পরে তৈরী হচ্ছে। আমাদের আগেই নির্ধারিত একটা অপারেশনের পরিকল্পনা ছিল।বাকী আর বাবুল সেই স্থানটি রেকি করার জন্য শহরে উঠছে।বাবুলকে নেয়ার ব্যাপারে আমি আপত্তি জানালাম এবং বাকীকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম,
‘ শোনো বাবুল আমাদের খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার এলাকার রাস্তাঘাট ভালো করে চেনে না। কারন সে ঐ এলাকার ছেলে নয় ওকে নিয়ে যাওয়াটা তোমার ঠিক হচ্ছে না বাকী’।
বাকীর চরিত্রটা আমি বুঝতাম তাই অনেক চেষ্টা করেছিলাম দেরী করাতে যাতে সে আমাকে বা নান্নুকে নিয়ে যেতে রাজী হয়। কিন্ত বাকী এবার কিছুতেই আমার কথা মানতে রাজী হলো না, বল্লো,
‘তোমরা ক্লান্ত, খাওয়া দাওয়া করে এখন বিশ্রাম নাও, আর আগামী কাল রাত দশটার দিকে তোমরা বারো জন যে জায়গার কথা বললাম সেখানে অপেক্ষা করবে। আমি এসে নদীর অপর পার থেকে ম্যাচ বা অন্য কোন লাইট জালিয়ে তিন বার সিগনাল দিলে তোমরা অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে উঠবে ঢাকায়’।
আমাদের উদ্দেশ্য ছিল পাক-বাহিনীর একটি কনভয় উড়িয়ে দেয়া। যেই কনভয়টা প্রায় প্রতিদিন রাত চারটার দিকে খিলগাঁও চৌধুরি পাড়ার প্রধান সড়ক অতিক্রম করে। সেটাতে প্রায় ১৫ জনের মত পাক সৈন্য থাকে। আমরা প্রায় দুই তিনবার জায়গাটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করেছিলাম। অপারেশনের সেই জায়গাটি ছিল আমাদের প্রতিষ্ঠিত পল্লীমা সংসদ থেকে ১০০ গজ পুর্ব দিকে পাল্কী কনফেকশনারীর সামনে বর্তমান শহীদ বাকী সড়কের উপর।
কে কোথায় কি কি অস্ত্র নিয়ে সেই কনভয়ের উপর আক্রমন করবে তাও সব ঠিক করা হলো। কাজ শেষ হলে কে কোন পথে পালাবে এটাও ঠিক করা হলো।এটা ছিল আমাদের জন্য এক বিশাল অপারেশন।
নির্ধারিত জায়গায় বসে আমরা বারোজন অপেক্ষা করছি কিন্ত বাকীর সিগনাল আর আসে না, আসে না । ভোর চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ক্লান্ত বিদ্ধস্ত আমরা বিফল মনোরথে ফিরে গেলাম ক্যম্পে। সারারাত জেগে থাকা আর আগের দিনের ক্লান্তিতে বিছানায় পরা মাত্র ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকাল আটটায় ক্যাম্পে প্রচন্ড হৈ চৈ এ ঘুম ভেঙ্গে গেল। সেদিন ছিল ৪ঠা ডিসেম্বর লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে আসতেই শুনলাম সেই হৃদয়বিদারক সংবাদ। আর তা ছিল বাকী আর বাবুলের মৃত্যু সংবাদ। সে খবরটা যে আমাদের জন্য কতখানি মর্মান্তিক তা আমি আজও লিখে বোঝাতে পারবো না।
আমাদেরই একজন সহযোদ্ধা ইসমাইল এসে হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জানালো সে নিজের চোখে দেখে এসেছে খিলগাঁও জোড় পুকুরের কালভার্টের নীচে পড়ে আছে বাকী আর বাবুলের লাশ। দুজনের লাশই একই দড়িতে দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা। পরে জানতে পারি যে রাজাকারদের সহায়তায় পাক বাহিনীর হাতে ধরা পরে তারা নির্মম অত্যাচারের পর গুলীবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরন করেছিল।
এ খবর শুনে আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। কেউ কারো দিকে তাকাতে পারছিল না, সবাইকে মনে হচ্ছিল প্রচন্ড অসহায়। আমাদের মাঝে যারা সি এন সি স্পেশাল ব্যাচের জন্য মনোনীত হয়েছিল সেখানে প্রশিক্ষনের সময় বার বার বলা হতো আমরা যেন আমাদের কোন সহযোদ্ধার মৃত্যুতে ভেঙ্গে না পড়ি। কে বাঁচবে, কে মরবে বলা যায়না প্রয়োজন হলে তার লাশের উপর দিয়েই যুদ্ধ করে যেতে হবে।
সেই ক্যাম্পে তখন আমি এবং মুক্তিযোদ্ধা আতিক এই দুজন ছিলাম সি এন সি স্পেশাল ব্যাচের ট্রেনিং প্রাপ্ত। আমরা তখনই সবার ভেঙ্গে পড়া মনোবল উদ্ধারের দায়িত্ব নিলাম।
‘শোন, সবাই শক্ত হও, আমাদের যুদ্ধ থেমে যায় নি, অন্তত বাকীর নামকে সমুন্নত রাখতে এবং আমাদের দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হলে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে’ সেই সাথে সবাইকে আরো সাবধান হতে বললাম।
খবর আসলো ঢাকায় আমাদের যে সব সহযোদ্ধা ছিল তারা ছাড়াও যেমন মোস্তাকউদ্দিন লুলু ও তার বড় ভাই, বাকীর বড় ভাই মিলে খুব সতর্কতার সাথে বাকী আর বাবুলের লাশ দাফনের ব্যাবস্থা করেছে। অত্যন্ত সতর্কতা আর গোপনীয়তা সহ সকল ধর্মীয় বিধি বিধান মেনে আজিমপুর কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়।
প্রথম থেকেই দেশকে শত্রু মুক্ত এবং স্বাধীন করার স্বপ্ন আর এক বুক আশা নিয়ে যে সবসময় চলতো, আমাদের সেকটর ২ এর কমান্ডার, আমাদের গর্ব সেই অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক শহীদ আবদুল্লাহ হেল বাকীর চরম দুর্ভাগ্য যে দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক বারোদিন আগে তাকে এই করুন মৃত্যু বরণ করে নিতে হলো।
পরদিন ৫ই ডিসেম্বর চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের সহযোদ্ধারা সবাই ক্যাম্পে ফিরে আসতে শুরু করলো। তখন অনেকেই বিশেষ করে ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল, নান্নু , লুলু , আতিক, লীনা, জাহাঙ্গির সবাই আমাকে সেই সেক্টর ২ এর দায়িত্ব নেয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো।কারণ আমি বাকীর টুআইসি অর্থাৎ সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলাম।কিন্ত তখন আমার মনের মধ্যে অন্য একটি অনুভূতি কাজ করছিল।আমাদের ক্যাম্পে বাকীর সমবয়সী অনেক বন্ধু ছিল আর আমি বয়েসে অনেকের চেয়ে ছোট ছিলাম।সবার অনুরোধ শেষে আমি তাদের বুঝাতে সক্ষম হোলাম যে এই মুহুর্তে দায়িত্বটা বড় কথা নয় আমাদের একজন নেতা দরকার এবং সেই দায়িত্ব দেয়া হোক আমাদের সহযোদ্ধা আতিক কে।আমার কথা সবাই মেনে নিল।এখন আতিক আমাদের সেক্টর ২ এর কমান্ডার নিযুক্ত হলো।

দুদিন ধরে স্থবিরতার পর আমরা আবার আমাদের দায়িত্বে নেমে পড়লাম।তবে এবার থেকে কোন বড় ধরনের আক্রমনে না গিয়ে ঢাকার পুর্ব উত্তর দিকের পুরো এলাকা জুড়ে পাক বাহিনী এবং বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ন স্থাপনায় ক্রমাগত চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যেতে লাগলাম।
তখন ঢাকা সহ সব এলাকা জুড়েই পাকিস্তানী সৈন্যদের ত্রাহি ত্রাহি রব শুরু হয়ে গিয়েছিল। কারণ সে সময় ভারতও তার পুর্ন শক্তি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করলো। খুব সম্ভবত ৬ ই ডিসেম্বর ভারতের যুদ্ধ বিমান প্রথম আক্রমনে শুরু করে।ভারতের প্রথম আক্রমনেই পাকিস্তানি এয়ারফোর্স ধরাশায়ী হয়ে পরেছিল।সাত কি আট তারিখেই ভারত তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানের পুরো আকাশসীমা দখল করে নিয়েছিল।

এমনিতেই পাক বাহিনীর মনবল বলতে কিছু ছিল না, তার উপর ভারত তার নিঁখুত যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। ফলে বিভিন্ন সীমান্ত এবং শহরগুলোতে ভারতীয় সৈন্যরা পাক বাহিনীর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধের সন্মুখীন হয়নি। পিছু হটতে শুরু করলো পাক হানাদার আর সাথে সাথে দখল মুক্ত হতে শুরু করলো এক একটি শহর। ভারতীয় বাহিনী ঢাকার দিকে খুব সহজেই এগিয়ে আসছিল এবং চার পাশ থেকে ঢাকাকে ঘেরাও করে ফেলেছিল।
১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আমরা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে আমরা খুব শীঘ্রই স্বাধীনতার স্বাদ পেতে যাচ্ছি।১৬ই ডিসেম্বর পরাজিত পাক হানাদার বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজী ভারতীয় জেনারেল মানেকশর কাছে আত্মসমর্পন করলে দীর্ঘ নয়মাস ব্যাপী আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ।আমরা একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক এর মর্যাদালাভ করি।
সেদিনের সেই অনুভূতি সেই আনন্দ আজ এই ক্ষুদ্র লেখায় ফুটিয়ে তোলার সাধ্য আমার নেই।
এখানে একটি কথা না বললেই নয় তা হলো সেদিনের সেই বিজয়ের ক্ষনে আমি ঢাকায় উঠতে পারিনি।কারন অস্ত্র শস্ত্রের দায়িত্ব ছিল আমাদের উপর। তার ফলে আমি আর আতিক সকল অস্ত্র শস্ত্র তুলে এনে তারপর ঢাকায় উঠে এসেছিলাম। সেই সব অস্ত্র এনে রেখেছিলাম আমার বোনের বাসার নীচ তালায়। সেই বিপুল পরিমান অস্ত্রের পাশেই আমি ঘুমাতাম।এই সব অস্ত্র পাহারা দেয়ার দায়িত্বও আমার উপর পরলো। কারন কেউই তখন কারো কোন নেতৃত্ব মানছিল না।
আমাদের ক্যাম্প করা হলো বর্তমান আনসার কোয়ার্টারের দোতালায়। আতিক কে বলেছিলাম যত তাড়াতাড়ি পারা যায় সকল অস্ত্র কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়ে দেয়ার জন্য।
এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত ঘটনা শেয়ার সবার সাথে করতে চাই। তা হলো অস্ত্র গুলো যখন আমাদের বাসার পাশেই আমার বোনের বাসায় ছিল তখন আমার মায়ের পিড়াপিড়িতে তাকে অনেকগুলি অস্ত্র চালানো শিখিয়েছিলাম।আমার মা এর সেই গর্বিত চেহারা এখনো আমার মনে গেঁথে আছে।

যথা সময়ে আমরা সকল অস্ত্র ঢাকা ইউনিভার্সিটির মাঠে মেজর খালেদ মোশাররফ এবং ক্যাপ্টেন হায়দারের কাছে জমা দিয়ে এ ব্যাপারে আমাদের দায়িত্ব শেষ করলাম।সেই সাথে ঘটলো আমার জীবনের চির স্মরনীয় এবং গৌরবজ্জ্বল এক অধ্যায়ের সমাপ্তি।
শেষ


আমার কথাঃ

শুরুতেই লিখেছিলাম -- আমাদের দেশের বর্তমান তরুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি। দেখার কথাও নয় তাদের। মাঝে কেউ কেউ হয়তো শুনেছে জেনেছে শুধু স্বাধীনতা তথা পাক বাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত
করার জন্য আমাদের সেইসব তরুন যুবক যুবতীদের দৃপ্ত কঠোর কঠিন সংগ্রামের কথা ।
একাত্তরের দিনগুলোর এক একটি কাহিনী এভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই বাঙলার জনপদে । ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই দিনলিপির লেখক মনসুরুল আজীম এর মতো হাযারো অকুতভয় মুক্তিযোদ্ধারা।লেখক এক জায়গায় লিখেছেন “...প্রয়োজন হলে তার লাশের উপর দিয়েই যুদ্ধ করে যেতে হবে।“ । আমাদের সূর্য্যসন্তানেরা গিয়েছেনও তাই । শহীদ আবদুল্লাহ হেল বাকীর মতো শতশত বাকীদের রক্তের উপর দিয়েই এক আকাঙ্খিত কষ্টকর স্বাধীনতা আমাদের কাছে এসেছে ।
একটি আকাঙ্খার এই ছবি যাদের নষ্ট চোখে ধরা দেয়না, এই অনুভবের গাঁথা যাদের মনে কোনও রেখাপাত করেনা , যারা ভাবেন না চাইতেই এমনি এমনি একটি স্বাধীনতা আমাদের হাতে এসে পড়েছে তাদের আবার স্মরন করিয়ে দিতে চাই ; যে মাটিতে দাঁড়িয়ে তারা বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছেন আজ তা এই এক সাগর রক্তের সমুদ্র বেয়ে আসা বাতাস । যে মাটিতে দাঁড়িয়ে তারা নিজ নিজ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন , তা এইসব অকুতভয় মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের দাগ লাগা স্বপ্নের বিনিময়েই ।
লেখকের মা নিজেই পিড়াপিড়ি করে অস্ত্র চালনা শিখে নিয়েছিলেন ।এই রকম অসীম সাহসী মায়েরাই ছিলেন সেইসব উত্তাল দিনের প্রেরনাদায়িনী ।দেশের মাটির জন্যে এইসব মায়েদের যে ভালোবাসা সেদিন স্বতঃ উৎসারিত ছিলো তাকে বুকে নিয়েই বাঙলার দামাল ছেলেরা সেদিন লাল-সবুজের পতাকা ওড়াতে পেরেছিলেন বাঙলার আকাশে ।এদের কি ভোলা যায় ?
গানের কথাতেই বলি – বাঙলার আকাশে রক্তিম সূর্য্য আনলে যারা / আমরা তাদের ভুলবোনা .......


এই লেখাটি সম্পাদনা করতে গিয়ে বিভিন্ন খুটিনাটি তথ্যের জন্য মুক্তিযোদ্ধা মনসুরুল আজীমকে অনেকবার বিরক্ত করেছি, তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী ।আমাদের এই গৌরবময় ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মকে জানানোর ব্যাপারে সহায়তা করার জন্যও আমার পক্ষ থেকে তাঁকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ ।

মূল লেখকঃ ১৭৯০৪৫ নম্বর সনদ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা মনসুরুল আজীম।
সম্পাদনাঃ মাহজাবীন জুন।

ছবি নেট।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ৯:১২
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×