somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশ্বের বৃহদাকার বইটি (ইতিহাস +ছবি) ভ্রমন ব্লগ

২৭ শে মে, ২০১৫ রাত ৯:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কাচে ঘেরা বৃহদাকার বই এর ক্ষুদ্র সংস্করন
এই পৃথিবীতে কত রকম বিস্ময়ই যে আছে তা আঙ্গুলের কড় গুনেও হয়তো শেষ করা যাবে না। এর মাঝে কোনটা হলো মানুষের তৈরী,আবার কিছু প্রকৃতি তার নিজ হাতে, নিজের খেয়ালখুশীতে রচনা করেছেন । গত ১৯ এপ্রিল ২০১৫ মায়ানমারের পুরনো রাজধানী মান্দালয়ে মানুষের তৈরী তেমনি এক অবিস্মরনীয় কীর্তি দেখার সৌভাগ্য হলো আমার ।


ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষনা লেখা শুভ্র সফেদ মার্বেল গেট।

এই বিস্ময়কর সৃষ্টির স্রষ্টা হলেন বার্মার শেষ উল্লেখযোগ্য রাজা মিন্ডন। "The world’s largest book" অর্থাৎ বিশ্বের সবচেয়ে বৃহদাকার এবং ব্যাতিক্রমী বই হিসেবে যাকে গণ্য করা হয় তা নির্মান করে তিনি সারা বিশ্বে অমর হয়ে আছেন।

কিংস প্যালেস ঘুরে ঘুরে দেখার সময় আমার স্বামী দু এক বার গাইড মিজ ট্যান্ডাকে প্রশ্ন করছিল বইটি দেখাতে আমাদের কখন নিয়ে যাবে? আমি একটু বিরক্তই হচ্ছিলাম। যদিও আমি ভীষন বই ভালোবাসি। কিন্ত এখন যখন সুন্দর এই রাজকীয় প্রাসাদ দেখছি তখন এর মাঝে আবার বই দেখার কি হলো ?


কুথোদ বিহারের গেট পেরিয়ে বিশাল চত্বর পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি

অন্যান্য বার কোথাও ঘুরতে গেলে আগে থেকে কি কি দেখবো তার পুরোপুরি একটা ধারনা নিয়ে যাই। কিন্ত এবার যাবার আগে নানা রকম পারিবারিক সমস্যায় তাদের পাঠানো ভ্রমনসুচীটা আমার দেখা হয়নি। তাই এই বইটির ব্যাপারে আমার কোন ধারনাই ছিল না। অবশেষে কিংস প্যালেসের পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে যখন বই দেখতে রওনা হোলাম তখন শুনলাম আমরা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বিশালাকার একটি বই দেখতে যাচ্ছি।


ধাম্মা সেটির মাঝে বই এর একটি পাতা

শুনে মনে হলো এটি আবার কেমন বই, পাতাগুলো কিভাবে সাজানো, কত প্রকান্ড, কিভাবে তা মানুষ পড়ে? কোথায় রেখেছে ? কোন লাইব্রেরীতে ইত্যাদি নানা প্রশ্ন মনের মাঝে ঘুরপাক খেতে লাগলো।অবশেষে হাজির হোলাম আমাদের গন্তব্যে।মাঝখানে স্বর্নালী মন্দিরকে ঘিরে চারিদিকে সাদা সাদা ছোট ছোট অজস্র শ্বেত শুভ্র ঘরগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে হাত ছড়িয়ে গাইড ট্যান্ডা বলে উঠলো, 'দেখো বিশ্বের এক বিস্ময় এই বৃহদাকার বইটি '। আমি হতবাক হয়ে গেলাম বইএর রূপ দেখে ! আপনারাও দেখুন আমার চোখে ।


সোনালী রঙ করা কুথদ বিহার


কারুকার্য্যময় পথ


শেষ মাথায় বুদ্ধের মুর্তি


মান্দালয়কে স্থানীয়রা উচ্চারন করছে মান্দালে বলে। এই মান্দালে শহরের গা ঘেষে মান্দালে পাহাড়, আর সেই পাহাড়ের পাদদেশে রাজা মিন্ডনের তৈরী বিখ্যাত কুথোদ বৌদ্ধ বিহার।


মান্দালে পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যাচ্ছে কুথোদ বিহার

সেই বিহারকে কেন্দ্র করে চারপাশে বিশাল জায়গা জুড়ে নির্মিত হয়েছে ১৫৩/১০৭ সেঃমিঃ মাপের শিলা পাথরের উভয়েদিকে লেখা ৭৩০ পাতার ১৪৬০ পৃষ্ঠার একটি বই। সারিবদ্ধভাবে সাজানো ছোট ছোট সমান মাপের সাদা সাদা ৭৩০ টি মন্দিরের মধ্যে বইটির এক একটি পাতা রাখা আছে।


ছোট ছোট শ্বেত শুভ্র মন্দিরগুলোকে Dhamma ceti or kyauksa gu বলা হয়।

Dhamma ceti or kyauksa gu এর ভেতরে বইএর পাতাগুলো, মানে শিলাগুলো ৫ ইঞ্চি মোটা যাতে এটা আপনা আপনি সোজা হয়ে থাকতে পারে।মন্দির নির্মানের জন্য ব্যবহার করা মার্বেল পাথরগুলো ৩০ মাইল দূর থেকে ইরাবতী নদী দিয়ে ভেলায় করে ভাসিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল।


শিলা পাথরে খোদাই করা বইএর পাতা

এক একটি শিলাপাথরের খন্ড এই অত্যাশ্চর্য্য বই এর এক একটি পাতা, যার উভয়েদিকে প্রাচীন "পালি" ভাষায় খোদাই করা হয়েছে ত্রিপিটকের তিনটি অংশে যথা সুত্তা পাটিকা, ভিনায়া পাটিকা এবং অবিধাম্মাপাটিক যাতে ২০০০ বছর আগে মানবজাতির উদ্দেশে লেখা গৌতম বুদ্ধের সমস্ত বানীগুলো।


বই এর এক একট পৃষ্ঠা রাখার ঘর

মান্দালে ছিল সেসময় বার্মার রাজধানী ।১৮৬০ সালে রাজা মিন্দনের নির্দেশে বইটির কাজ শুরু হয়ে আর এটি শেষ করতে সময় লেগেছিল ৮ বৎসর। তারপর সবাই যাতে বইটি পড়তে পারে তার জন্য উন্মুক্ত করা হয় ১৮৬৮ সালে। লেখাগুলো নেয়া হয়েছিল শুকনো তাল পাতায় লিখা প্রাচীন পান্ডুলিপি থেকে। শত শত পাথর শিল্পী নিযুক্ত ছিল পাথরগুলোকে সাইজ মত কাঁটা এবং খোদাই করার কাজে। আর একশর ও বেশি সংখ্যক ভিক্ষু দিনের পর দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তদারকী আর সম্পাদনা করেন পাথর শিল্পীদের খোদাই করা লেখাগুলো।


সারি সারি বইএর শিলা পাতা রাখা আছে এক একটি ছোট্ট মন্দিরে


একশ একুশ বছরের বকুল গাছ এর ফাকে বৃহদাকার বই এর পৃষ্ঠা

শুরুতে পাথরে খোদাই করা বুদ্ধের বানীগুলো সোনার কালি দিয়ে লেখা হয়েছিল। মুল্যবান রত্নের দেশ বার্মার খনিতে উৎপাদিত হয় বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম রত্ন চুনি, নীলা, জেড ছাড়াও অন্যান্য স্বল্প দামী পাথর। তাই তাদের ঐতিহাসিক স্থাপত্যে অলংকরনের জন্য এসব চুনী পান্নার বহুল ব্যাবহার লক্ষ্য করা যায়। তেমনি এই বিশালাকার বইটির প্রতিটি পাতার উপরের দিকে লাগানো ছিল একটি করে রত্নখন্ড।
১৮৮০ সালে বৃটিশরা বার্মা দখল করলে অন্যান্য অনেক দামী দামী জিনিসের সাথে এই বই এর পাতা থেকেও চুরি করে নেয় রত্ন আর স্বর্ন। সেই সাথে করে এর যথেষ্ট ক্ষতিসাধন।


বই এর পাতার ফাকে সরু পথ

পরবর্তীতে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বইটি আবার মেরামত করা হয়ে।তবে চুরি যাওয়া রত্নগুলো ফি্রিয়ে আনা যায়নি। এখন লেখাগুলো আর স্বর্নএর কালিতে লেখা নয়, সাধারন কাল রঙের কালিতে লেখা।
কুথোদ মঠ প্রাঙ্গনে বই এর এক একটি পাতার জন্য নির্মিত ছোট ছোট সাদা সাদা শুভ্র মন্দির যার চুড়োগুলো যাকে তারা ছাতা বলে থাকে তা ছিল সব স্বর্ননির্মিত। এখন অন্য ধাতুর উপর সোনালী রঙ করা।


পাথর বাধানো চত্বর যা রোদে তপ্ত তার মাঝে বই এর ব্যতিক্রমী পাতাগুলো সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো


কড়িডোরের দুপাশে বই



মন্দির প্রাঙ্গন

সারিসারি সাজানো বই এর পাতার মন্দিরগুলোর মাঝখান দিয়ে চলাচলের জন্য রয়েছে সুপরিসর রাস্তা। প্রতিটি মন্দির এর চারদিকে খিলানাকৃতির জানালা যাতে রয়েছে লোহার শিকের গরাদ।তবে বই এর পাতা থেকে বুদ্ধের বানীটি যাতে কাছ থেকে পড়া যায় তার জন্য সামনের এবং পেছনের দিকের লোহার গরাদ দুটো দরজার মত খোলা যায়।


একশ একুশ বছরের পুরনো বকুল গাছ

চারিদিক খোলা থাকায় সেই বই এর মন্দিরের ভেতর ঢেউ খেলে যায় পাশের ১২১ বছরেরও পুরনো বিশাল বিশাল বকুলগাছ থেকে ঝরে পড়া ফুলের সুবাস নিয়ে ভেসে আসা বাতাস। প্রচুর আলো বাতাসের পাশাপাশি আপনিও দরজা খুলে প্রবেশ করে পুরো পাতাটি কাছ থেকে পড়তে পারবেন। অর্থাৎ এই বই শুধু দূর থেকে চোখে দেখার জন্য নয়, এর ব্যবহার ও যেন সবাই করতে পারে সে ব্যবস্থা করেছিলেন দুরদর্শী রাজা মিন্ডন ।


বৌদ্ধ বিহারের ভেতর রাজা মিন্দনের বাধানো ছবি

উল্লেখ্য যে রাজা এই বইতে তার নিজের সম্পর্কে কিছুই বর্ণনা করেনি যা ছিল ব্যতিক্রম সেই যুগ এবং বর্তমান সময়ের জন্যও বটে । শুধু ৭৩০ তম শিলা পাতাতে লেখা আছে বিশ্বের বিস্ময় এই বইটি কিভাবে তৈরী হয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরন ।


বিস্ময়কর বই এর পৃষ্ঠা

রাজা মিনডন বই পড়তে ভীষন ভালবাসতেন। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তিনি দীর্ঘস্থায়ী কিছু রেখে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন সাহিত্য হচ্ছে সমাজে জ্ঞ্যান বিকাশের জন্য রেখে যাওয়ার একটি শক্তিশালী মাধম। কিন্তু কাগজের পাতায় লিখা বই বেশিদিন টেকেনা। রাজা মিনডনের চেয়েছিলেন তিনি যে বইটি সৃষ্টি করবেন তা যেন কমপক্ষে ৫০০০ বছর টিকে থাকে। এরই ফলে পাথরের পাতায় বুদ্ধের বাণী লিপিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন যা কিনা ৫০০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে।


দুপাশে বই এর পাতার সারির মাঝে একেশিয়ার ঝোপালো বৃক্ষ

এখন পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রান বৌদ্ধ ছাড়াও হাজার হাজার পর্যটক বিশ্বের এক বিস্ময়্কর কীর্তি দেখার জন্য এখানে ছুটে আসে। ইউনেস্কো এই ব্যাতিক্রমী বইটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষনা করেছে। স্থানটিও যথেষ্ট সুরক্ষিত। বিরাট কোন বিপর্যয় না ঘটলে বইটি হয়তো ৫০০০ বছর এভাবেই থাকবে এবং রাজা মিন্ডনের স্বপ্ন পুরন হবে।


আসার সময় এখানে অর্ঘ্য দিতে আসা এই বালিকাটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসলাম । সে আমাদের সাথে অনেকগুলো ছবি তুলেছিল

ছবিগুলো আমাদের ক্যামেরায় তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৫ সকাল ১০:২০
৩৭টি মন্তব্য ৩৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×