somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্যাম্বোডিয়ায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির খলনায়ক পলপট ও তার কুখ্যাত বন্দী শিবির তোল স্লেং/ এস-২১ জেনোসাইড মিউজিয়াম ( ছবি আর ইতিহাস)

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কুখ্যাত তোল স্লেং / এস-২১ নির্যাতন কেন্দ্র।
ক্যম্বোডয়ার রাজধানী নমপেন শহরের মাঝে একটি স্কুল ।কিশোর বালকের কল কাকলিতে যার মুখরিত থাকার কথা । সে কেন কবরের নৈঃশব্দ নিয়ে চুপচাপ হয়ে আছে ? নীরবে একের পর এক শ্রেনীকক্ষে ঢুকে চারিদিকে তাকাতেই কেন মরা মাছের চোখের মত ঘোলাটে হয়ে উঠছে পর্যটকদের চোখ! সবার চেহারায় বিষন্নতা আর মলিনতা একই সাথে আসন গেড়েছে যেন। হৃদয়ের গভীরে এই মাত্র সৃষ্টি হওয়া ক্ষতগুলোই কি বাঙ্গময় হয়ে ফুটে উঠছে তাদের চেহারায় ? একি গেট দিয়ে ঢোকার সময় লেখা নির্দেশাবলী পড়ে, নাকি অন্য কিছু ?


প্রবেশ পথে নির্দেশনা

ক্যম্বোডিয়া যাবার আগেই মেইলে কথা হলো আমার স্বামীর কলিগ এর সাথে । সে জানালো ‘তোমরা নমপেনের যেখানেই যেখানেই ঘুরে বেড়াও না কেন,দুটো দিন কিন্ত বরাদ্দ রেখো আমার জন্য’ ।
তাঁর কথা মত যেদিন নমপেন পৌছালাম তারপর দিন ঠিক সকাল নটায় গাড়ী নিয়ে আমাদের হোটেলে আসলেন ।আমরা লবিতে বসে ছিলাম, এসেই আমার স্বামীকে জড়িয়ে ধরলেন নাবি কান । লম্বা সুদর্শন নাবি কানের সুন্দর মুখেও স্থায়ী এক বিষন্নতার ছাপ যা ভেঙ্গে সারাটি দিনে খুব কম সময়েই উকি দিয়ে গেছে মেঘের আড়ালে থাকা সুর্য্যের মত তার এক চিলতে হাসি। তার কারন বলবো পরে।

সৌজন্য বিনিময়ের পর শুরু হলো আমাদের চলার পালা। শুরু হলো তার দেশের এক করুন সময়ের কাহিনী বর্ননা। আমরা দুজন নীরব শ্রোতা । মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে চলেছি ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত এক দানবের উত্থানের ইতিহাস।

১৯শে মে ১৯২৫ খৃষ্টাব্দে ক্যাম্বোডিয়ার কামপন থং প্রদেশের একটি গ্রাম। সেই গ্রামের এক উচ্চবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্ম হয় এক ছেলের নাম ছিল তার সালথ সার। নয় ভাই বোনের মাঝে আট নম্বর সালথ সার দশ বছর বয়সে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে রাজধানী নমপেনে এক আত্মীয়র বাসায় এসে উঠে।


পলপট ও তার সঙ্গীরা

১৯৪৯ সনে সালথ সার কারিগরী বিষয়ের উপর উচ্চতর পড়াশোনা করার জন্য বৃত্তি পেয়ে প্যরিসে যান। সেখানেই সে প্রথম মার্ক্সের সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ধারনা লাভ করে। রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ততার ফলে পরীক্ষায় অকৃতকার্য্য হয় এবং ১৯৫৩ সনে সে ক্যম্বোডিয়া ফিরে আসতে বাধ্য হয় । দেশে ফিরে বিভিন্ন জেলা শহরে কম্যুনিষ্ট শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সালথ সার তার ঘনিষ্ঠ কিছু সহযোগীদের নিয়ে শুরু করে দল গঠন। পরে যা কম্যুনিষ্ট পার্টি অফ ক্যাম্পুচিয়া ইন ক্যাম্বোডিয়া যা খেমার রুজ (লাল খেমার) নামে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে । ১৯৬৩ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত এই খেমার রুজের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্বে ছিল সালথ সার ।

সে সময় ক্যাম্বোডিয়ায় সৈন্যবাহিনীর প্রধান ছিল লন নল। রাজা সিহানুক তাকে পছন্দ করতোনা। কারন সে ছিল মার্কিন ঘেষা। আর সে সময়ই ভিয়েতনাম এর সাথে মার্কিনদের যুদ্ধ চলছিল। মার্কিন আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য ভিয়েতনামের সাধারন জনগন ছাড়াও মার্কিন বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত গেরিলারা ক্যম্বোডিয়ায় আশ্রয় নেয়। আমেরিকা এই ভিয়েতনামী গেরিলাদের ধ্বংস করার লক্ষ্যে ক্যম্বোডিয়ার মাটিতে নির্বিচারে বোমা বর্ষন করতে থাকে।তাতে অনেক সাধারন খেমার জনগন ও মারা যায়। সে সময় সাম্যবাদী দল গঠনে ব্যস্ত সালথ সার রাজনৈতিক কারনে ভিয়েতনাম পালিয়ে যায় আর তখন থেকেই সে পলপট নামে অভিষিক্ত হয়। খেমার ভাষায় পলপট অর্থ বড় ভাই।
এ সময় ক্যম্বোডিয়ায় অনেকগুলো ঘটনা এক সাথে ঘটে। তা হলো মার্কিন মদদ পুষ্ট জেনারেল লননল রাজা সিহানুককে উৎখাত করে ক্যম্বোডিয়ায় সরকার গঠন করে। রাজা সিহানুক প্রথমে চীন এবং সেখান থেকে পরবর্তীতে ইউরোপ পালিয়ে যান। সে সময় সিহানুক খেমার রুজ অর্থাৎ পলপটের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলছিলেন।


রাজা নরদম সিহানুক, নমপেনের রাজপ্রাসাদের বাইরে থেকে তোলা তাঁর তৈল চিত্র

১৯৭০ সনে পলপট উত্তর ভিয়েতনামের গেরিলা যোদ্ধাদের সহায়তায় লননলের সরকারী বাহিনীকে পরাজিত করে ক্যম্বোডিয়ার এক তৃতীয়াংশ দখল করে নেয়। এ সময় পুরো দেশ জুড়ে চলতে থাকে এক গৃহ যুদ্ধ।মার্কিন বোমায় ভিয়েতনামী গেরিলারা সরে গেলে সেই শুন্যতা পুরন করে পলপট।১৯৭৫ সালের ১৭ই এপ্রিল পলপট ও তার দল খেমার রুজ লননলকে পরাজিতে করে রাজধানী নমপেন অর্থাৎ পুরো ক্যম্বোডিয়া দখল করে নেয়।এর অল্পদিনের মধ্যেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

ক্ষমতা দখল করেই চীনের ভাবাদর্শে অনুপ্রানিত পলপট ক্যম্বোডিয়ার সমাজ পুনর্গঠনের নামে যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে তারই ধারাবাহিকতায় ঘটে ইতিহাসের এক ভয়াবহ গনহত্যা। শুরু হয় এক সীমাহীন ত্রাসের রাজত্ব যার স্থায়িত্ব ছিল চার বছর।


শিল্পীর কাঁচা হাতে আঁকা বটে কিন্ত খেমার রুজদের হিংস্রতা আর নির্মমতা ফুটে উঠেছে ঠিকই

খেমার রুজদের উদ্দেশ্য ছিল পুরো ক্যম্বোডিয়ায় একমাত্র কৃষক শ্রেনীই থাকবে আর কিছু নয়। যার ফলে পুরো নমপেন খালি করে জনগনকে কৃষিকাজের জন্য গ্রামের বিভিন্ন খামারে পাঠানো হলো। এই জনগনের বেশিরভাগই ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেনীর যার মাঝে ছিল শিক্ষক,পেশাজীবি,শিশু, কিশোর নারী, এমনকি যারা চশমা বা ঘড়ি ব্যবহার করতো তাদেরকেও ধনীক শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত করে পাঠানো হলো কৃষি খামারে। এদের মনে করা হতো উদবৃত্ত শ্রমিক। অনেকটা চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মত। কিন্ত খেমার রুজ বাহিনী এটা বুঝতে ব্যার্থ হয় যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় চীনের রাজনৈতিক/সামাজিক পটভুমি আর ক্যম্বোডিয়ার পটভুমিতে অনেক পার্থক্য ছিল।


কমরেড মাও সে তুং এর সাথে পলপট , শিল্পীর হাতে আঁকা

অনাহারে অর্ধাহারে দিনে পনের ঘন্টা হাড় ভাঙ্গা খাটুনি সাথে চাবুকের আঘাত আর নির্যাতনের ফলে অনেকেই সেখানে মৃত্যুবরন করে। তাদেরকে সেই খামারেই মাটি চাপা দিয়ে রাখা হতো । এমন গন কবরের সংখ্যা ছিল তিনশ র ও বেশি।
কর্নেল পিতার সন্তান নাবি কানের বয়স ছিল তখন সাত।ছোট বোন বছর তিনেকের। হাসি খুশী সচ্ছল ছোট সেই পরিবার পলপটের নিষ্ঠুর ঝড়ের আঘাতে যেন মুহুর্তে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পরলো। বাবা পালিয়ে গেলেন থাইল্যান্ড। দেশকে নরপশু সেই হায়েনার হাত থেকে মুক্ত করতে। নাবি কানকে পাঠানো হলো ফসলের ক্ষেতে শ্রমিক হিসেবে ,আর মা ছোট বোনকে নিয়ে পালিয়ে গেল গ্রামে। বাবা আর ফিরে আসেনি গত তিরিশ বছরে। ধারনা করা হয় পরে থাইল্যাণ্ড যখন পলপট সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তখন হয়তো এসব বিদ্রোহীদের কঠিনহাতে দমন করেছিল থাই সরকার। হয়তো তাদের হাতেই মৃত্যু হয়েছে প্রিয় সেই বাবার।


নাবি কানের সমবয়সী এক শিশু যে কিনা খেমার রুজের নির্যাতনে বন্দী শিবিরে প্রান দিয়েছিল

মা এর কি হলো জিজ্ঞেস করায় একটু ইতস্তত করে বল্লো জীবন বাঁচানোর জন্য একদা সেনা বাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার স্ত্রী, নাবি কানের মা এর সেই দুর্দশার কাহিনী। অভুক্ত শিশু আর নিজের জন্য খাবার চুরি করতে গিয়ে বার বার লোকজনের হাতে তার মা এর মার খাওয়ার করুন বর্ননা দিচ্ছিল সে থেমে থেমে ধীর লয়ে সসংকোচে।
শহর খালি করে সব ব্যক্তিকে কৃষি খামারের কাজে লাগানো হয়েছিল যার থেকে রেহাই পায়নি ৬/৭ বছর বয়সের নাবি কান। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত্য সামান্য খাবার খেয়ে ১৫ ঘন্টা অনভ্যস্ত কচি হাতে কাজ করতে গিয়ে কত অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল তাকে। নিজের ও পরিবারের সেই দুর্দশার ইতিহাস বর্ননা করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই তার গলা বন্ধ হয়ে আসছিল, ভিজে আসছিল চোখের কোন।আমরা বোবা হয়ে গিয়েছিলাম জাতিসঙ্ঘের এই কর্মকর্তার জীবন কাহিনী শুনে।


দেয়াল ঘেরা নির্যাতন কেন্দ্রের পাশের রাস্তা থেকে মুল গেটে যাবার আগে

রাজধানী নমপেনের মাঝখানেই উচু দেয়াল ঘেরা এক জায়গার পাশে আস্তে আস্তে গাড়ী থামলো। আমরা তিনজন হেটে গেটের সামনে আসতেই দেখি লাইন ধরে লোকজন ঢুকছে। আমরাও সেই সারিতে দাড়ালাম। পাশের ঘর থেকে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো মাঝাখানে একটি আঙ্গিনা তাতে সবুজ কিছু গাছ পালা আর সাদা চুনকাম করা কিছু কবর। দু একটা বেঞ্চ ও আছে বসার জন্য।


ভিয়েতনাম বাহিনীর হাতে খেমার রুজের পতনের পর যে কয়টি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল তাদের কবর

সেই প্রাঙ্গনের হাতের বাদিকে পুর্ব পশ্চিমে আর উত্তর দক্ষিন দিকে লম্বা তিন তলা সাদামাটা এক স্কুল ভবন যেমন সব দেশের সরকারী স্কুলগুলোর চেহারা হয়ে থাকে। কিন্ত ভেতরে ভেতরে তার কি ভয়াবহ বৈপরিত্ব যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। সেই স্কুলে টেবিল নেই, বেঞ্চ নেই, বই-খাতা নেই, নেই কিশোর কন্ঠের পড়াশোনার আওয়াজ, বা কলকাকলি।


সৃতি স্তম্ভের পেছনে স্কুল

কারন এক সময়ের সরকারী এই উচ্চ বিদ্যালয় জেনারেল পলপটের রাজত্বকালে পরিনত হয়েছিল এক কুখ্যাত নির্যাতন কেন্দ্রে। তুল স্লেং বা এস-২১ জেল নামে সারা বিশ্বে এর সমাধিক পরিচিতি। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ এই চার বছরে শুধু এখানেই প্রায় ১৭,০০০ থেকে ২০,০০০ নারী-পুরুষ এবং শিশুর নির্মম মৃত্যু ঘটেছিল খেমার রুজ বাহিনীর পৈশাচিক নির্যাতনে।কোন বাক্য দিয়ে খেমার রুজদের এই উন্মাদ আচরণ সম্পর্কে বললে উপযুক্ত হয় তাই হাতড়ে বেড়াচ্ছি আমি।


ক্লাশ রুমের ভেতর পচে গলে থাকা লাশের ছবি


উপরে আংটার সাথে পা এ দড়ি বেধে ঝুলিয়ে রাখা হতো বন্দীদের। খানিক পর পর নীচের পাত্রে রাখা পানিতে মাথা চুবিয়ে দিত যতক্ষন না তারা তাদের বিরুদ্ধে আনা মিথ্যে অভিযোগ স্বীকার না করতো ।

খেমার জাতিকে পরিশুদ্ধ করার যে উদ্দেশ্য নিয়েছিল পলপট ও তার সঙ্গীরা তারই ফলশ্রুতিতে দেশ ব্যাপী গড়ে উঠে এই সব নির্যাতন কেন্দ্র। ভূতপুর্ব সরকার অথবা বিদেশী সরকারের সাথে যোগাযোগ রয়েছে এমন সন্দেহভাজন ব্যক্তিবর্গ, পেশাদার এবং বুদ্ধিজীবি, থাই, চাইনী্‌জ, ভিয়েতনাম নৃ জনগোষ্ঠী ছাড়াও খৃষ্টান যাজক, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী কেউ রেহাই পায়নি নৃশংস পলপট বাহিনীর তৈরী এই নির্যাতন কেন্দ্র থেকে। একমাত্র মৃত্যুর মাধ্যমেই তারা মুক্তি পেয়েছি। এই শুদ্ধি অভিযানের উদ্ভট ইউটোপিয়ান চিন্তাধারা তাকে বিবেকহীন অমানুষ এক উন্মাদ খুনীতে পরিনত করেছিল।


পা এ লোহার এই বেড়ী পড়িয়ে এই লোহার খাটে রাখা হতো বন্দীদের


কাছ থেকে দেখা
একের পর এক শ্রেনী কক্ষে ঢুকছি আর হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি মানবতার বিরুদ্ধে খেমার রুজদের বীভৎস,ভয়ংকর সেই জঘন্য অপরাধের চিনহগুলো দেখে। মানুষকে নির্যাতন এর জন্য কত যে সরঞ্জাম থাকতে পারে তা আমার ধারনার বাইরে ছিল। বাকরুদ্ধ পর্যটকরা ঘুরে ফিরছিল শ্রেনী কক্ষ থেকে শ্রেনী কক্ষে।


একদা এই স্কুলের ক্লাশের সামনে টানা বারান্দা

সারি সারি শ্রেনী কক্ষের ভেতরের দেয়ালগুলোতে টাঙ্গানো রয়েছে সন্দেহর ভিত্তিতে ধরে আনা মানুষের ছবি যাদের ভেতর রয়েছে শিশু, কিশোর, নারী ছাড়াও বিভিন্ন বয়সী ব্যক্তির নম্বর লাগানো ছবি। এদের সবাই খেমার রুজদের অকথ্য নির্যাতনে মৃত্যু্র কোলে ঢলে পড়েছিল।এদের মাঝে রয়েছে কিছু বিদেশীও যাদের বিভিন্ন দেশের চর সন্দেহে ধরে আনা হয়েছিল। সেই পৈশাচিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তারা অনেকেই তাদের উপর আরোপিত মিথ্যা অভিযোগকেই স্বীকার করে নিয়েছিল।টাঙ্গানো রয়েছে বর্ননা শুনে শুনে শিল্পীদের হাতে আঁকা সে সব লোম হর্ষক ঘটনার চিত্র।


মৃত বন্দীদের আলোকচিত্র


ঘরের পর ঘর এর দেয়াল জুড়ে হতভাগ্যদের নম্বর দেয়া বাধানো ছবি


কি বুঝেছিল কি রাজতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রের পার্থক্য এই এক নম্বর মৃত্যুবরন করা শিশুটি !


নির্যাতনে মৃত সন্দেহ ভাজন খেমার রুজ বিরোধী


বিদেশী চর সন্দেহে এদের ধরা হয়েছিল


নির্যাতন থেকে বাচার জন্য মিথ্যে স্বীকরক্তি


গলায় বৈদ্যুতিক তার পেঁচানো যুবকের চোখদুটি আমি এখনো ভুলতে পারি নি

কিছু বড় বড় ঘরকে পার্টিশন দিয়ে ছোট ছোট রুমে পরিনত করেছিল তারা।। সেগুলো দেখে আমার দম বন্ধ হয়ে আসলো। চওড়ায় আড়াই ফিট আর লম্বায় আনুমানিক ৫ ফিট চারিদিক বন্ধ সেই ঘরের দরজায় একটা মাত্র ছোট্ট চৌকনা জানালা। বন্দীরা যেন একে অপরের সাথে কিছু বিনিময় না করতে পারে তার জন্য ঘর গুলোর মাঝে অল্প একটু ফাক রাখা হয়েছিল।


ক্লাশ রুমের ভেতর কাঠ দিয়ে তৈরী সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বন্দী শালা


মেঝেতে শুকিয়ে থাকা রক্তের দাগ


অত্যাচারের জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম


এই কাঠের বাক্সের চারিদিকে লোহার আংটার সাথে টেনে হাত পা বেধে রাখা হতো , ভেতরে থাকতো পানি যাতে কিছুক্ষন পর পর মুখ ডুবিয়ে ধরা হতো বন্দীদের ।

অভিযোগ স্বীকার না করা পর্যন্ত তাদের উপর চলতো অকথ্য নির্যাতন তারপর ফেলে রাখা হতো সেই কুঠুরীত। নির্যাতনের যে বিভিন্ন সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়েছিল সেগুলো ঠিক সেভাবেই সাজিয়ে রাখা আছে।


পা বেধে রাখার জন্য লোহার ডান্ডা বেড়ী , সাজিয়ে রেখেছে

লাল রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে কোন কোন ছোট ছোট কুঠুরীর মেঝেতে, চোখের পানি দেখি নি কোথাও, হয়তো সেই অমানুষিক নির্যাতনে শুকিয়ে গিয়েছিল তাদের চোখের জল। কিন্ত আমাদের চোখ তখন আদ্র হয়ে এসেছে। ঝাপসা চোখেই দেখে চলেছি শিশু কিশোরদের ছবিগুলো। এক নম্বর বন্দী হিসেবে চিনহিত এই ছোট বাচ্চাটি কি বুঝে রাজনীতির সেটাই ভাবছি ক্ষনে ক্ষনে।দেয়ালের ভেতর থেকে যেন আমাদের কানে ভেসে আসছিল সেই সব মৃত আত্মার করুন আর্তনাদ কি ফরিয়াদ।


পলপট সরকারের পতনের পর বন্দী শিবিরে পাওয়া বন্দী এক হতভাগ্যের ফুলে ওঠা লাশ

আমি এক সময়ে ফিস ফিস করে নাবি কানকে বললাম ‘শোনো এমন অনেক দেশেই হয়েছে, আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবিদের হত্যা, হিটলারের গ্যাস চেম্বারে ইহুদী হত্যা, হুতু টুটসী । আমাকে থামিয়ে দিয়ে সে আর্ত গলায় বলে উঠলো, ‘ইয়েস আই নো জুন , বাট দিস ইজ ডিফারেন্ট, হি, হি কিল্ড হিজ ওন পিপল’।
তাঁর এই আর্তনাদের মত কথাটি শুনে আমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম।বর্তমানে ক্যাম্বোডিয়ায় এমন একটি ব্যক্তিও খুজে পাওয়া যাবে না যার আপনজন এই নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হয়নি।

অবশেষে ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনাম সেনাবাহিনীর হাতে খেমার রুজ সরকারের পতন ঘটলে চার বছরের এই নারকীয় রাজত্বের অবসান ঘটে। এরপর গত তিরিশ বছর ধরে দেশের ভেতর আর বাইরে থেকে এই নারকীয় গনহত্যাযজ্ঞ পরিচালনাকারীদের বিচারের জোর দাবী উঠছিল। কিন্ত কেন জানি তা কার্যকর হচ্ছিল না । অবশেষে ১৯৯০ এর দশকে এসে জাতিসঙ্ঘ আর ক্যাম্বোডিয় সরকার যৌথভাবে বহু মানুষের আকাংখিত এই আন্তর্জাতিক মানবতা বিরোধী বিচারের জন্য আদালত গঠন করেন


পলপট

দুর্ভাগ্য ক্যাম্বোডিয়ার জনগনের যে তারা এই নৃশংস হত্যাকারী পলপটের বিচার দেখতে পারে নি দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার ফলে। ভিয়েতনাম বাহিনীর হাতে খেমার রুজের পতনের পর সে প্রথম থাইল্যন্ড পালিয়ে যায় এবং সেখান থেকে পরে চীন তার ক্যন্সারের চিকিৎসার জন্য । ১৯৮৯ সনে ভিয়েতনাম বাহিনী ক্যম্বোডিয়া ছেড়ে গেলে পলপট আবারো তার বাহিনীকে সঙ্ঘঠিত করার চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়। কারন তার দলের লোকেরা অনেকেই তখন দলত্যাগ করছিল । অনুপস্থিত আসামী হিসেবে দেশের বিচারে তার শাস্তি হয়েছিল গৃহবন্দী । কিন্ত তাকে সরকার বন্দী করতে পারে নি ।
১৯৯৮ সালে পলাতক পলপট বিবিসির খবরে শুনতে পেলো তারই হাতে গড়া দলের লোকেরাই শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার জন্য তাকে আন্তর্জাতিক আদালতের হাতে তুলে দেবে । এ কথা শুনে সেই রাতেই লক্ষ মানুষের হত্যাকারী, সারা পৃথিবী জুড়ে ঘৃনার সাথে উচ্চারিত নাম পলপট হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু বরন করে। কারো কারো মতে অতিরিক্ত ওষুধ খেয়ে সে আত্যহত্যা করেছিল । তখন তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৭২ বছর। তবে মৃত্যুর আগে সে বলেছে এই গনহত্যার বিষয়ে তার কোন ধারনা ছিল না।

পলপটের পরে যে নেতা ছিল সেকেন্ড ব্রাদার নামে পরিচিত নুন চিয়া এখনো জীবিত । আন্তর্জাতিক এই আদালতে ৮২ বছর বয়সী নুন চিয়ার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উঠেছে তার সবগুলোই সে অস্বীকার করেছে। তার কথা হলো সে মানুষ হত্যার জন্য দায়ী নয়, তার দায় হলো এই সব লক্ষ লক্ষ মানুষকে পাইকারী ভাবে হত্যার হাত থেকে রক্ষা করার ব্যর্থতা।


আদালতের কাঠগড়ায় ডুএচ ওরফে কাই গুয়েক

এরপর যে ছিল সেই টর্চার চেম্বারের প্রধান তার নাম কাং কেক লিউ ওরফে কাইং গুএক যে কিনা ডুচ Duch or Deuch নামেই সব চেয়ে বেশি পরিচিত। আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে বিচারের সময় তার নিজ হাতে খেমার ভাষায় লেখা স্বীকোরক্তি যা এখন মিউজিয়ামে রাখা আছে তার কয়েকটি লাইন পড়ে শোনালো কান। অবশ্য পাশেই ইংরাজীতে অনুবাদ করা রয়েছে বিদেশীদের জন্য। তাতে সে লিখেছে সে নির্দোষ, কারন এসব নির্যাতন সে তার নিজের ইচ্ছেয় করে নি, করেছে আংকার নির্দেশে।আংকা হলো একটি ফরাসী শব্দ যার অর্থ পলিট ব্যুরো ( দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব)। অর্থাৎ তাদের সংঘঠনের নেতৃত্বের নির্দেশেই এসব নির্যাতন চালিয়েছে।


কাই গুয়েক এর নিজ হাতে খেমার ভাষায় লেখা স্বীকোরক্তি।

আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারে ডুচের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে। ক্যম্বোডিয়ার মানুষ বিশ্বাস করতে পারেনি এই নরপশু কোনদিন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে । যেদিন সে কাঠগড়ায় দাড়িয়েছিল সেদিন ক্যম্বোডিয়ার লাখো জনগন ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল তার বিচার দেখার জন্য।


নিরপরাধ এই সব মৃত বক্তিদের আত্মীয়রা ভিড় করেছিল কারা রক্ষক ডুচ সহ অন্যান্যদের বিচার প্রত্যাশায়

বের হয়ে আসার আগে দেখা হলো ভিয়েতনাম সৈন্যের হাতে মুক্ত সেই এস-২১ এ বেঁচে থাকা মাত্র সাত জন সৌভাগ্যবান বন্দীর মাঝে্র শেষ জীবিত ব্যক্তিটির সাথে। তার নাম চৌ মে। নির্যাতন কেন্দ্রে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে লাষ্ট সারভাইভার নামে একটি বই লিখেছেন। সব হারানো চৌ মে এই বইয়ের এক জায়গায় প্রশ্ন রেখেছে, ‘আমি কেন বেচে রইলাম’! তাঁর স্বাক্ষরসহ সেই অমুল্য বইটি কেনার এবং তার সাথে বসে কিছু আন্তরিক মুহুর্ত কাটানোর সৌভাগ্য আমার হয়েছিল এই ভ্রমনে।


শেষ জীবিত বন্দী চৌ মে তার বই হাতে যার একটি কপি কেনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে


যে ছোট্ট কুঠুরীতে চৌ মে কে দিনের পর দিন থাকতে হয়েছিল পায়ে ডান্ডা বেড়ি পড়ে

বের হয়ে আসতে আসতে ভাবছিলাম আজ যদি কোন প্রফেশনাল গাইডের সাথে কুখ্যাত এস-২১ এ আসতাম তবে হয়তো তার সযত্ন চর্চিত গলায় শুনতে পেতাম এর গৎবাধা এক ইতিহাস । কিন্ত নাবি কানের সাথে আসার ফলে মনে হলো ইতিহাসের সেই সময়টিকেই যেন ধারন করছি আমরা , এবং সেই দুঃখভারাক্রান্ত অনুভূতির কিছুটা যা কান ধারন করে আছে হৃদয়ে।

স্কুলটি এখন ওয়ার ক্রাইম মিউজিয়াম নামে পরিচি্ত। জীবনে অনেক মিউজিয়াম দেখেছি কিন্ত এমন মিউজিয়াম দেখার দুর্ভাগ্য যেন আর না হয়।
এরপরের গন্তব্য শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে এক বধ্যভুমি।
চলবে ----

ছবি আমাদের ক্যামেরায় ।
২য় পর্ব (ছবি) Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০২১ দুপুর ১২:১৫
৬৬টি মন্তব্য ৬৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×