চুয়েং এক বধ্যভুমি
তোল স্লেং বা এস-২১ কারাগার থেকে বের হয়ে রওনা হোলাম নমপেন শহর দক্ষিনে থেকে ১৭ কিমি দূরে এক প্রাক্তন ফলবাগানের উদ্দেশ্যে। হয়তো ভাবছেন ফল বাগানে কেন ? না সেই ফল বাগান এখন সাজানো গোছানো এক নীরব শ্মশান , যা চার বছরের ত্রাসের রাজত্বে খেমার রুজদের হাতে পরিনত হয়েছিল এক বধ্যভুমিতে নাম চুয়েং এক জেনোসাইড মিউজিয়াম।
টিকিট কেটে হলুদ রঙের দৃষ্টি নন্দন গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই চারিদিকে শান্ত -নিরিবিলি এক ভাব গাম্ভীর্য্য পরিবেশ লক্ষ্য করলাম । গেটের পাশেইই রয়েছে হেডফোনের ব্যবস্থা। যা আপনি কানে দিয়ে বিভিন্ন দিক নির্দেশনার সাথে শুনতে পাবেন এখানকার সেই নির্মম ইতিহাস।
গেটের পাশেই রয়েছে নীল রঙ্গের ম্যাপ , কানে হেডফোন লাগিয়ে শুনতে পাবেন কোন পথ ধরে আপনাকে চলতে হবে
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ এই চার বছর ধরে তোল স্লেং কারাগারে যেসব সন্দেহভাজন বন্দী ছিল নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা অভিযোগের স্বীকোরক্তি আদায়ের পর এখানে এনে তাঁদের হত্যা করতো পলপটের হাতে তৈরী সেই খেমার রুজ বাহীনি। এমন অগনিত বধ্যভুমি সারা ক্যম্বোডিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে এগুলোর মাঝে এই বধ্যভুমিটি উল্লেখযোগ্য। এখানে পাওয়া গেছে ৮ হাজার ৮৯৫ টি শবদেহ ।
গেট দিয়ে ঢুকতেই দূরে দেখা যাচ্ছে বৌদ্ধ স্মৃতি স্তম্ভটি যা সেই সব হতভাগাদের স্মরনে নির্মিত ।
জেসি রয়েল নামে এক কোম্পানী নমপেনের মিউনিসিপ্যলিটির সাথে ৩০ বছরের এক চুক্তির মাধ্যমে এই বধ্যভুমিটি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছে। তাদের সাথে শর্ত হলো সেখানে মাটির নীচে চিরশয্যায় শায়িত আর কাউকে যেন কখনো বিরক্ত না করা হয়।
ডান দিকে তাকালে দেখা যাবে লাল রঙের মিউজিয়াম ।
ডান দিকে কোনায় দেয়াল ঘেষে লাল দোচালা ট্র্যডিশনাল নির্মান শৈলীতে তৈরী একতালা মিউজিয়ামটি। আমরা মিউজিয়ামের দিকে এগিয়ে গেলাম। ছোট খাটো এই যাদুঘরে মুলত দুটি রুমেই সাজানো রয়েছে পলপট সৃষ্ট খেমার রুজদের নৃশংসতার কালো অধ্যায়।
মিউজিয়াম এর দরজা
মিউজিয়াম
মন ভার করে এরপর বাগানের ডান দিক দিয়ে বাধানো সরু পথ ধরে এগুতে এগুতে চলেছি আর দেখছি বিনা অপরাধে খেমার রুজদের হাতে পৈশাচিক নির্যাতনে প্রান দেয়া লোকগুলোর গন কবর। সেখানে খুজে পাওয়া বিভিন্ন নিদর্শন সাজিয়ে রাখা হয়েছে ।
গাছের ফাকে সরু এই বাঁধানো পথ ধরে এগিয়ে চলেছি
এ মাটির নীচেই রয়েছে শত শত হতভাগ্যের শবদেহ
এই বাগানে শায়িত রয়েছে যারা তাদের কাউকে যেন আর বিরক্ত না করা হয়
খেমার বাহিনীর হাতে নিহতদের একটি গন কবর
এখানে অল্প মাটির নীচে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল যাদের, বৃষ্টিপাতে বেরিয়ে এসেছে তাদের শরীরের হাড়গোড় আর তাতে জড়ানো ছিন্ন মলিন কাপড়।
হতভাগ্যদের গায়ে পাওয়া ছিন্ন বস্ত্র যার মাঝে ছিল কিছু শিশুদের কাপড়চোপড় ।
এখানে পাওয়া গিয়েছিল মুন্ডুহীন ১৬৬ টি শবদেহ , খেমার রুজদের ছুরির এক পোঁচে যাদের মাথাগুলো বিচ্ছিন্ন হয়েছিল দেহ থেকে
হত্যার জন্য যে সব সরঞ্জাম ব্যবহার করতো পলপটের বাহিনী, সেগুলো রাখার ঘর
শত শত নিরপরাধ শিশুদের কচি কচি পা ধরে ঘুরিয়ে এনে এই গাছটির গুড়িতেই বাড়ি মেরে মেরে মাথা ফাটিয়ে মেরেছিল নরপশুরা । তাদেরকে স্মরন করে সহমর্মিতা প্রকাশ করে গেছে দর্শকরা হাজারো রঙ্গীন রাঁখি ঝুলিয়ে, এর মাধ্যমে হয়তো বলছে "আমরা তোমাদের ভুলিনি"।
এই সেই নির্বাক গাছ যার মাথায় উচ্চস্বরে বাজানো হতো লাউড স্পীকার যাতে মৃতদের শেষ করুন আর্তনাদ বাইরে কারো কানে না পৌছায়
কুঁড়িয়ে আনা হাড়গোড় সাজিয়ে রাখা হয়েছে কাঁচের বাক্সে
এরপর এগিয়ে গেলাম সেই সুউচ্চ বৌদ্ধ স্তুপার দিকে যাতে সযত্নে সাজিয়ে রাখা আছে সেই সব হতভাগাদের হাড়গোর ।
বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে
ভেতরে দুজন শ্বেতাংগ পর্যটক , আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি প্রবেশ পথের দিকে
কে যেন তাদের স্মরণ করে হলুদ ফুল দিয়ে গেছে
খুব খেয়াল করে দেখলে দেখা যাবে তাদের মাথার খুলিতে রয়েছে আঘাতের চিনহ ।
দরজা দিয়ে ঢুকে দেখি অনেক উচু পর্যন্ত এক কাচের শোকেস । তার চারিদিক ঘেষে সরু করিডোর । সেই করিডোরে দাঁড়িয়ে দেখি সেই শোকেসের থাকে থাকে সাজিয়ে রাখা জিনিসগুলো কোন শোপিস নয় । সেগুলো হলো সেই বধ্যভুমিতে প্রান হারানো কিছু বন্দীর মাথার খুলি , হাড়গোড় আর তাদের হত্যা করার জন্য যেসব অস্ত্র ব্যবহার করেছিল সেই খেমার রুজ পশুরা তার কিছু চিনহ। যা দেখে উপস্থিত সবার গা শিউরে উঠছিল। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই । ঘুরে ঘুরে দেখছি আর ভাবছি মানুষ কি এত নৃশংস হতে পারে।
এখনো তারের বাধনে বাঁধা এক জোড়া পা
শুন্য চোখে চেয়ে আছে তারা, দর্শকদের প্রতি আছে কি কোন অভিযোগ, নাকি উপহাস ! অথবা ঘৃনা !
ফরেন্সিক রিপোর্ট অনুযায়ী নীচের অস্ত্রগুলো কিভাবে তাদের মৃত্যু ঘটিয়েছিল তার চিত্র রয়েছে । কাঁচের ভেতর থাকার জন্য এবং সরু করিডোরে দাঁড়িয়ে তার ছবি ভালো মত তোলা সম্ভব হয়নি । আর এসব দেখে শুনে মনটাও এত বিষন্ন ছিল যে ছবি তোলার চিন্তা করিনি ।
এই লাঠির বাড়িতে মাথা ফাটিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করতো খেমার রুজরা
পেছনে দাড় করানো ছবিটি ভালো করে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন কোদাল দিয়ে কিভাবে তাদের মাথায় আঘাত করে হত্যা করেছিল তার ফরেনসিক রিপোর্টের কাল্পনিক ছবি
মৃত্যু নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত ছুরির একটি
বন্দীদের জীবিত অবস্থায় কান কেটে ফেলা হতো এমন অস্ত্র দিয়ে
আস্তে আস্তে বের হয়ে আসি সেই স্তুপা থেকে যার মাঝে সাজিয়ে রাখা আছে তাদের যারা আজও মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত
পেছন ফিরে দেখা চুয়েং এক বধ্যভুমির বিশ্বখ্যাত সেই বৌদ্ধ স্তুপা
বের হয়ে আসি সেই বিষন্ন বাগান থেকে এই তোরণ পেরিয়ে । ভালো থেকো , শান্তিতে থেকো যারা বহু কষ্ট সহ্য করে অবশেষে এখানে শায়িত আছো চির নিদ্রায় ।
সেই বধ্যভুমিতে খেমার রুজ বাহিনীর হাতে নির্যাতিত ও চির নিদ্রায় শায়িতদের দীর্ঘশ্বাস আর চাপা কান্না গায়ে মেখে মন ভার করে যখন হোটেল কক্ষে ফিরে এলাম তখন প্রায় বিকেল। নাবি আমাদের নিয়ে পাশেই রাজবাড়ী দেখার কথা বল্লো । আগামী কাল যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলাম। কারন আজ যা দেখে এসেছি তারপর রাজবাড়ীর জৌলুস দেখার ইচ্ছে বা মন মানসিকতা ছিল না ।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে সব কিছু হারানো নাবি কান হয়তো অনেক ক্ষোভে দুঃখে বলেছে যে,‘এমন গন হত্যার নজির আর কোন দেশে নেই’ ।
তারপর ও আমার মনে ভেসে উঠেছিল আমাদের সেই রুমী, বাকী, বাবুল, জুয়েল সহ নাম না জানা অসংখ্য অকুতভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। যারা পাক হানাদার ছাড়াও রাজাকারদের হাতে ধরা পরে নির্যাতনে নির্যাতনে প্রান হারিয়েছিল, প্রান হারিয়েছিল এদেশের লাখো জনগন, তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি শিশু আর নারীরাও।
পাশবিক নির্যাতনের পর আমাদের বোনের মৃত্যু যে ছবি আজও আমাদের কাঁদায়
আমাদের সেই সব বুদ্ধিজীবি যাদের পরিকল্পিত ভাবে স্বাধীনতার ঠিক ঊষালগ্নে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল যে রাজাকার আলবদর বাহিনী, তারা কিন্ত অন্য জাতি নয় তারা আমাদের মত একই বাংলার মানুষ । ঘৃনা রইলো বিজয় দিবসের প্রাক্কালে সেই সব ঘৃন্য রাজাকার আলবদর বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের প্রতি।
একাত্তরের হানাদার পাক-বাহিনী ও তার দোসরদের নির্মম নির্যাতনে এমনি করুন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে পরে আছে আমাদের দেশের সেই সব হতভাগ্য সন্তানরা
সকল দেশের গন হত্যায় নিহত মানুষের প্রতি পুর্ন শ্রদ্ধা রেখে আমার এই লেখাটি উৎসর্গ করলাম তাঁদের স্মরণে ।
ব্লগের সবাইকে বিজয় দিবসের সশ্রদ্ধ শুভেচ্ছা ।
শেষের দুটো ছবি নেট থেকে । বাকি সব আমাদের ক্যামেরায় তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০২১ দুপুর ১২:২২