somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশ্বের রহস্যাবৃত টেম্পলের অন্যতম এক উদাহরন ক্যম্বোডিয়ার "বেয়ন -- প্রাসাৎ বেয়ন"

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কঠিন শিলা পাথরে খোদাই করা বোধিস্বত্বা লোকেশ্বরা মতান্তরে স্বয়ং রাজা জয়বর্মনেরই মুখাবয়ব ।
আপনারা অনেকেই হয়তো বাম স্ট্রোকারের লেখা বইটিতে সেই রক্ত পিপাসু কাউন্ট ড্রাকুলার গা ছম ছমে ভৌতিক দুর্গের বিশদ বিবরন পড়েছেন কিম্বা ছবি দেখেছেন। অথবা পাইরেটস অব দ্য ক্যরিবিয়ান ম্যুভিটির কথাই না হয় মনে করুন, সেখানে সেই যে সাগর থেকে আচমকা উঠে আসে এক বহু পুরনো ভাঙ্গাচোড়া ভুতুড়ে জাহাজ। যা দেখে আমরা চমকে উঠেছি, গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল অনেকের।এংকরথমের মাটির পথ ধরে খানিকটা এগিয়ে একটা বাঁক ঘুরতেই নীল আকাশের পটভুমিতে বিশাল বড় বড় মুখ সহ কালো পাথরের তৈরী এক ব্যতিক্রমী স্থাপত্য তার অতিলৌকিক অবয়ব নিয়ে আমাদের চোখের সামনে যখন ঝট করে জেগে উঠলো, সেই মুহুর্তে ঠিক তেমনটিই চমকে উঠেছিলাম আমরা ।


এক অপার্থিব নান্দনিকতায় মাখা সৌধটি আমাদের বিস্মিত চোখের সামনে

ক্যম্বোডিয়ার প্রাচীন এংকর নগরীর এংকরভাট যা কিনা বিশ্বের এক নতুন বিস্ময় আর বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রতীক তা- প্রহম মন্দির অরন্য আর পাথর যেন শত বছরের দৃঢ় আলিঙ্গনে, বিখ্যাত টুম্ব রেইডার ম্যুভির "তা -প্রহম" আমার চোখে দেখে ক্লান্ত শ্রান্ত আমাদের নিয়ে টুক টুক চালক পরবর্তী গন্তব্যের কাছাকাছি পৌছালো। বেশ খানিকটা আগে থেকেই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠা যে কালো পাথরের এক অদ্ভুত রহস্যময় স্থাপত্য তখন তা নেমে দেখার বা উপভোগ মত করার অবস্থা আমাদের ছিল না ।

আমি টুকটুকের ভেতর থেকেই বিস্মিত নেত্রে তাকিয়ে দেখছি সেই অর্ধ ভঙ্গুর কিন্ত অচিন্তনীয় এক অনিন্দ সৌন্দর্য্য নিয়ে গর্বিত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যতিক্রমী নকশায় নির্মিত সৌধটির দিকে। সামনের আঙ্গিনায় তখন বেশ পর্যটকের ভীড়। তাদের বিচিত্র রঙএর কাপড়চোপড়ে এক অদ্ভুত কোলাজ সৃষ্টি করেছে যেন ।


পর্যটক

আমি নামবো না শুনে বিস্মিত টোম জানালো, ‘এটা এংকর নগরীর অন্যতম এক দ্রষ্টব্য বিশ্ব ঐতিহ্যের আরেকটি প্রতীক , এটা দেখার জন্য দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কত শত লোক আসছে আর তোমরা দেখবে না এটা কি করে হয় ! অন্তত নেমে এসে এখানে দাঁড়াও আমি তোমাদের দু একটা ছবি তুলে দেই’। তাতেও আমি রাজী হইনি , আমার সহপর্যটক নেমে দূর থেকেই সেই বিস্ময়কর সৌধ আর তার পাশে এক খোলা মন্দিরের দু একটা ছবি তুলে ফিরে আসলো ।


বুদ্ধমুর্তির সামনে এই অদ্ভুত পাখিটির ভাস্কর্য্য

সারাদিনের ঘোরাঘুরি আর প্রচুর পথ হাটাহাটিতে ক্লান্ত বিপর্যস্ত আমরা ফিরে আসলাম হোটেলে। লবিতে ঢুকতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে আসলো অত্যন্ত আন্তরিক আর হাসিখুশী যুবক ম্যনেজার। কি কি দেখে এলাম আগ্রহ ভরে জানতে চাইলো। আমরা সেই সৌধটি দেখিনি শুনে সে পর্যন্ত অবাক হলো । আমাদের সে বিশেষভাবে অনুরোধ করলো আমরা যেন আরেকদিন তাদের প্রাচীন রাজধানীতে একটু ক্ষনের জন্য হলেও অন্তত ঘুরে আসি ।


আরেক দিক দিয়ে বেয়ন

তিনদিনের জন্য কাটা মাথাপিছু ৪০ ডলারের টিকিটের মাত্র এক দিন শেষ হলো । তাদের কথা শুনে ঠিক করলাম পরদিন আগে থেকে সেট করা প্রোগ্রামে যাবো । তারপর সারাদিন রেষ্ট নিয়ে পরদিন না দেখা সব জায়গায় যাবো । ধীরে সুস্থে ঘুরবো যেন কিছু না দেখা থেকে যায় । আর পুরো এংকর নগরী যেখানে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অর্থাৎ বিশ্ব ঐতিহ্যের আওতায় সেখানে এই ব্যতিক্রমী নকশার মন্দির না দেখে কি পারি।


বেয়ন সামনে থেকে

প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকৃতি পুজারী খেমাররা খৃষ্ট পুর্ব ৫০০ শতাব্দী থেকে ৯০০ পর্যন্ত ভারত থেকে আর্যদের নিয়ে আসা বৈদিক ধর্মের উপাসনা শুরু করে । এর উপাস্য ছিল আগুন, সুর্য্য ইত্যাদির কল্পিত মুর্তি।
পরবর্তীতে এর মিলনেই উৎপত্তি ঘটে হিন্দু ধর্মের এবং সাধারন থেকে রাজপরিবারেও উপাস্য হয়ে উঠে হিন্দু তিন প্রধান দেবতা ব্রম্মা , শিব এবং বিষ্ণু ।প্রথম দিকে শিবের আধিপত্য থাকলেও এগারোশ শতকে এংকর নগরী্তে প্রধান পুজ্য ছিল বিষ্ণু । এরপর হিন্দু ধর্মের সংস্কারের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা বৌদ্ধ ধর্ম চীন জাপান থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া শ্রীলংকা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে । ঐ সময় খেমার রাজবংশও বর্নহীন শ্রেনী হীন সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে গঠিত বুদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরে। যার ফলশ্রুতিতে তারা বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং একে রাস্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষনা করেন ।


সড়কের এক পাশে একটি অস্থায়ী মন্দিরে গৌতম বুদ্ধ নাকি স্বয়ং জয়বর্মন-৭ প্রশ্নই থেকে গেল ?

এংকরভাট নির্মানের ১০০ বছর পর বিখ্যাত খেমার রাজা সপ্তম জয়বর্মন তাদের চিরশত্রু চামদের পরাজিত করে এংকর নগরী অর্থাৎ খেমার রাজ্য থেকে সমূলে উৎপাটিত করেন। তারপর এংকরভাট থেকে এক কিলোমিটারেরও কম দুরত্বে নতুন এক রাজধানী গড়ে তোলেন নাম তার এংকরথম। সপ্তম জয়বর্মনের মৃত্যুর পর শেষ খেমার রাজা পর্যন্ত সবারই রাজধানী ছিল এংকরথম।অর্থাৎ রাজধানী হিসেবে এংকরথমের আয়ুস্কাল ছিল সব চেয়ে দীর্ঘ।


পর্যটকের পদভারে মুখরিত বেয়ন প্রাঙ্গন

একদিন বিশ্রাম নিয়ে অর্থাৎ শহরের বিখ্যাত বাজারে ঢু মেরে কেটে গেল সিয়াম রেপ আসার তৃতীয় দিন। চতুর্থদিন সকাল ঠিক নটার সময় এংকরভাট থেকে এক কিমি দুরত্বে সপ্তম জয়বর্মনের রাজধানী এংকরথমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পথের মাঝেই আমাদের থামিয়ে টিকিট চেকাররা শেষবারের মত আমাদের টিকেটটা পাঞ্চ করে দিল। আজ এংকরে ঘুরে বেড়ানোর টিকিট আর আমাদের সিয়েম রেপ থাকার শেষ দিন।


বোধিসত্বা লোকেশ্বরা বা জয়বর্মনের মুখ তোরন শীর্ষে

এংকরভাটকে হাতের ডাইনে রেখে কিছুদুর এগুতেই চোখে পড়লো এক ব্যতিক্রমী ও সেই সাথে নান্দনিক ডিজাইনের এক প্রবেশ দুয়ার ।সেই তোরনের গোপুরায় রয়েছে কালো শিলা পাথরে তৈরী হাসি ভরা মুখমন্ডলের ভাস্কর্য্য বুদ্ধ ভিন্নমতে স্বয়ং জয়বর্মনের মুখ আর পথের দুপাশে সেই চিরাচরিত সমুদ্র মন্থনের পাথরে নির্মিত ভাস্কর্য্য । যার এক দিকে দেবতা আরেক দিকে অসুর ।


পীচ ঢালা মসৃন পথ চলে গেছে রাজধানী এংকরথমে আর তার আগে পথের দুপাশে সমুদ্র মন্থনের সেই চিরচেনা ভাস্কর্য্য । একদিকে দেবতা আরেক দিকে অসুর ।


জলাধারে ঘেরা এংকরথম আর বাদিকে সারিবদ্ধ অসুরের দল নাগরাজ বাসুকীর দেহ টেনে টেনে সমুদ্রে মন্থনে ব্যস্ত

নিরাপত্তার জন্য সে সময়ের নিয়মা্নুযায়ী রাজধানী এংকরথম ছিল চারিদিকে গভীর জলাশয় আর সুউচ্চ প্রাচীর বেষ্টিত।
রাজধানীতে প্রবেশ করেই মাটির পথ ধরে কিছুদুর এগুতেই গাছের আড়াল থেকে উকি দিল সেদিনের সেই অদ্ভুত আকৃতির সৌধটি তার অনন্য রূপ নিয়ে ।


রাজধানী প্রাচীর


আরেকদিক থেকে বেয়ন মঠ / মন্দির

টুকটুক থেকে নেমে খানিকক্ষন বিস্ময়াভুত হয়ে তাকিয়ে রইলাম সৌধটির দিকে ।রাজা সপ্তম জয়বর্মন (১১৮১-১২১৮) বারোশ শতাব্দীর শেষ ভাগে অথবা ১৩ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজধানী এংকরথমে একের পর এক অসাধারন শৈল্পিক নৈপুন্য ভরা এক একটি সৌধ নির্মান করে গিয়েছিলেন। যেগুলো তাদের ব্যতিক্রমী নির্মান শৈলী আর সৌকর্য্যে সেই সময়কে যেন ছাড়িয়ে গিয়েছিল এর মাঝে তাহ প্রম নিয়ে আমি আগেই আলোচনা করেছি। আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরবো এংকরথমের তেমনি আরেকটি অসাধারন স্থাপত্য নিদর্শনকে।


পাহারারত সিংহ দরজা ধরে ভেতরে এগিয়ে চলেছি

এংকরথমের ঠিক বুকের মাঝ বরাবর ভারী জমকালো অঙ্গসজ্জা আর নান্দনিক নকশায় তৈরী বর্তমানে বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রতীক এই সৌধটি যেন স্থাপত্যকলার এক দমবন্ধ করা রূপ। রাজা সপ্তম জয়বর্মন তাঁর রাস্ট্রীয় মন্দির হিসেবে হিসেবে একে অতি যত্নে গড়ে তোলেন যা বেয়ন বা প্রাসাৎ বেয়ন । নামে পরিচিত ।


প্রবেশপথের মুখেই দেখা হলো রাজা সপ্তম জয়বর্মনের সাথে

বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী রাজা জয়বর্মন -৭ এই মঠটিকে মহান বুদ্ধের নামে উৎসর্গিত আশ্রম হিসেবে গড়ে তুললেও শেষ অবধি তা আর থাকেনি। তাঁর পরবর্তী রাজারা কেউ ছিলেন শৈব ধর্মের অনুসারী কেউবা তেরাভাদা বুদ্ধধর্মালম্বী । অর্থাৎ রাজন্যবর্গের ধর্ম পরিবর্তনের সাথে সাথে বেয়ন নামে শিল্পিত বৌদ্ধ মঠটি হয়ে উঠেছে কখনোবা হিন্দু ধর্মীয় উপাসনালয় কখনোবা বৌদ্ধ মন্দির।


সবচেয়ে উচু চুড়া

প্রাচীর ঘেরা রাজধানীর একদম কেন্দ্রস্থলে এর অবস্থান থাকায় কোন দিকে তেমন বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়নি। ওরই মাঝেই যতটুকু সম্ভব সংযোজিত বিয়োজিত হয়েছে। এ ভাবেই এই মন্দিরের নকশায় বারুক, হিন্দু এবং খেমার তথা বৌদ্ধ স্থাপত্য রীতির সংমিশ্রনে লাভ করেছে এক জটিল রূপ। স্থাপত্যের গঠন প্রক্রিয়াসহ ব্যপক পরিবর্তন আসে আরাধ্য দেবতাদের মুর্তিতেও ।


উপরের স্তরে

বর্তমানে আপনি যা দেখতে পাবেন এখানে তার অনেক কিছুই আদিতে ছিলনা। যেমন মন্দিরের পূর্ব পাশের প্রাঙ্গনটি। বাড়ানো হয়েছে উপরের টেরেস এর কিছু অংশ । ছিলোনা এখনকার লাইব্রেরীটিও । নতুন করে বসানো হয়েছে ভেতরের গ্যালারীর চারকোন বিশিষ্ট কর্ণারগুলিও অর্থাৎ পরে যা যা সংযোজিত হয়েছে তা সেই মন্দিরকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরেছে। ফলে এর তিনটি স্তরই হয়ে পড়েছে সংকুচিত।


উপর থেকে দেখা যাচ্ছে নীচের গ্যালারী যা পরে তৈরী করা হয় এবং জায়গার অভাবে সংকুচিত


ডানে বামে চলে গেছে গ্যালারীর সারি যাতে আছে বিভিন্ন দেয়াল চিত্র

বেয়নের মন্দিরের বিভিন্ন স্তরে যে ৫৪ টি টাওয়ারের তথ্য জানা যায় তার মাঝে কালের ঝড় ঝঞ্জায় হারিয়ে গিয়ে বর্তমানে টিকে আছে মাত্র ৩৭টি। আর তার প্রত্যেকটিতে রয়েছে তিনটি বা চারটি করে কম বেশী প্রায় ১৪৭ থেকে বুদ্ধের অতিকায় মুখাকৃতির ভাস্কর্য্য। প্রাথমিক নির্মানের সময় কম বেশি ৫৬ টি টাওয়ারে ২১৬টি এমন প্রকান্ড মুখায়বয়ব ছিল বলে ধারনা করা হয়।
এই ভাস্কর্য্যগুলোর সাথে স্বয়ং রাজা সপ্তম জয়বর্মনের মুখাকৃতির পুরো সাদৃশ্য রয়েছে বলে গবেষকরা ধারনা করেছেন। ভিন্নমতাবল্মবীরা বলছেন অন্যকথা, তাদের মতে এগুলো সব বোধিস্বত্ত্ব বা লোকেশ্বরার করুনাময় আরেক রূপ।


প্রতিটি টাওয়ারে রয়েছে লোকেশ্বরা ভিন্নমতে রাজা জয়বর্মনের চেহারাই


উপরের প্রাঙ্গনে বোধিসত্তার আদলে তৈরী জয়বর্মনের মুখমন্ডলই কি খোদিত ?

এসব ধারনাকে পাত্তা না দিয়ে ফ্রেঞ্চ গবেষক জর্জ সেডিস আরো একধাপ এগিয়ে বলেছেন , এই বুক চিতিয়ে রাখা প্রতিকৃতিগুলো খেমার সম্রাজ্যের সর্বময় হিসাবে জয়বর্মনের নিজেকে “দেবরাজ” হিসাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা । কারন তার পূর্বপুরুষেরা যেখানে ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং নিজেদেরকে তারা দেবতা শিব এবং শিবের প্রতীক শিবলিঙের সাথে তুলনা করতেন তাই জয়বর্মনও স্বাভাবিক ভাবেই নিজেকে বুদ্ধ ও বোধিস্বত্ত্বার রূপে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন।


শত শত পর্যটকের মাঝে আমরা

যে যাই বলুক সেই মেঘমুক্ত আকাশের বুকের মতো বিশাল আর ঈষৎ বঙ্কিম ঠোটে রহস্যময় এক হাসি ধরে রাখা, অর্ধনিমীলিত ছায়াঘন চোখ নিয়ে পাথরে খোদিত সেই অজস্র মুখ দেখে আপনি সত্যি বিস্ময়াভুত হবেন একথা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি ।


বোধিসত্বা তথা রাজা জয়বর্মনের হাস্যোজ্বল মুখাবয়ব

উপরের সেই সরু প্রাঙ্গনে শত শত পর্যটক ঘুরে বেরাচ্ছে । এক মহিলা কয়েকটি অল্প বয়সী মেয়েকে অপ্সরার মত সাজিয়ে সবচেয়ে উচু টাওয়ারে ওঠার সিড়িতে বসিয়ে রেখেছে। তাদের ছবি তুলতে হলে আপনাকে ১০ ডলার গুনতে হবে । আমি এমনি একটি ছবি তুলে নিলাম তাদের ।


কিশোরী মেয়েগুলো অপ্সরা নাকি খেমার রানী সেজে আছে জানা হলো না


পর্যটকের ভীড়ে ভারাক্রান্ত বেয়ন

তিনটি স্তরে নির্মিত এই মন্দিরের প্রথম এবং দ্বিতীয় স্তরের বাইরের গ্যালারীর বাইরের দিকে দেয়ালে দেখবেন অসাধারন সব দেয়াল ভাস্কর্য্য। এংকরবাসী খেমারদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা আর ইতিহাস বর্নিত আছে এতে। এই দেয়াল ভাস্কর্য্যের কাজগুলি সম্পর্কে কোনও তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়নি ফলে আপনি বুঝে উঠতে পারবেন না, কোন সময়ের বা কোন ঘটনার ছবি এগুলো । অনিশ্চয়তায় পড়তে হবে এগুলোকে মেলাতে গিয়ে ।


নৃত্যরতা অপ্সরা দেয়াল ভাস্কর্য্য


দেয়ালের গায়ে আঁকা সেসময়কার খেমারবাসীর দৈনন্দিন জীবন যাত্রা
সপ্তম জয়বর্মনের নাতি অষ্টম জয়বর্মন যিনি শৈব ধর্মের অনুসারী ছিলেন তার আমলে ভেতরের গ্যালারী করা হয়েছে সেখানে রয়েছে পৌরানিক সব ঘটনার বাস রিলিফ । বেশীর ভাগটাতেই রয়েছে হিন্দু পুরানের কাহিনী । তাই আপনি এখানে দেখতে পাবেন শিব, বিষ্ণু, ব্রম্মাকে । দেখা পাবেন স্বর্গের অপ্সরাদের , রাক্ষস রাজ রাবন ও দেবতা বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের রূপ । এই সব তৈরী করতে গিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য তৈরী করা ১৬টি প্রার্থনা কক্ষ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল এছাড়াও তিনি তার পিতামহের তৈরী দেবতা বুদ্ধের বেশিরভাগ মুর্তি ভেঙ্গে চুড়ে ফেলে ।


ভগ্নপ্রায় প্রাসাৎ বেয়ন

এই দেয়ালের আরেকটি প্যানেলে দেখতে পাবেন সপ্তম জয়বর্মনের পুর্ব পুরুষ কুষ্ঠরোগাক্রান্ত রাজা প্রথম যশবর্মনকে (৮৮৯ – ৯১৫ খৃঃ) যিনি “লেপার কিং”নামে ইতিহাসে সমাধিক পরিচিত। সে কালের ধারণানুযায়ী রাজা যশবর্মন খালি হাতে একটি দৈত্যাকৃতি সাপের সাথে যুদ্ধে মত্ত হলে সাপের কামড়ে তার হাতে বিষ ঢুকে যায় এবং এরই ফলে তিনি কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হন।


লেপার কিং এর ভাস্কর্য্য এলিফ্যান্ট টেরাসের উপরে

পরবর্তীতে এই রোগটিই ধীরে ধীরে খেমারবাসীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে । এই পুরো কাহিনীটিই বাস রিলিফে খোদাই করা আছে । তবে আমেরিকান ঐতিহাসিক ও গবেষক ডেভিড পি স্যন্ডলারের মতে সপ্তম জয়বর্মনের ছেলে দ্বিতীয় ইন্দ্রবর্মনই হলেন এই বিখ্যাত লেপার কিং বাংলায় কুষ্ঠ রাজা । এই দেয়ালে আরো আছে অস্পষ্ট করে খোদাই করা অমৃতের জন্য ক্ষীর সাগর মন্থনের দেয়াল চিত্র ।


গ্যালারীর ছাদ উপরের স্তর থেকে


উপর থেকে মন্দিরের একটি কোনার ভাস্কর্য্য

এই ভেতরের গ্যালারীর মাঝেই মাটি থেকে খানিকটা উপরে অনেকখানি জুড়ে আছে উপরের প্রাঙ্গনটি । এর অবস্থান আর গঠনশৈলী দেখে বিশেষজ্ঞদের ধারনা মন্দিরের মূল স্থাপত্যে ‌এটা থাকার কথা নয় । এটা হয়তো পরে সংযোজিত হয়েছে । কারন, স্থাপনাগুলো এমন ধাঁচে তৈরি যে এই বেয়ন মন্দিরটিকে তা-প্রহম মন্দিরের মতোই একতলা বিশিষ্ট স্থাপত্য কর্ম বলেই মনে করতে হয় । কিন্ত কোন ধারনার স্বপক্ষেই কোন তথ্য উপাত্ত নেই। সবই ধারনার উপর ভিত্তি করা ।


উপরের স্তরে


উপরের টেরাসে

ইনার গ্যালারীর মতোই বেয়ন মন্দিরের কেন্দ্রীয় টাওয়ারটিও প্রথমে স্তুপাকৃতির ছিলো । পরে এটাকে ভরাট করে গোলাকৃতি দেয়া হয় । ভূমি থেকে এর উচ্চতা ৪৩ মিটার । মন্দিরের ভিত্তি স্থাপনের সময় কেন্দ্রীয় টাওয়ারের প্রানকেন্দ্রে ৩.৬ মিটার উঁচু ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের বসা অবস্থার মূর্ত্তি স্থাপিত হয়েছিলো । যার মাথায় ছায়া বিস্তার করে ছিলো সর্পরাজ মুকুলিন্দার ছড়ানো ফণা ।
হিন্দু ধর্মের অনুসারী রাজা অষ্টম জয়বর্মন বুদ্ধের এই মুর্ত্তিটি ভেঙে টুকরো টুকরো করেন । ১৯৩৩ সালে বেয়ন মন্দির সংরক্ষকেরা টুকরোগুলো একটি পরিত্যক্ত কূপের মধ্যে খুঁজে পান এবং টুকরোগুলো জোড়া লাগিয়ে এ্যাংকরের একটি ছোট্ট প্যাভেলিয়নে স্থাপন করেন ।


এমনি করে অনেক কিছুই ভেঙ্গে চুড়ে পরে আছে

অসধারন এক স্থাপত্যকলার নিদর্শন এই বেয়ন নিয়ে অনেক কিছু বলার আছে। একে নিয়ে করতে পারেন আপনি গবেষনা । তবে প্রথম দেখায় আমি পুরোপুরি তাকে দেখতে পারিনি । এ জন্য নিয়ম হলো কোন কিছু পরিপুর্নভাবে দেখতে হলে একবার দেখে এ বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত দেখে তাকে দ্বিতীয়বার দেখা। সে আশায় থাকলাম যদি আরেকবার দেখা হয় রহস্যের বাতাবরণে আচ্ছাদিত সপ্তম জয়বর্মন নির্মিত বেয়ন যা যুগের পর যুগকে অতিক্রম করে গেছে নির্দ্বিধায় ।
আর আমাদের সেই হোটেল ম্যনেজার আর টুকটুক চালক টোমের প্রতি রইলো অপরিসীম কৃতজ্ঞতা যারা আমাদের এই ঐতিহাসিক জায়গাটি দেখার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিল । আর তা না হলে এই লেখাটাও আমার হতো না ।


বেয়ন প্রাসাৎ বেয়ন


সর্বোচ্চ চুড়ায় সেই অতিকায় মুখ


কাছ থেকে


উপরের প্রাংগনে


মঠের দেয়ালে খোদাই করা কারুকার্য্যে ভারতীয় নকশার প্রভাব লক্ষ্যনীয় ।


আমার কেনা কাঠের উপর লোকেশ্বরা


এই জানালাটি খালি পেতে আমাকে সাত থেকে আট মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল :(


তথ্য সুত্রঃ নিজ চোখে দেখা,গাইডের কাছে শোনা এবং উপরের বইগুলো ।


সব ছবি আমাদের ক্যমেরায় তোলা
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:১৪
৮৩টি মন্তব্য ৮৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×