তখন সেন্ট্রাল গভঃ বয়েজ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন জনাব বজলে কাদের। বেশভূষায় তিনি অত্যন্ত পরিপাটি ছিলেন। দূর থেকে দেখা, তাই এর চেয়ে বেশী আর কিছু মনে নেই, তবে এটুকু বুঝতাম যে স্কুলে এবং স্কুলের বাইরেও তিনি একজন অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। খুবই রাশভারী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। এয়াকুব আলী চৌধুরী স্যার বাংলা পড়াতেন, হোম ওয়ার্ক এর ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস ছিলেন। পরে শুনেছি তিনি খিলগাঁও হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন। গুলজার হোসেন নামে একজন ঢিলেঢালা পায়জামা পাঞ্জাবী পড়া শিক্ষক ছিলেন, যিনি ইংরেজী, অঙ্ক, ধর্ম সবকিছুই পড়াতেন, তবে তাকে মনে রেখেছি ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা চকে তার চমৎকার ইংরেজী হাতের লেখার জন্য। সিরাজুল ইসলাম স্যার ইংরেজী পড়াতেন। ইংরেজী বই এ বেগম রোকেয়ার উপর একটা ছোট নিবন্ধ ছিল। বেগম রোকেয়ার নাম কেউ Rokeya উচ্চারণ করলে বা এভাবে লিখলে তিনি ভীষণ ক্ষেপে যেতেন। তিনি ওটাকে কেটে দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে Ruqaiyah কথাটা লিখে দিতেন, মুখেও তিনি রুক্বাইয়াহ উচ্চারণ করতেন। পরে জেনেছি যে বেগম রোকেয়া স্বয়ং তার নামটি ওভাবেই লিখতেন। সিরাজুল ইসলাম স্যার সিলেটী ছিলেন। যতক্ষণ ইংরেজী বলতেন, খুব চোস্ত বলতেন। সাধারণ ছাত্রদের জন্য কিছু বাংলায় বুঝিয়ে বলতে গেলেই অরিজিনাল সিলেটী ভাষা বেড়িয়ে পড়তো। অবশ্য আমার কাছে সেটাও মন্দ লাগতো না।
তখন স্কুলটা একটা নবনির্মিত দোতলা বিল্ডিং ছিলো। উত্তরে রাজারবাগ পুলিশ লাইন তথা সদর দপ্তর, একটু এক্সটেন্ডেড দক্ষিণে মতিঝিল কলোনী, পূর্বে শাহজাহানপুর আর পশ্চিমে টি এন্ড টি কলোনী ছিলো। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা থাকতো। আমরা স্কুলের পাঁচিলে বসে রাজারবাগ চানমারিতে পুলিশের প্রশিক্ষণ ফায়ারিং, বার্ষিক কুচকাওয়াজ আর দমকল বাহিনীর অগ্নি নির্বাপনী মহড়া প্রত্যক্ষ করতাম। আমাদের স্কুলের পাশেই ছিলো সেন্ট্রাল গভঃ গার্লস হাই স্কুল। পাশাপাশি দুটো স্কুল একই বেষ্টনী প্রাচীর দ্বারা বিভক্ত ছিলো। তবে উভয় স্কুলের জন্য ছিলো একটাই কমন অডিটোরিয়াম। নজরুল-রবীন্দ্র জয়ন্তী ও ইত্যাকার অনুষ্ঠানাদি এলে বড়ভাইদের দেখতাম খুব আগ্রহভরে অপেক্ষা করতেন কখন ক্লাস শেষে অডিটোরিয়ামের দরজা খুলবে। সেখানে তারা আপুদের সাথে একসাথে রিহার্সাল করতেন। বলাই বাহুল্য, এসব করতে গিয়ে তাদের কারো কারো মধ্যে প্রেমের প্রথম পাঠও নেয়া হয়ে যেতো। এ তথ্য প্রকাশ পেতো এখানে সেখানে এর ওর মুখে আলোচনার মাধ্যমে। যারা লাইলী মজনু বা শিরি ফরহাদের মত হয়ে উঠতো, তাদের নামগুলি জ্বলজ্বল করে কে বা কারা বাথরুমের দেয়ালে কিংবা হেথা হোথা লিখে রাখতো প্লাস চিহ্নের মাধ্যমে। যেমনঃ জামিল+দিনা, সোনা+রূপা, খোকা+ নিরু ইত্যাদি। আমার এ লেখাটা পড়ে আমার এক পরিব্রাজক পাঠক আমায় জানিয়েছেন যে এই প্লাস(+) চিহ্নের ব্যাপারটা নাকি বিশ্বজনীন। তিনি বিশ্বের আরো অনেক দেশে এমনকি ইউরোপেও এর অনুরূপ ব্যবহার প্রত্যক্ষ করেছেন। “মিউনিখের অলিম্পিয়া টাওয়ারেও দেখেছি এই প্লাস চিহ্ন। প্রেমের ভাষা সার্বজনীন” – তিনি আমায় জানিয়েছেন। আমি ভেবেছিলাম, প্লাস চিহ্নের ব্যাপারটা শুধু বাংলাদেশেরই কালচার। তার দেয়া তথ্য জেনে আমার সে ভুল ভাঙলো। অবশ্য আমিও আমেরিকায় বেড়াতে গিয়ে নিউ ইয়র্ক এর Howes Cave এর সুগভীর গুহার ভেতরেও প্লাস চিহ্নে আবদ্ধ কিছু নাম উৎকীর্ণ থাকতে দেখেছি।
স্কুলে আমার রেজাল্ট অভিভাবকদের মোটামুটি সন্তুষ্টি অর্জন করতে পেরেছিলো বলে স্কুলের উপর তারা ও আমি উভয় পক্ষই সন্তুষ্ট ছিলাম। আমার জন্য সবচেয়ে প্রিয় সময় ছিলো টিফিন পিরিয়ডে ছোট টেনিস বল দিয়ে কোনদিন ফুটবল, কোনদিন “বোম্বাস্টিং” খেলা। আর স্কুল শেষে হাঁটা পথে বাড়ী ফেরার আগে কয়েকজন মিলে দুটি দলে ভাগ হয়ে আসল ফুটবল দিয়ে একই গোল পোস্টে কিছুটা সময় ফুটবল খেলে যাওয়া। আবার কোন কোন দিন সোজা বাসায় গিয়ে বই রেখে বাসার আবহাওয়া বুঝে পুনরায় স্কুলের মাঠে চলে আসতাম। সেদিন খেলাটা একটু বেশী হতো। ক্লান্তও বেশী হতাম আবার তিরস্কারের সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে বাড়ী ফিরতাম, কেননা আমার প্রতি পাখী ঘরে ফেরার পূর্বেই বাড়ী ফেরার নির্দেশ ছিলো।
এভাবেই স্কুলে দুটো সুখের বছর অতিবাহিত করার পর একদিন টের পেলাম আমাকে নিয়ে বাসার সবাই কি যেন ভাবছে। আজন্ম লাজুক, তাই পরিবারের কারো কাছেই মুখ খুলে কোন কিছু জিজ্ঞেস করতাম না। একদিন সন্ধ্যায় আব্বা আমাকে এক ফটো স্টুডিওতে নিয়ে গেলেন ছবি তোলার জন্য। ফিরে এসে দেখলাম, তিনি আর বড়ভাই মিলে মন দিয়ে কি একটা ফরম পূরণ করছেন। বড়ভাই একপা অগ্রসর হয়ে নির্দেশ দিয়ে বসলেন, এখন থেকে আমাকে বাসায় ইংরেজীতে কথা বলতে হবে। ভুলচুক হলেও কোন সমস্যা নেই, তবে ইংরেজী বলতে হবে। এক মহা সমস্যায় পড়ে গেলাম। নিজেই মনে মনে কিছু বাংলা কথাকে সাজিয়ে নিয়ে সেটাকে ইংরেজীতে কিভাবে বলবো তা একনিষ্ঠভাবে আওড়ে যেতাম। কিছুদিন পরে একদিন বড়ভাই আমার ইংরেজীতে কথা বলার ব্যাপারে কিছুটা উন্নতি হয়েছে কিনা তা পরখ করার জন্য জিজ্ঞেস করলেন, "রশুন ইংরেজী কী, তা জানো?" পেঁয়াজ ইংরেজী কী, তা জিজ্ঞেস করলে আমি তার উত্তর দিতে পারবো, সেটা তিনি জানতেন। ধরার জন্যই রশুনের অবতারণা। তাই এসব প্রশ্ন ট্রশ্ন আমার খুব একটা ভালো লাগতোনা, আবার উপেক্ষা বা প্রতিবাদ করার সাহসও ছিলোনা। তবে, আমার ঐ মনে মনে আওড়ানোর অভ্যেসটা একটু একটু করে কাজ দিচ্ছিলো। আমি একটু বিরক্তি নিয়েই বললাম, "আই ডু নট নো এনিথিং এবাউট ইওর রশুন"। এত বড় একটা ইংরেজী বাক্য (তখনকার আমার তুলনায়) খাতায় অবলীলায় লেখতে পারতাম, কিন্তু তা আমার মুখে কেউ কখনো উচ্চারিত হতে শুনেনি। কথাটা শুনে তাই বড়ভাই একটু হকচকিয়ে গেলেও বাবা মা সহ বাসার আর সবাই বোধকরি সন্তুষ্টই হয়েছিলেন এবং অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলেন। পরে অবশ্য বড়ভাইও ঐ হাসিতে যোগ দিয়েছিলেন।
চলবে…
এর ঠিক আগের র্পবটা রয়েছে এখানে: আমার কথা - ১
ঢাকা
০৪ জুলাই ২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ১১:১১