somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার কথা - ১৫

৩০ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার কথা - ১৪ পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন।

আন্তঃহাউস গার্ডেনিং প্রতিযোগিতাঃ
আন্তঃহাউস আর্টস এ্যন্ড ক্র্যাফ্টস প্রতিযোগিতার মত আরেকটা প্রতিযোগিতা যেটাতে দক্ষতা নির্বিশেষে সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হতো, সেটা ছিলো আন্তঃহাউস গার্ডেনিং প্রতিযোগিতা। বাগান করার জন্য আমাদের হাউসের সামনে যে জমিটুকু বরাদ্দ করা হয়েছিলো, সে্খানে ছিল ইমারত নির্মাণকালীন সময়ে ইট সুরকি ইত্যাদির ভাগাড় আর পানি ধরে রাখার পাকা হাউস বা জলাধার। প্রতিদিন আমাদেরকে গেমস পিরিয়ডের পরে ঘন্টাখানেক সেখানে শারীরিক শ্রম দিতে হতো। মাটি ভীষণ শক্ত ছিলো, কোদাল চালালে শুধু ইট পাথর আর সুরকির কণা বেরিয়ে আসতো। এরকম একটা জায়গায় ফুল ফোটানো খুবই দুঃসাধ্য একটা কাজ ছিলো। প্রথম প্রথম হাউস মাস্টার আর হাউস টিউটরগণ স্বয়ং এসব কাজ তদারকি করতেন। পরেরদিকে তারা আর আসতেন না। হাউস প্রিফেক্টদের উপরেই তারা এ দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। এ দায়িত্ব পালনে আমাদের হাউস প্রিফেক্ট বদরুল ভাই অত্যন্ত নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে আমাদের কাজ তদারকি করতেন যেন কেউ ফাঁকি দিতে না পারে। কখনো কখনো তিনি এ ব্যাপারে আমাদের সাথে বেশ নির্দয় আচরণও করতেন, তবে আমরা সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম যখন আমাদের হাউস প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলো। তিনিও আমাদেরকে বুঝিয়েছিলেন যে তিনি ওটুকু কঠোর না হলে আমরা প্রথম হতে পারতাম না। মাত্র কয়েক মাসের পরিশ্রমে ইট সুরকির বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল ফোটাতে পারবো, এ কথা আমরা তখন স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। এর পর থেকে আমি যতবার কলেজে গিয়ে ঐ বাগানটা দেখেছি, ততবারই স্মরণ করেছি ঐ মাটিতে আমাদের কতটা ঘাম ঝরানো আছে। প্রথম পুরস্কার পাওয়ার পর থেকে বদরুল ভাই আমাদের সাথে সদয় আচরণ করতেন। আমরাও তার কর্তব্যনিষ্ঠার আলোকে তার রূঢ় আচরণটুকু সহজে মেনে নিয়েছিলাম।

আমার মনে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের ছবিঃ
এমসিসিতে আমার দেখা প্রথম প্রিন্সিপাল ছিলেন কর্ণেল এম এ আনসারী (অবঃ)। তিনি লম্বা, ফর্সা, ঋজু গঠনের ছিলেন। তিনি অবসরপ্রাপ্ত ছিলেন বিধায় সামরিক পোষাক পরিধান করতেন না, তবে তিনি অন্যান্য শিক্ষকদের মতই সাদা শার্ট, সাদা ট্রাউজার্স, কালো জুতো আর বেল্ট এবং কলেজ টাই পড়তেন। শিরদেশে পরিধান করতেন তার নিজস্ব ট্রেডমার্ক হেডগীয়ার, ফেল্ট হ্যাট। সপ্তম শ্রেণীতেই আমরা ভূগোল পড়তে গিয়ে স্ট্রলারের জিওগ্রাফী বই রেফারেন্স বই হিসেবে লাইব্রেরীতে পেয়েছিলাম। সেখানে সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহ আর সৌরমন্ডলীয় অন্যান্য হেভেনলী বডিজের রঙিন ছবি দেখে মুগ্ধ হ’তাম। আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগতো সৌরজগতের ষষ্ঠ গ্রহ (সূর্য থেকে দূরত্ব অনুযায়ী) স্যাটার্ন এর ছবি দেখতে। গ্রহটির বিশেষ সৌন্দর্য ছিলো স্যাটার্ন রিংস বা শনির বলয়। দূর থেকে প্রিন্সিপালের হ্যাট পরিহিত মাথাটা দেখলে স্যাটার্ন রিংস এর মতই মনে হতো। আনুষ্ঠানিক মার্চপাস্টের সময় এডজুট্যান্ট যখন প্যারেডকে এ্যটেনশনে (আমাদের সময় ড্রিল এর ওয়ার্ডস অব কমান্ড ছিলো ইংরেজীতে, তাই আমি সেভাবেই লিখবো) রেখে তাঁর কাছে রিপোর্ট করতেন, তখন তিনি স্যালুটের জবাবে আঙুলের ডগা দিয়ে তাঁর হ্যাটটাকে সামান্য উঁচিয়ে ধরতেন। মার্চ পাস্টের সময় স্টেজের সামনে গিয়ে আমরা যখন “আইজ রাইট” করতাম, তখনো তিনি হ্যাটটাকে সেভাবে উঁচিয়েই স্যালুট গ্রহণ করতেন। তখনই জেনেছিলাম, বেসামরিক পোষাকে মাথায় হেডগীয়ার পরিহিত থাকলে সামরিক অফিসারগণ ওভাবেই স্যালুট গ্রহণ করে থাকেন।

কর্ণেল আনসারীর একটা প্রিয় ও প্রায়োচ্চারিত বাক্য ছিলোঃ “One bad fish spoils the whole pond”। তাঁর কথা ছিলো দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। আমাদের হাউসে আমার চেয়ে দুই ব্যাচ সিনিয়র ক্লাসে পারভেজ সাত্তার(?) নামে এক বড়ভাই ছিলেন। তিনি এক রাতে তারই এক ব্যাচমেটের সাথে মারামারি করেছিলেন। বক্সিং মেরে নাক মুখ ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। প্রিন্সিপাল খবর পেয়ে সাথে সাথে ছুটে এসেছিলেন। ঘটনার বৃত্তান্ত শুনে তিনি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পারভেজ ভাইকে কলেজ থেকে বের করে দেয়ার। তখনকার দিনে তো মোবাইল ছিলনা। ঢাকার সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলো ওয়ার্লেস বার্তা, মগবাজার এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে। প্রায়শঃ সেই ওয়ার্লেস এক্সচেঞ্জেটি বিকল থাকতো। মগবাজার মগবাজার বলে গলা ফাটিয়েও অপারেটর ঢাকার সাথে সংযোগ করাতে পারতোনা। তবুও ঐ রাতের মধ্যেই পারভেজ ভাইকে ঢাকায় তার বাড়ীতে পৌঁছে দেয়া হয়েছিলো। এখনকার দিনে একজন অধ্যক্ষ কতটুকু স্বাধীনভাবে এ ধরণের কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবেন, তা সকলের জন্যই সহজে অনুমেয়।

প্রতি সোমবারে (সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস) আমাদের মর্নিং এ্যসেম্বলী হতো। সেখানে একজন ক্যাডেট সুরা ফাতিহাসহ পবিত্র ক্বোরান থেকে কিয়দংশ মুখস্থ তেলাওয়াৎ করার পর আমাদের ইসলামিয়াত শিক্ষক সেটার ইংরেজী অনুবাদ আর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতেন। তারপরে প্রিন্সিপাল স্যারও কিছুটা আলোকপাত করে অন্যান্য জরুরী বিষয়ের উপর বক্তব্য রাখতেন। ইংরেজীতে দেয়া তার বক্তৃতা শুনতে আমার খুব ভালো লাগতো। আমাদের ক্লাসের জয়নুল আবেদীন (এখন অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল) আর আমিনুল হক (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী শিপিং ব্যবসায়ী, নতুন সেনাপ্রধানের বড়ভাই আর ঢাকা উত্তরের নতুন মেয়রের ছোটভাই) খুব ভাল ক্বিরাত পাঠ করতে পারতো। এরা দু’জনেই বেশীরভাগ সময়ে মর্নিং এ্যসেম্বলীতে ক্বিরাত পাঠ করতো। তখন কেবলই আমার জীবনে ইংরেজীতে কথা বলা আর শোনার চর্চা শুরু হয়েছে। তাই এ্যসেম্বলীতে যেকোন ইংরেজী বক্তৃতা এবং প্রশ্নোত্তর খুব মনযোগ দিয়ে শুনতাম, আর কারো কারো পারদর্শিতা দেখে খুব বিস্মিতও হতাম। এখানে বলে রাখি আমাদের ইসলামিয়াত শিক্ষক জনাব হায়দার আলী স্যার ছিলেন সমগ্র কলেজের মধ্যে ইংরেজীতে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বক্তা (তখনকার দুইজন ব্রিটিশ শিক্ষককে সঙ্গত কারণে এ হিসেবের বাইরে রেখে)। তিনি যেমন ছিলেন স্মার্ট, তেমনি ছিলেন অগাধ জ্ঞানের অধিকারী এবং একজন আপাদমস্তক ক্রিকেট অনুরাগী। তিনি চেইন স্মোকার ছিলেন। প্রতিদিন টীচার্স রুম থেকেই একটা সিগারেট ধরিয়ে তিনি আসতেন এবং ক্লাসে ঢোকার আগে বারান্দায় রাখা পাত্রে আধখাওয়া সিগারেটটা ফেলে তিনি ক্লাসে ঢুকে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে তার অনর্গল বক্তৃতা শুরু করতেন। একজন ইসলামিয়াত শিক্ষকের এমন পরিচয় হয়তো অনেককেই চমকে দিবে, তবে তার সম্বন্ধে আরেকদিন বলা যাবে।

চলবে…

ঢাকা
২৫ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:০৯
২৫টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×