somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার কথা - ১৬

০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"আমার কথা - ১৫" এখানে পড়া যাবেঃ আমার কথা - ১৫

ভাইস প্রিন্সিপাল জনাব এম এ ওয়াহাবঃ
আমাদের সময় এমসিসি’র ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন জনাব এম এ ওয়াহাব। তিনি ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স মাস্টার্স করেছিলেন। তবে অন্যান্য কারিশমাটিক স্যারদের তুলনায় তাকে বেশ ম্লান মনে হতো। তাকে যতদিন কলেজে পেয়েছিলাম, ততদিন তার কোন উজ্জ্বল বা উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ড আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। তিনি ভালো ইংরেজী জানতেন, তবে তা ছিল নিতান্তই বুকিশ। মাঝে মাঝে তিনি আমাদের দুই একটা ইংরেজী ক্লাস নিতেন, ওগুলো খুব বোরিং মনে হতো। আমার ব্যাচের হয়তো কারো কারো মনে থাকতে পারে, তিনি একদিন ক্লাসে এসে আমাদেরকে একটা সাইক্লোস্টাইল করা কাগজ ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে একটা বড় কবিতা লেখা ছিলো, যার নাম “There is a log in the middle of the sea”। তিনি সুর করে কবিতাটা পড়ছিলেন আর আমাদেরকে তাঁর সাথে কন্ঠ মিলাতে বলছিলেন। আমাদের তা করতে ভালো না লাগলেও আমরা গলা মিলাচ্ছিলাম। তিনি মৃদুভাষী ছিলেন, পোষাকে আশাকেও বিশেষ কেতাদুরস্ত ছিলেন না। তাঁকে দেখে আমাদের মনে হতো, তিনি প্রিন্সিপালকে খুব ভয় পেতেন। তাঁর আচরণ অনেকটা মোসাহেবী ধরণের ছিলো। এ্যসেম্বলীতে তিনি মাঝে মাঝে প্রিন্সিপালের অনুপস্থিতিতে বক্তৃতা দিতেন, তবে সেগুলো মোটেই চিত্তাকর্ষক হতোনা।

এ্যডজুট্যান্টঃ
এমসিসিতে আমরা প্রথম এ্যডজুট্যান্ট হিসেবে পাই ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনকে। তিনি খুব নম্র ভদ্র মেজাজের ছিলেন এবং দেখতে অনেকটা নাদুস নুদুস টাইপের ছিলেন। খুব সম্ভবতঃ তিনি এডুকেশন কোরের ছিলেন। তার ওয়ার্ডস অব কমান্ড চিকণকন্ঠে বের হতো, তাই ততটা ইম্প্রেসিভ ছিলোনা। তবে ঠান্ডা মেজাজের কারণে তিনি ক্যাডেটদের কাছে মোটামুটি জনপ্রিয় ছিলেন। তাকে আমরা বেশীদিন পাইনি। কিন্তু তিনি চলে যাবার পর আমরা যাকে পেয়েছিলাম, তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন গরম কাকে বলে। তার নাম ছিলো ক্যাপ্টেন এম আনোয়ার হোসেন। তিনি আর্টিলারী কোরের ছিলেন। তখন থেকে প্রায় ১৭ বছর পর সেনাসদরে আমার তাঁর সাথে স্টাফ অফিসার গ্রেড-২ (কো অর্ড) হিসেবে চাকুরী করার সৌভাগ্য হয়। কিন্তু ততদিনে তাঁর সম্বন্ধে আমার মনে সেই ছোটবেলায় যে ইমাজ গড়ে উঠেছিলো, তার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। তখন তিনি একজন মেজর জেনারেল। এর পর পরই তিনি মালয়েশিয়ায় আমাদের হাই কমিশনার হিসেবে বদলী হন। সেখান থেকে তিনি ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানীতেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হয়েছিলেন।

ক্যাপ্টেন আনোয়ার প্রথম রাতেই বিড়াল মেরেছিলেন। প্রথম আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের দিন যখন কলেজ ক্যাপ্টেন তার কাছে প্যারেড স্টেট হ্যান্ড ওভার করছিলেন, তখন এ্যটেনশন অবস্থায় কোন একজন ক্যাডেট একটু নড়াচড়া করে উঠলে তিনি জলদ গম্ভীর কন্ঠে হুংকার ছেড়েছিলেন, “ডোন্ট মুভ ইওর ব্লাডি বলস!” তাঁর গলা ছিলো খুব ভারী আর ভাষা খুব কমান্ডিং। তাঁর মুখে কথায় কথায় স্ল্যাং এর খই ফুটতো। আমরা যারা বাংলা মিডিয়াম থেকে এমসিসিতে গিয়েছিলাম, তারা প্রথম প্রথম ওসব অনেক কিছু বুঝতে না পারলেও অচিরেই তার কল্যাণে আমাদের স্ল্যাং এর ভান্ডারও খুব সমৃদ্ধ হয়ে উঠলো। সতীর্থদের সাথে আলাপে সালাপে আমরাও রাতারাতি বেশীরভাগ শব্দের সাথে ব্লাডি কথাটা যোগ করতে শুরু করলাম। ওনার কিছু কিছু স্ল্যাং বেশ ন্যাস্টি ছিল, তাই সেগুলো আর এখানে উল্লেখ করলাম না। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে নিয়েছিলাম, ওটাই ছিলো সামরিক কথোপকথনের স্বীকৃ্ত কালচার।

ক্যাপ্টেন আনোয়ার দেখতে শুনতে আর আচার আচরণে বেশ রাফ এ্যান্ড টাফ ছিলেন। তিনি আসার পর কলেজের ওস্তাদরাও বেশ নড়েচড়ে উঠেছিলেন, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাও মকরামি বাদ দিয়ে সোজা হতে শুরু করেছিলো। বাঙালী এ্যাডজুট্যান্ট হয়েও তাঁকে মাঝে মাঝে স্বয়ং পাকিস্তানী প্রিন্সিপালের সাথে পাঙ্গা নিতে দেখে আমরাও বেশ উৎফুল্ল হ’তাম। তাঁর সময়েই প্রথম গোটা কলেজের গ্রুপ ছবি তোলা হয়েছিলো। সোহরাওয়ার্দী হাউসের সামনের বিরাট গাছটার নীচে আমরা সমবেত হয়েছিলাম। তাঁর এরেঞ্জমেন্ট সম্পর্কে প্রিন্সিপাল আনসারী এসে কি যেন একটা নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন, যা আমার এখন ঠিক মনে নেই। তবে তিনি প্রায় তিনশ’ ক্যাডেট এবং সকল শিক্ষকদের সামনে এর একটা যুতসই জবাব দিয়ে প্রিন্সিপালকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন। এটা আমরা খুব উপভোগ করেছিলাম। ফটোগ্রাফার একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ট্রাইপডের উপর রাখা তার ক্যামেরার লেন্সটাকে একটা লাল কিংবা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। ক্লিক করার আগে তিনি একটা ফানি ভয়েসে হুঁশিয়ারী দিতেন, “গেট রেডী প্লীজ!” এর পর থেকে বহুদিন ধরে “গেট রেডী প্লীজ!” কথাটা আমাদের মুখে মুখে ঘুরতো।

গড নোজ এভ্রিথিং, ম্যান ইজ মর্টাল স্যারঃ
আমাদের একজন ব্যাচমেট ছিলো যে প্রথম থেকেই তার বাচালতা ও অবিবেচক এর মত কথাবার্তার জন্য একটা কালো চতুষ্পদ প্রাণীর নামে টাইটেল পেয়েছিলো। সে একবার পিটিতে অনুপস্থিত থাকার কারণে ধরা খেয়েছিলো। এ্যাডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন আনোয়ার তাকে টী ব্রেক এর সময় (আমাদের সময় মিল্ক ব্রেক বিকেলে হতো)তাঁর অফিসে দেখা করতে বললেন। নির্দিষ্ট সময়ে সে হাজির হলো। তার পরিণতির কথা ভেবে আমরা সবাই বেশ চিন্তিত হয়ে উঠছিলাম। কিছুক্ষণ পর সে ঘর্মাক্ত অবয়বে বের হয়ে এলে আমরা তার সাথে কি কি কথোপকথন হয়েছে তা জানতে চাইলাম। সে বললো যে সে তার নিজস্ব ইংরেজী স্টাইলে এ্যাডজুট্যান্টকে তার পরিস্থিতির কথা বোঝাতে চেয়েছিলো কিন্তু তবুও তিনি সেটা না বুঝে তাকে তিন দিনের এক্সট্রা ড্রিল দিয়েছিলেন। এই শাস্তি পাবার পর সে মনের দুঃখে এ্যাডজুট্যান্টকে বলে এসেছিলো, “গড নোজ এভ্রিথিং, ম্যান ইজ মর্টাল স্যার”! অর্থাৎ, তিনি না মানলেও আল্লাহ জানেন যে সত্যি সত্যি তার জ্বর এসেছিলো। আর সব মানুষকেই একদিন মরতে হবে, তখন সবাইকেই আল্লাহ’র সম্মুখীন হতে হবে। অবিশ্বাস্য হলেও আমরা তার এই সাহসী উচ্চারণকে বিশ্বাস করেছিলাম, কারণ পাগলে কিনা বলে! উল্লেখ্য যে আমাদের সেই বন্ধুটি ময়মনসিংহের সানকি পাড়া এলাকায় একজন উঠতি নায়ক হিসেবে তখন পরিচিতি পেতে শুরু করেছিলো।

এ্যাডজুট্যান্ট এর বিয়েঃ
আমাদের কলেজের এ্যাডজুট্যান্ট থাকা অবস্থাতেই ক্যাপ্টেন আনোয়ার ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী ডঃ সুলতানা একজন উচ্চশিক্ষিতা বিদুষী মহিলা ছিলেন। তিনি বহুদিন ঢাকার সেভ দ্য চিলড্রেন ফান্ড এ কর্মরত ছিলেন। এ্যাডজুট্যান্ট এর বিয়ে হলে ক্যাডেটদের কি? তাই এ নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা ছিলোনা। কিন্তু একদিন বিকেলে যখন দেখলাম যে কলেজ থেকে বাসভর্তি বরযাত্রী নিয়ে একটা দল ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো, তখন অন্ততঃ ঐ রাতের জন্য আমরা একটা অপ্রত্যাশিত কিন্তু ক্ষণস্থায়ী ফ্রীডম অনুভব করেছিলাম। ঢিলেঢালা ভাবে প্রেপ টাইম শেষ করে আমরা পিলো ফাইটসহ নানা কিসিমের দুষ্টুমিতে নিমগ্ন হয়েছিলাম।
হোয়েন দ্য ক্যাট ইজ এওয়ে, দ্য মাইস প্লে এরাউন্ড!

চলবে…

ঢাকা
২৬ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৫
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×