somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার কথা -২০

২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার কথা - ১৯ পড়তে এখানে ক্লিক করুনঃ আমার কথা - ১৯

প্রথম কোন শিক্ষকের বিদায়ঃ
যে শিক্ষক আমাদের প্রথম পাক্ষিক পরীক্ষাটি নিয়েছিলেন এবং যাঁর পরীক্ষায় আমি আমাদের সেকশনে প্রথম পরীক্ষাতেই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম, তিনিই দুর্ভাগ্যক্রমে সবার আগে আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন জনাব হাফিজ উদ্দিন খান। মূলতঃ পদার্থ বিদ্যার শিক্ষক হলেও তিনি সপ্তম শ্রেণীতে আমাদের অঙ্ক ও জ্যামিতির ক্লাসগুলো নিতেন। তিনি অত্যন্ত স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। ঐ অল্প ক’দিনেই আমরা তাঁর কাছ থেকে অনেক ভালো ভালো উপদেশ পেয়েছিলাম। ক্যাডেট কলেজের কঠোর নিয়ম শৃ্ঙ্খলা তাঁর মোটেই ভালো লাগতো না, এটা আমরা বুঝতাম। তিনি প্রিন্সিপালকেও খুব একটা তোয়াক্কা করতেন না। তাঁর বিদায় ভাষণে তিনি আমাদেরকে ভালোভাবে পড়াশুনা করে ‘মানুষ’ হবার উপদেশ দিয়েছিলেন। নিজেদেরকে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবার উপযোগী করে তৈ্রী করার কথা বলেছিলেন। এ ছাড়া তিনি মানবিক গুনাবলী অর্জনের উপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তাঁর শেষ কথাটা আজও আমার কানে বাজেঃ Do not sell yourself to anybody.

হাউস মাস্টার এবং হাউস টিউটরঃ
এমসিসিতে প্রবেশ করেই প্রথম যাকে আমাদের হাউস মাস্টার হিসেবে পেয়েছিলাম, তিনি ছিলেন জনাব সৈয়দ আব্বাস আমজাদ হোসেন, সংক্ষেপে SAAH, ভূগোলের শিক্ষক। তিনি উর্দুভাষী হলেও বাংলা বলতে পারতেন। তিনি খুব স্নেহপ্রবণ ছিলেন, খুব একটা হোমওয়ার্ক দিতেন না, আর পরীক্ষায় ভালো ম্যাপ আঁকতে পারলে দু’হাত খুলে নম্বর দিতেন। বিয়ের পর তিনি ক্লাসে একটু অমনযোগী হয়ে পড়েন। আমাদেরকে “সেলফ স্টাডী”দিয়ে তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে তার একটা নোটবুক খুলে কি যেন পড়তেন আর মিটিমিটি হাসতেন। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম তার নিজের লেখা কোন নোট পড়ে বোধহয় মুগ্ধ হয়ে তিনি হাসছেন। একদিন হঠাৎ তাঁর হাতে ধরা নোট বই এর ভেতর থেকে একটা নীল খামের চিঠি নীচে পড়ে যায়। খামের থেকে একটা হাস্যোজ্জ্বল মুখের ফটো বেড়িয়ে আসে, যেটা ছিলো তাঁর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর ছবি। সামনের ডেস্ক এর একজন দৌড়ে গিয়ে ছবিটি তাঁর হাতে তুলে দিলে তাঁর ফর্সা মুখটা একটু লাল হয়ে উঠেছিলো। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি কেন মিটিমিটি হাসতেন।

প্রথম হাউস টিউটর হিসেবে আমরা পেয়েছিলাম জনাব মোহাম্মদ শামসুদ্দোহাকে। লম্বা, ফর্সা, সৌ্ম্যকান্তি এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমি যখন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাউসে একা পড়ে ছিলাম (আমার কথা – ১৩ ও ১৪ দ্রষ্টব্য), দোহা স্যার তখন আমার পাশে এসে সান্তনা দিতেন, সাহস যোগাতেন। তিনি আমাদের ইতিহাস পড়াতেন, মাঝে মাঝে ইংরেজী শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে ইংরেজীও পড়াতেন। আমার মনে পড়ে, ইতিহাসের খাতায় তাঁর খুব পছন্দের ছিলো Stanly Lane Pool এর কোটেশন। ওনার প্রচুর কোটেশন ঐ ছোট ক্লাসেও (৭ম-৮ম) মুখস্থ করে আমি দোহা স্যারের কাছ থেকে ইতিহাসে খুব ভালো নম্বর পেতাম। বহুদিন পরে সেদিন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দোহা স্যারের সাথে আমার সাক্ষাত হয়। তিনি আমার এসব স্মৃতির কথা স্পষ্ট মনে রেখেছেন এবং আমার স্ত্রীকেও এর কিছু কিছু বলেছেন। তিনি আমার মা এবং মরহুম পিতা সম্পর্কেও অনেক কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আজ তিনি কিডনী রোগে আক্রান্ত। আমরা অর্থাৎ এক্স এমসিসি ক্যাডেটরা যে তাঁর চিকিৎসার ব্যয়ভার মেটানোর জন্য আর্থিক সহায়তার হাত প্রসারিত করেছি, তিনি সে কথাও কৃ্তজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেছিলেন। পরম দয়ালু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন দোহা স্যারকে সম্পূর্ণ আরোগ্য দান করেন এবং বাকী জীবনটা তাঁকে নির্ঝঞ্ঝাট পার করে দেন!

‘মোস্ট ইম্প্রেসড’
প্রথম যে শিক্ষককে দেখে ‘মোস্ট ইম্প্রেসড’ হয়েছিলাম, তিনি জনাব নাজমুল আহসান। তিনি রসায়নের শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু ক্লাস ছাড়াও তাঁকে কলেজের সকল চৌহদ্দিতেই তৎপর দেখা যেতো। এডজুট্যান্ট এর অনুপস্থিতিতে তিনি মাঝে মাঝে কলেজ এডজুট্যান্ট এরও দায়িত্ব পালন করতেন। আমরা প্রথম কলেজে যাওয়ার কয়েক মাস পরেই তিনি আমাদের হাউস মাস্টার হিসেবেও দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ক্যাডেট হিসেবে যে আমি খুবই ম্রিয়মাণ প্রকৃতির ছিলাম, এটা তাঁর চোখে ধরা পড়তে বেশীদিন লাগেনি। হাউস মাস্টার হিসেবে তাঁর প্রথম রিপোর্টেই তিনি আমার সম্পর্কে একটা বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন, He is rather meek and mild, He should be more sociable and friendly। নিজের সম্পর্কে তখনকার ঐ মন্তব্যটা যে কতটা সত্য ছিলো, তা আমি ছাড়া আর কে বেশী জানতো? তাই উপদেশ পাওয়ার পরেও প্রকৃ্তিগত স্বভাবে পরিবর্তন আনতে পারিনি বলে পরবর্তীতে তাঁকে দেখলেই আমি খুব আড়ষ্ট থাকতাম।

তিনি খুবই পরিপাটি পোশাকে চলাফেরা করতেন। রঙ ঠিক ফর্সা না হলেও স্লিম ফিগার, ব্যাকব্রাশ করা ছোট চুল আর স্মার্ট মুভমেন্ট এর কারণে সকলের পছন্দের ছিলেন। রসায়নের শিক্ষক হিসেবে আমাদের তিনি খুব কমই পড়িয়েছেন, তাই ঐ বিষয়ে তাঁর দখল কেমন ছিলো সে বিষয়ে আঁচ করতে পারিনি। তবে স্বাধীনতার পরে তিনি কয়েক বছর নাইজেরিয়ায় এবং দীর্ঘদিন ব্রুনাই দারুস সালামে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি এখন আমার ফেইসবুক ফ্রেন্ড। সেই সুবাদেই দেখতে পাই সারা বিশ্ব জুড়ে তাঁর কত গুণগ্রাহী ছাত্র ছাত্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, এবং তারা তাঁকে শিক্ষক হিসেবে কতটা শ্রদ্ধা করে। এমনকি এখনও তিনি ঢাকার একটি বিখ্যাত ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলে রসায়নের ক্লাস (ল্যাব) নিয়ে থাকেন। এ থেকেই বুঝা যায় তিনি তাঁর সাবজেক্টে কতটা পারদর্শী। আমরা কলেজে গিয়েই শুনেছিলাম যে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেও কমিশন্ড অফিসার হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিন্তু ব্যক্তিগত কোন কারণের জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত পিএমএ'তে যোগদান করেননি। তাঁর আরেকটা বড় পরিচয়, তিনি সেই আমলে ঢাকা প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে ঈগলেটস ক্রিকেট ক্লাব এর পক্ষে খেলতেন। রকিবুলদের সাথে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান একাদশেও চান্স পেতেন। তাঁর অকালপ্রয়াত ছোটভাই এক্স ক্যাডেট মঞ্জুরও নিয়মিতভাবে ঢাকা প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে খেলতেন এবং মৃত্যুর সময় তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সিইও ছিলেন। সেদিন মেকা (MECA – Mirzapur Ex Cadets’ Association) ইফতার পার্টিতে নাজমুল আহসান স্যারের সাথে অনেকক্ষণ আলাপ হলো। এখনো তিনি যদি তাঁর সাদা চুলগুলো কালো করে আমার পাশে দাঁড়ান, তাঁকে আমার ছোটভাই বলেই অনেকের ভ্রম হবে।


ঢাকা
২৮ অগাস্ট ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ৯:১১
১৮টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×