somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার কথা -২৭

২২ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"আমার কথা -২৬" পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুনঃ আমার কথা - ২৬

আমার শিক্ষকেরাঃ
জনাব মোঃ আব্দুল গফুর
গফুর স্যার আমাদের ফিজিক্স পড়াতেন। তিনি অতি সহজ সরল জীবন যাপন করতেন, কথাবার্তায় স্পষ্টভাষী ছিলেন, নিয়মনীতি পালনে ও রক্ষায় কঠোর ছিলেন। হোমওয়ার্ক নিয়মিতভাবে দিতেন এবং নিয়মিত ভাবে তা পরীক্ষাও করতেন। ল্যাবেও বেশ সিরিয়াস ছিলেন, কোন ফাঁকিজুকি পহন্দ করতেন না। তিনি ক্লাসে কদাচিৎ হাসতেন, আর একটু নাকি সুরে কথা বলতেন। বাহ্যিকভাবে তিনি খুব কঠোর থাকলেও অন্তরে তিনি ক্যাডেটদের প্রতি স্নেহপ্রবণ ছিলেন। এইচএসসি পরীক্ষার ঠিক আগে আগে একদিন আমার এক বন্ধু দুষ্টুমি করতে করতে হঠাৎ আমার ফিজিক্স প্র্যাক্টিকাল খাতার একটা পাতা একেবারে মাঝখান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। নিতান্ত অনিচ্ছাকৃ্তভাবে এটা ঘটে যায়। আমার মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ে। অনেক কষ্ট করে কোনরকমে পাতাটা জোড়া লাগিয়ে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে স্যারের কাছে গেলাম। ভেবেছিলাম, স্যার হয়তো বলবেন পুরো খাতাটা পুনরায় লিখে আনতে। সেটা বললে নির্ঘাত আমার অন্যান্য বিষয়ের পরীক্ষা খারাপ হতো, কেননা খাতাটা পুনর্গঠন করতে যে সময় লাগতো, তাতে অন্যান্য বিষয় পড়াশোনার সময়ের ঘাটতি হতো। তিনি গম্ভীরভাবে খাতাটা রেখে দিয়ে বললেন, "ফাঁডা কপাল জোড়া লাগলেও, একটা দাগ থাইক্যা যায়"। কথাটা বাস্তবিকই সত্য ছিলো। ফিজিক্স প্র্যাক্টিকালে আমি অন্যান্যদের চেয়ে ৪/৫ নম্বর কম পেয়েছিলাম। তবে সেটা অন্য অপশনটার চেয়ে ভালো ছিলো। তাৎক্ষণিক বিপদ থেকে উদ্ধার পেলেও ঐ ৪/৫ টি নম্বর রেজাল্ট হাতে পাবার পর আমার যথেষ্ট আফসোসের কারণ হয়েছিলো।

জনাব আলী আহমদ
আলী আহমদ স্যার আমাদের এ্যালজেব্রা পড়াতেন, মাঝে মাঝে পাটিগণিত আর জ্যামিতি/ত্রিকোণমিতিও পড়াতেন। কক্সবাজার নিবাসী এই স্যারের ফর্সা মুখে সবসময় একটা মনোমুগ্ধকর হাসি লেগেই থাকতো। তিনি সবসময় আমাদের অনুপ্রেরণা দিতেন। পারতপক্ষে কখনো বকাঝকা দিতেন না, আর এক্সট্রা ড্রিল দেয়ার তো প্রশ্নই উঠেনা। হোমওয়ার্ক ভালো করে করলে তিনি খুব inspiring comments লিখতেন। ক্লাসওয়ার্কে ভালো করলে প্রায়ই এক্সিলেন্ট, সুপার এক্সিলেন্ট ইত্যাদি কমেন্ট দিয়ে আমাদেরকে উৎসাহিত করতেন। হাসিমুখ ছাড়া তাঁকে কেউ কখনো দেখেছে কিনা বলতে পারবোনা। তিনি আমাদেরকে পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও প্রচুর উৎসাহ দিতেন। তাঁর বর্তমান বয়স প্রায় ৮০ এর মত, এখনো স্যার কর্মঠ ও সক্রিয় জীবন যাপন করে যাচ্ছেন। তিনি এখন আমেরিকা প্রবাসী।

জনাব মোঃ আব্দুল আজিজ
আজিজ স্যারও আমাদের অঙ্ক পড়াতেন। মাঝে মাঝে তিনি বেশ রসিকতা করতেন। শিক্ষকদের মধ্যে তিনি প্রবীণতম ছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পরে যখন কলেজ অনেকদিন বন্ধ থাকার পর নতুন করে খুললো, তিনি তখন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। এ সময়টা তাঁর জীবনের একটা কঠিন সময় ছিলো। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের সময়, চারিদিকে ছিলো বিশৃঙ্খ্লা। যুদ্ধের সময় আমাদের কলেজের কিছু আসবাবপত্র লুটপাট হয়েছিলো। সাপোর্ট স্টাফ যারা চলে গিয়েছিলো, তাদের মধ্যে অনেকে তখনো ফিরে আসে নাই। যারা এসেছিলো, তাদের মধ্যেও শৃঙ্খ্লার অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিলো। কেউ কারো কথা শুনে না। এমতাবস্থায় কলেজ খোলা হলে চারিদিকে অসন্তোষ বিরাজ করছিলো। ক্যাডেটদের মধ্যেও উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দিয়েছিলো। এসব সামাল দিতে গিয়ে স্যার হিমসিম খেয়ে যান। তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠতে লাগলো। আমরা আগেই দেখেছিলাম, স্যারের মাঝে মাঝে, বিশেষ করে শীতের সময়ে মানসিক চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিত। তার উপর এমন মানসিক চাপে স্যারের আবার মানসিক চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলো। কলেজের এই বিশৃঙ্খল অবস্থার কথা উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কানে গেলো। তড়িঘড়ি করে আরেকজন সিভিলিয়ান অধ্যক্ষকে রাঙামাটি কলেজ থেকে বদলী করে আমাদের কলেজে আনা হলো। তিনিই ছিলেন কলেজের ইতিহাসে ক্যাডেট কলেজের বাইরের কোন অধ্যক্ষ।

জনাব এম এ আজিজ
রাঙামাটি কলেজ থেকে বদলী হয়ে আসা আমাদের এই নতুন অধ্যক্ষের নামও ছিল এম এ আজিজ। তিনি ইংরেজীর শিক্ষক ছিলেন। তখন শিক্ষকের অভাবে তিনি অধ্যক্ষ হয়েও আমাদের ইংরেজীর ক্লাস নিতেন। একদিন ক্লাসে এসে তিনি একটা সাধারণ এ্যসেসমেন্ট এর জন্য আমাদেরকে কিছু কাজ দিলেন। আমি সেটাতে ভালো করার জন্য তাঁর প্রশংসা পেলাম। একজন নবাগত অধ্যক্ষের কাছ থেকে প্রশংসা পেয়ে সেদিন বেশ উৎফুল্ল হয়েছিলাম। তাঁকে বেশ পছন্দ করা শুরু করলাম, কিন্তু কলেজের টালমাটাল বিশৃঙ্খ্ল পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে তাঁর অসহায়ত্ব দেখে দুঃখবোধ করতাম। তিনিও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিলেন না। ঐ সময়ে বেসামরিক প্রশাসন থেকে বেশ একটা জোর চাপ আসছিলো ক্যাডেট কলেজগুলোকে উঠিয়ে দেবার জন্য। আবার সদ্য স্বাধীন একটা দেশের সামরিক একাডেমী গঠনের জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছিলো। এ ব্যাপারে একদিন একটা তথ্যসন্ধানী দল কলেজে সরেজমিন এসে নানারকম তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছিলো। আমরা শুনছিলাম যে আমাদের কলেজটাকে সামরিক একাডেমী বানানো হবে। সদ্য স্বাধীন দেশের প্রশাসনে তখন পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের পক্ষ বিপক্ষে সহানুভূতিশীল/বিরূপ মনোভাবের লোকজনদের সমাবেশ ঘটেছিলো। একদিন আমাদের কলেজের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত স্থানীয় এক মান্যবর প্রধান অতিথি আমাদেরকে অনানুষ্ঠানিকভাবে বলেছিলেন (অর্থাৎ তার ফরমাল ভাষণের বাইরে), “আপনারা বিকেল বেলা খেলাধুলা করবেন, আর আপনাদের বাপচাচার বয়সী কর্মচারীরা আপনাদের খেলার জন্য বল এগিয়ে দেবে, এটা ঠিক নয়, এটা হবেনা”। এরকম এক সময়ে একদিন জেনারেল ওসমানী অসুস্থ হয়ে ঢাকা সিএমএইচে ভর্তি হলেন। হাসপাতালে ভর্তি থাকায় চিকিৎসা নেয়ার পাশাপাশি তিনি সময় পেলেন সেনা কর্মকর্তাদের সাথে আলাপের। পরে হাসপাতাল শয্যা থেকেই তিনি ক্যাডেট কলেজগুলোকে রাখার স্বপক্ষে একটা নিবন্ধ লিখে পাঠান, যা পরদিন দেশের উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটি বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তিনি ক্যাডেট কলেজগুলোকে রাখার স্বপক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন। এর কিছুকাল পরে আমরা আবার আমাদের নিজস্ব সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদেরকে অধ্যক্ষ হিসেবে পেতে শুরু করি।

চলবে…

ঢাকা
১৭ নভেবর ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১৮ বিকাল ৫:০৮
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×