somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বইমেলার টুকিটাকি-৩

০১ লা মার্চ, ২০১৭ বিকাল ৩:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বই মেলার টুকিটাকি-৩

গতকাল ছিল “অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৭” এর শেষ দিন। বেলা একটার দিকে বন্ধু লুৎফুল কবীর মুঠোফোনে জিজ্ঞেস করলো, আমি তো তোমার স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে, কিন্তু তুমি কোথায়? আমি ততক্ষণে কাছাকাছি চলে এসেছি, শাহবাগ মোড়ে। বললাম, আর দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব। কবীর এর আগে একদিন এসে আমার বই “প্রেমের একটি ফুল ফুটুক, শুষ্ক হৃদয়েই” এর একটি কপি কিনে নিয়ে গিয়েছিল। সে আমার অন লাইন লেখালেখির একজন আগ্রহী পাঠক। যা কিছুই লিখি, তা পাঠ করে দুটো কথা বলতে সে কখনো ভুল করেনা। গতকাল এসেছিলো মূলতঃ আড্ডা দিতে। দেখা হলো, একসাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ আলাপ হলো। তারপর সে বাঙলা একাডেমী প্রাঙ্গণে চলে গেল, লিটল ম্যাগ চত্বরে। এর পর এলো আমার প্রায় সব লেখায় উৎসাহ দিয়ে যাওয়া বন্ধু দম্পতি জাহাঙ্গীর এবং ফেরদৌসী। ওরা গত বছরেও বই মেলায় এসে আমার বই কিনে নিয়ে যায়। ওরা এক ভীষণ রোমান্টিক জুটি। প্রথমে যখন আমার স্টলে এসেছিল আমি তখন একটু দূরে অন্য এক স্টলে ছিলাম। ওদের ফোন পেয়ে বললাম, আমি আসছি। কিন্তু ওরা বললো, না, তুমি বরং একটু পরেই আসো, আমরা একটু ঘোরাঘুরি করে আবার আসবো। ঠিকই তারা কিছুক্ষণ পরে আবার আসলো, হাতে ধরা কিছু সদ্য কেনা পছন্দের বই। ওরা আগ্রহভরে আমারটাও একটা নিল। অটোগ্রাফ দিলাম, ছবিও তুললাম। রাতে বাসায় ফিরে দেখি সে ছবি ইতোমধ্যে ফেইসবুকে আত্মপ্রকাশ করেছে। খুশী হলাম।

এর পরে এলো আমার কিশোর বেলার বন্ধু ড. শরীফ হাছান। আমি বেশ গর্ব ভরে বলতে পারি, পৃথিবীতে যত ভাল মানুষ আছে, তাদেরকে কয়েকটি কাতারে দাঁড় করালে শরীফ থাকবে একেবারে প্রথম কাতারে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা শরীফ তার সারল্যের জন্য ডাক্তারী পেশার বন্ধুমহলে “শিশু” নামে পরিচিত। এমনকি ছোট বড় অনেকেই ওকে ড. শিশু নামেই চেনে। ওরা ভাবে, শিশু হয়তো তার মা বাবার দেয়া ডাক নাম। আমি নিশ্চিত, শুরুতে বলা আমার স্টেটমেন্ট টা যারা একবার ওর সংস্পর্শে এসেছে, তারা সবাই একবাক্যে তা স্বীকার করবে। ও আমার লেখালেখি সবই পড়ে, কিন্তু অন লাইন কিছু বলে না। সামনা সামনি হলে অনেক কথাই বলে। আমি ওর প্রতিটি কথারই খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকি। পেশায় ডাক্তার (প্লাস্টিক সার্জন) হলেও সে সাহিত্য শিল্পের একজন অনুরাগী পাঠক ও সমঝদার। ও আসার পর ওর সাথে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম, সাথে লাগামহীন গল্প। এক সময় আসরের নামাযের ওয়াক্ত হয়ে এলে ওকে নিয়ে মেলার অস্থায়ী মাসজিদে গেলাম নামায পড়তে।

“বই মেলার টুকিটাকি-১” এ এর আগেও আমি বলেছিলাম, বইমেলার সবচেয়ে neglected corner ছিল মুসল্লীদের নামায পড়ার স্থান। সবচেয়ে বেশী অব্যবস্থাপনা সেখানে ছিল। সেখানে ঢোকার আগেই বন্ধুকে বলছিলাম, জানো, চুরির জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হচ্ছে মুসলমানদের প্রার্থনার জায়গা মাসজিদ। আর কোন ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনার জায়গা থেকে জুতো, স্যান্ডেল, ফোন ইত্যাদি চুরি যায় বলে আমি শুনিনি। কিন্তু এখান থেকে প্রতি ওয়াক্ত নামাযে মুসল্লীদের কয়েক জোড়া জুতো চুরি যায়। অথচ একেবারে পাশেই ৫/৬ টা পুলিশ বসে বসে ঝিমোতে থাকে। আমি নামাযে দাঁড়ানোর আগে একবার ভাবলাম, হাতের ব্যাগটা থেকে সদ্য কেনা দুটো বই বের করে রেখে সেখানে আমার জুতো জোড়া ঢুকিয়ে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে নামায পড়বো, তার পাশেই ব্যাগটা রাখি। কিন্তু বই এর ব্যাগে জুতো রাখতে ইচ্ছে হলোনা। একটা কোণায় আমার বই এর ব্যাগ আর জুতো দুটো রেখে পরখ করে দেখলাম, কাপড় ঘেরা স্থানটিতে কাপড়ের নীচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে কোন চোর ওগুলো নিয়ে যেতে পারবে কিনা। দেখলাম, সেটা সম্ভব নয়, তাই নিশ্চিন্তেই জামাতে দাঁড়িয়ে গেলাম। নামায পড়ে উঠে দেখি, আমার বই এর ব্যাগটা আছে ঠিকই, কিন্তু জুতো জোড়া নেই। বুঝলাম, আমাদের মতই নামাজীর ভেকধারী কেউ নামায পড়তে এসে নামায শেষ হবার আগেই জুতো জোড়া পায়ে দিয়ে চম্পট দিয়েছে। আরো বুঝলাম, চোরেরা বই পড়ে না, কিন্তু জুতো পরে। :)

জুতো খুইয়ে বেশ বিব্রত বোধ করছিলাম। মাসজিদ থেকে খালি পায়েই বের হয়ে হাঁটা শুরু করলাম। আমার এ অবস্থা দেখে ড. শরীফ আমার সাথে একাত্মতা প্রকাশের জন্য তার জুতো জোড়া খুলে হাতে নিলো। এ কাজ করা থেকে কিছুতেই তাকে নিবৃত্ত করতে পারলাম না। আমার তো পা খালি, হাতও খালি। ওর পা খালি কিন্তু হাতে জুতো ঝুলছে! আমার চেয়ে ওর অবস্থাটা আরো বেশী বিব্রতকর। কিন্তু ও কিছুতেই কিছু শুনবেনা। ও বারবার হাসছিলো আর বলছিলো, খায়রুল, তুমি মাসজিদে ঢোকার আগেই যে কথাটা বলেছিলে, চোর ব্যাটা বোধ হয় সেটা শুনেছিলো। তাই সে তোমাকে দিয়েই তোমার কথার সত্যতা প্রমাণ করে ছাড়লো। হাঁটতে হাঁটতে পথে দেখা হলো কর্নেল বোরহান এর সাথে। উনি কয়েকদিন আগে আমার বইটা কিনেছিলেন যখন আমি স্টলে ছিলাম না। ওনার সাথে আগেই কথা হয়েছিলো, উনি আজ মেলায় আসবেন বইটা নিয়ে, অটোগ্রাফ নিবেন এবং সেই সাথে আমার কেনা ওনার একটা বই এ অটোগ্রাফ দিবেন। আমাকে খালি পায়ে দেখে উনি দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং জানালেন যে গত বছর ওনারও ঠিক একই অবস্থা হয়েছিল। ওনার ড্রাইভার গাড়ীতে রাখা এক জোড়া স্পেয়ার স্যান্ডেল এনে দিয়েছিলো বটে, কিন্তু রাগে ও প্রতিবাদে উনি সেটা না পড়ে সারাটা মেলা খালি পায়েই ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। অবশ্য এটাও জানালেন যে রাতে পায়ের তলায় ভীষণ ব্যথা হয়েছিলো ( :) )! আমিও বেশ টের পাচ্ছিলাম যে ইট বিছানো পথে এভাবে বেশীক্ষণ হাঁটা যাবেনা। আমার স্টলের সামনে “ভোরের শিশির” এর স্টলের চপলকে জিজ্ঞেস করলাম নিকটতম জুতোর দোকান কোথায় হবে। তাকে জিজ্ঞেস করার কারণ, মেলা নিয়ে এবং আমার বই এর প্রচ্ছদ আঁকা নিয়ে এই এক মাসে ওর সাথে আমার এক বিশেষ সখ্যতা গড়ে ঊঠেছে। চমৎকার একজন মানুষ, ওর সময় জ্ঞান এবং সততার প্রমাণ পেয়ে আমি রীতিমত মুগ্ধ হয়েছি। ও বললো নীলক্ষেত যেতে। রওনা হলাম খালি পায়েই। ও পেছন থেকে ভাইয়া বলে ডাক দিলো। বললো, আমার কাছে সব সময় নামাযের জন্য এক জোড়া স্যান্ডেল স্পেয়ার থাকে। এই বলে এক জোরা স্যান্ডেল এগিয়ে দিয়ে বললো, আপনি জুতো কিনে নিয়ে এসে ফেরত দিয়ে গেলেই হবে। কোন সমস্যা নেই। আমি স্যান্ডেল জোড়া পড়লাম, শরীফও এবারে তার জুতো জোড়া পায়ে দিল।

একটা রিক্সায় চেপে আমরা চালককে নীলক্ষেত যেতে বললাম। রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, নীলক্ষেতের কোথায়? আমরা বললাম, যেকোন একটা জুতোর দোকানে। দেমাগী রিক্সাওয়ালা ফট করে রিক্সার হ্যান্ডেল ঘুড়িয়ে শাহবাগের মোড়ের দিকে যেতে শুরু করলো। আমরাও ওকে আর বেশী না ঘাটিয়ে নিজেদের গল্পে মশগুল হ’লাম। বাটা মোড় থেকে এক জোড়া জুতো কিনলাম। ফিরে আসবো, এমন সময় মাগরিবের নামাযের আযান দিল। আমরা নিকটস্থ একটা মাসজিদে নামায আদায়ের জন্য প্রবেশ করলাম। এখান থেকেও সদ্য কেনা জুতো জোড়া চুরি হয়ে যেতে পারে, এমন একটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই নামাযে মনোনিবেশ করলাম। নামায শেষে আর বই মেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। আমরা দু’বন্ধু একটা ছোট্ট ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢুকে গরম গরম জিলাপী, সিঙ্গারা, পনির সমোচা আর কফির অর্ডার দিলাম। সেখানে চেয়ার ছিল মোট তিনটে, তার মধ্যে দুটো অকুপায়েড। খালি চেয়ারটাতে বসার জন্য শরীফকে অনুরোধ করলাম। কিন্তু সে আমাকে দাঁড়িয়ে রেখে নিজে ওখানে বসবেনা। অগত্যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আমরা গল্প আর খাওয়া, দুটোই চালিয়ে গেলাম। খাওয়া শেষে যে যার পথ ধরলাম। শরীফ বললো সে ধানমন্ডির ল্যাব এইডে যাবে একজন পরিচিত ব্যক্তির অসুস্থ বাবাকে দেখতে, আর আমি একটা রিক্সা নিয়ে বইমেলায় ফিরে এলাম। এসে দেখি তিনজন তরুণী কয়েকটা বই হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তা তাদের আলাপচারিতায় বুঝলাম। ওদের একজনের হাতে আমার বইটাও ছিল। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে দাড়িয়েই দু চারটে কবিতার উপর চোখ বুলিয়ে নিলেন। আমার সাথে চোখাচোখি হওয়াতে তাকে জানালাম, আমিই এ বই এর লেখক। উনি সাথে সাথে সেলসম্যানকে মেমো কাটতে বললেন এবং তার কলমটা এগিয়ে ধরে আমার একটা অটোগ্রাফের জন্য অনুরোধ করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে পড়া মালিহা তাসনীমকে ধন্যবাদ জানিয়ে অটোগ্রাফ দিয়ে আমি বললাম, উনিই এবারের বইমেলায় আমার বই এর সর্বশেষ ক্রেতা।

ঢাকা
২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৭



আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু ড. শরীফ হাছান, আমার বই হাতে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৩৫
৪৩টি মন্তব্য ৪৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×