somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অল্প কথার গল্পঃ সবুজের শার্ট

১৩ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১০:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সবুজের পরিবারটা ঠিক স্বচ্ছলও ছিল না, আবার অভাবীও ছিল না। কঠোর নিয়ম কানুন আর পই পই হিসেব নিকেশের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত সংসারে সে বড় হয়েছে। মা বাবা কিংবা বড় ভাইবোন কোন কিছু কেনাকাটা করার জন্য যদি তাকে কোন অর্থ দিতেনও, খরচ শেষে তারা তার পুংখানুপুংখ হিসেব নিতেন। ঈদে পর্বে নতুন জামা কাপড় সে পেত ঠিকই, কিন্তু সব সময় তা নিজের পছন্দ অনুযায়ী হতোনা। এ নিয়ে অবশ্য সবুজের তেমন কোন দুঃখবোধ ছিলনা, কারণ সে দেখতো তাদের সৎ ও দায়িত্ববান বাবা বাসার সবার আব্দার মেটাতে গিয়ে কতটা হিমসিম খেতেন। মাঝে মাঝে মা লোভ দেখাতেন, পরীক্ষায় ভাল ফল অর্জন করতে পারলে এটা দিবেন, ওটা দিবেন, কিন্তু ভাল ফলের রিপোর্ট কার্ড ঘরে এনেও সবুজ বেশীরভাগ সময়েই তার প্রতিশ্রুত পুরস্কার পেত না। এ নিয়ে প্রথম প্রথম মনে মনে কিছুটা উষ্মা বোধ করলেও, কয়েকদিনের মধ্যেই সবুজ তা ভুলে যেত। কারণ একটাই, হিসাব বিজ্ঞান না পাঠ করেও সবুজ বুঝতো, মাস শেষে সংসারের ব্যালেন্স শীট মেলানোটা তার মা বাবার জন্য একটা দুঃসাধ্য কাজ ছিল।

তখন এলো টেরিলিন, কেরিলিন এর যুগ। কেরিলিন শার্ট আর টেট্রনের প্যান্ট পরে অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেরা স্কুলে আসা শুরু করলো। সুতির পোশাকের মত ওসব পোষাকের ইস্ত্রীর ভাঁজ সহজে ভাঙেনা। কাপড় ধোয়ার পরেও ইস্ত্রী না করালে চলে। দেখতেও খুব স্মার্ট দেখায়। কিন্তু ওসব কাপড়ের মূল্য সুতির কাপড়ের চেয়ে অনেক বেশী। সবুজেরও খুব ইচ্ছে হলো, এক জোড়া কেরিলিন শার্ট আর টেট্রনের প্যান্ট দিয়ে সে নতুন পোষাক পরে স্কুলে যাবে। কিন্তু ইচ্ছেটা সে মনের মধ্যেই পুষে রাখলো, কারণ সে জানে, মা বাবার কাছে এমন ইচ্ছে প্রকাশ করা মানেই তাদেরকে বিব্রত করা। একদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সবুজের বাবা তার অভ্যেসবশতঃ এটা ওটার ইংরেজী ট্রান্সলেশন ধরতে থাকলেন। সবুজও সপ্রতিভ হয়ে সাধ্যমত তার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলো। বেশ খানিকক্ষণ পর সবুজ বুঝতে পারলো, সে তার বাবাকে খুশী করতে পেরেছে। বাবা খুশী হয়ে বললেন, তুমি যদি এভাবে পরীক্ষার খাতায়ও অনুবাদ করতে পারো, তবে তুমি অনেক উচ্চ নম্বর পাবে। বাবাকে খুশী করতে পেরে সবুজ খুব তৃপ্ত বোধ করলো। একবার সে মনে মনে ভাবলো, এই সুযোগে সে বাবাকে কেরিলিন শার্ট আর টেট্রনের প্যান্ট এর আব্দারটা করে বসবে কিনা। কিন্তু সেটা তাকে আর করতে হলোনা। বাবা নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাকে বললেন, সে যদি বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হতে পারে, তবে তিনি তাকে তার পছন্দ অনুযায়ী কিছু কিনে দিবেন। একথা শুনে সবুজ একটু দমে গেল। কারণ সে জানে যে খুব চেষ্টা করলে সে বড়জোর তৃতীয় হতে পারবে। কারণ, ক্লাসের ফার্স্ট আর সেকেন্ড বয় মেধায় তার চেয়ে অনেক বেশী ভাল। তাই আশা নিরাশার এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে সবুজ সেদিন ঘুমাতে গেল।

এর মধ্যে একদিন অপ্রত্যাশিতভাবেই সবুজের সামনে এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেল। তাদের ক্লাসে কিছু নতুন ছাত্র ভর্তি করাতে তাদের সেকশনগুলো পুনর্গঠন করা হলো। এতে তাদের ফার্স্ট বয় দুই সেকশনের অন্য সেকশনে চলে গেল। এখন সে শুধু সেকেন্ড বয়কে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করলো। মনে মনে সে একটা শক্ত চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসলো। যে করেই হোক, সর্বশক্তি নিয়োগ করে প্রথম তাকে হতেই হবে। আর সে তখন অষ্টম শ্রেণীতে। এ পরীক্ষায় ভাল করতে পারলে সে বিজ্ঞান বিভাগ পাবে এবং পরবর্তীতে ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার যাই হতে চায়, তা হবার সুযোগ পাবে। তাই সে আদা জল খেয়ে লাগলো। অচিরেই সে তার নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর অধ্যবসায়ের ফল পেয়ে গেল। বার্ষিক পরীক্ষার পর দেখা গেল, সবাইকে অবাক করে দিয়ে সবুজ সেবার তার সেকশনে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। খুশীতে ডগমগ হয়ে সে রিপোর্ট কার্ড নিয়ে ঘরে এলো। বাসায় এসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলো, কখন তার বাবা ঘরে ফিরবে। সন্ধ্যা ঘনায়ে এলো, তবু বাবা ফিরেননা। তখন ওদের বাসায় কোন টেলিফোনও ছিলনা। ঘরে ফেরার স্বাভাবিক সময় যখন অতিক্রান্ত হচ্ছে, তখন বাসার সবাই উদ্বিগ্ন হতে শুরু করলো। বাবাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে সবুজ তার সুখবরটা তখনো আর কারো কাছে ভাঙেনি।

সন্ধ্যার পর কেউ একজন তাদের ঘরের কড়া নাড়লো। সবুজ ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেখে তার বাবার অফিসের পিয়ন দাঁড়িয়ে। সে মাথা নিচু করে হাত কচলাতে কচলাতে জানালো, স্যার অফিস ছুটির সময় হঠাৎ করে মাথা ঘুরে চেয়ার থেকে পড়ে যান এবং সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অফিসের সবাই তাকে ধরাধরি করে শুইয়ে দিয়ে মাথায় পানি ঢালেন এবং বাতাস করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তার জ্ঞান ফিরলেও, তিনি চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েন। অফিসের বড় বসের নির্দেশে তাকে এ্যাম্বুল্যান্স ডেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি এখন সেখানেই জরুরী বিভাগে চিকিৎসাধীন আছেন। একথা শুনে সবুজের মা আর দুই বোন হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। বড় ভাইয়েরা সুস্থির থাকলেও করণীয় সম্পর্কে উপস্থিত সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। এমতাবস্থায় সবুজ বেশী কিছু চিন্তা না করে ঘরের বাইরে বের হলো। রাস্তা থেকে একটা বেবী ট্যাক্সী ডেকে নিয়ে এসে সে সবার উদ্দেশ্যে বললো, আমি এখন মেডিক্যালে যাচ্ছি। তোমরা কেউ যাবা আমার সঙ্গে? এ কথা শুনে তার মা আর এক বোন, এক ভাই এক কাপড়েই তার সাথে গিয়ে বেবীট্যাক্সীতে উঠলো।

কেরিলিন শার্ট আর টেট্রন প্যান্টের আব্দারটা সবুজের আর কারো কাছে কখনো করা হয় নাই। আজও মাঝে মাঝে তার সেই না পাওয়া কেরিলিন শার্ট আর টেট্রন প্যান্টের কথা মনে পড়ে, যদিও এখন তার আর সেগুলোর প্রয়োজন নেই। সেদিনও যেমন তার এ নিয়ে কোন দুঃখবোধ হয়নি, আজও হয়না, শুধু মাঝে মাঝে মনে পড়ে সেকথাটা। তখন তার দৃষ্টি নিম্নমুখী হয়, স্মৃতি অতীতমুখি আর হৃদয় ঊর্ধ্বমুখী।


ঢাকা
১০ অক্টোবর ২০১৭
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ৭:২০
৩২টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×