somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাষা আন্দোলন কি আবার শুরু করতে হবে !

১৩ ই অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রাম পৃথিবীর বহু জাতিকেই করতে হয়েছে, এখনো অনেকে এই সংগ্রামে রত আছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের আলাদা একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান আছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি ভাষা আন্দোলনের বিশ্বস্বীকৃতি।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রফিক,শফিক,বরকত,সালামসহ বহু নাম না জানা শহীদের রক্ত আমাদের ভাষা আন্দোলনে চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়েছে।

মাতৃভাষা সর্বদা সর্বত্র বিপন্ন হয়েছে উপনিবেশ/সাম্রাজ্যবাদের জন্য। বর্তমানে প্রচলিত কাঠামোতে রাষ্ট্রব্যবস্থার সূত্রপাত যেমন ইউরোপে, বর্তমানরূপে প্রচলিত সাম্রাজ্যবাদও সূচিত হয়েছে ইউরোপে। গ্রীকদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে ভাষা চাপিয়ে দেয়ার নজির কম। রোমান সাম্রাজ্য ভাষা দখলের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেটা আংশিক সফল হয়েছে। ইংরেজিসহ ইউরোপে রোমান বর্ণমালতেই অনেক ভাষাকাঠামো গড়ে উঠলেও ইউরোপের সব জাতি তাদের স্বতন্ত্র ভাষা গড়ে নিয়েছে। অর্থাৎ নিজ মাতৃভাষাকে সাম্রাজ্যবাদী আঘাত থেকে বাঁচাতে পেরেছে। এখনো তারা তাদের ভাষা টিকিয়ে রেখেছে, নিজের ভাষার প্রতি তাদের ঈমান আজো অটুট আছে। গ্লোবালাইজেশনের যুপকাষ্ঠে তারা তাদের ভাষাকে বলি দিতে প্রস্তুত নয়। এতে তাদের উন্নয়নে কোন বড়ো সমস্যা দেখা দিচ্ছে বলেও কোন খবর শুনিনি।

গ্রীক, রোমানদের তুলনায় সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী (প্রায় সাতশ'বছর) সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলো আরবরা। আরবদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে আরবী ভাষা ও সংস্কৃতি এবং ধর্মবিস্তার ছিলো অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ফলে আরবের চারপাশেরতো বটেই এমনকি আফ্রিকার অনেক দেশে আজো আরবী মাতৃভাষারূপে বিরাজমান। ধর্মবিস্তারে আরবরা বড়ো কোন বাধা না পেলেও ভাষা বিষয়ে কালক্রমে তারা বাধাপ্রাপ্ত হয় দুই লাগোয়া প্রতিবেশী ইরান ও তুরস্ক থেকে। আরবীর ধাক্কা সামলে ইরান তাদের পুরনো ভাষা পাহলবীকে ঘষে মেজে আজকের ফারসি গড়ে তুলেছে আর তুর্কিরা বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের তুর্কিভাষা। গজনীর সুলতান মাহমুদের পৃষ্ঠপোষকতায় মহাকবি ফেরদৌসী আরবীর বদলে পাহলবী ভাষায় প্রাক-ইসলামী যুগের কিংবদন্তীর বীর সোহরাব-রুস্তমকে নিয়ে লিখলেন জগৎখ্যাত মহাকাব্য ''শাহনামা''। পুরো জাতির সচেতন অংশগ্রহণে টিকে গেলো তাদের মাতৃভাষা।

ভারত বর্ষে আর্যদের আগমনের ফলে আর্যদের ভাষা (সংস্কৃত) ও সংস্কৃতি প্রচলিত হয়েছে আর্যাবর্তে (উত্তর ভারত)। কিন্তু দাক্ষিণাত্যে ( দক্ষিণ ভারত) আর্যদের ধর্মীয় প্রভাব কাজ করলেও ভাষা সংস্কৃতি প্রভাব ফেলতে পারেনি। আজো দাক্ষিণাত্য নিজভাষাসমূহ টিকিয়ে রেখেছে(তামিলনাড়ু, কেরালা,কর্ণাটক ইত্যাদি)। সেখানে নিজ নিজ ভাষা আর ইংরেজি চলে উত্তর ভারতীয় ভাষা হিন্দী বা উর্দুর কোন প্রবেশাধিকার নেই। মুম্বাইয়ের মহাতারকাদের বদলে নিজেদের তারকাদের নিজ নিজ ভাষার ছবি, গান, নাচ সেখানে প্রচলিত।

আর্যদের পর মুঘল আমলে ফার্সি হয় রাজভাষা, এরপর ইংরেজ আমলে ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে দেয়া হয় আমাদের ওপর। ১৯৪৭ সালে চাপানো হয় ভারত থেকে আমদানীকৃত উর্দু। তার জবাবে আমরা ১৯৫২ সালে রক্তের আখরে লিখি বাংলার নাম।

নানা রাজভাষার চাপে পিষ্ঠ বাংলা ভাষাকে সবসময় টিকিয়ে রেখেছে আমজনতা। বাংলা টিকে গেছে তারা বাংলাকে মাতৃভাষারূপে ব্যবহার করেছেন বলে। চিরকাল সমাজের সুবিধাভোগী/তথাকথিত অভিজাত সম্প্রদায় ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে মানসম্মানের পরোয়া না করে রাজভাষার অধীনতা মেনে নিয়েছিলেন। এখনো সেই ধারা বলবৎ আছে।

চিরকাল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভাষা সংস্কৃতি দখলের চেষ্টা চালিয়ে গেছে। জাগতিক সুবিধার ( চাকরি/ব্যবসা) লোভ দেখিয়ে বাধ্য করেছে রাজভাষা গ্রহণে। অভিজাতরা তো নিজের ব্যক্তিস্বার্থে মাথা নোয়াবার জন্য তৈরি ছিলোই।

বাংলাকে রাজভাষার পাশাপাশি ধর্মীয় বাধাও সইতে হয়েছে। সনাতন ধর্মের ধর্মগুরুরা সংস্কৃত ছাড়া অন্যভাষায় (বাংলাও এর অন্তর্গত) বেদ চর্চা নিষিদ্ধ বলেই ক্ষান্ত হননি রৌরব নরকে পতিত হবে বলেও ফতোয়া দিয়েছিলেন। অন্যদিকে মুসলিমরা কোরানের ভাষা আরবীর প্রভাবে বাংলাভাষা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলো। ফলে বাংলাকে টিকে থাকতে হয়েছে ব্রাত্যজনের ভালোবাসা সঙ্গী করে। স্বাধীন সুলতানী আমলে বাংলায় রামায়ন, মহাভারতের অনুবাদকে রাজদরবার পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছিলো। আরাকান রাজদরবারে মন্ত্রী ও কবি মাগন ঠাকুরের সৌজন্যে আলাওল প্রমুখ বাংলা কাব্য চর্চায় অবদান রেখে গেছেন। এইসব ব্যতিক্রম বাদে ব্রাত্যজনই ছিলো বাংলার সহায়।

বাংলার পক্ষে সংগ্রামের হাত যে ওঠেনি তাও নয়। একটা নগদ নজীর দিই। মধ্যযুগের কবি শেখ আবদুল হাকিম ''বঙ্গবাণী'' কবিতায় বাংলা ভাষা বিরোধীদের একহাত নিয়েছেন--
'' যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।''

বাংলা যাদের ভালো লাগে না তাদের নিজ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন কবি। মাইকেলতো ইংরেজির ছ্যাঁকা খেয়ে বাংলার দরবারে মহাসমারোহে ফিরে এসেছিলেন। যদিও মাইকেলের নজীর আমরা কেউ মনে রাখি না।

আজ স্বাধীনতার এতো বছর পরও যে বাংলাভাষাকে অবলম্বন করেই আমরা স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবতা দান করেছি সেই বাংলাদেশে বাংলাকে বিপন্ন মনে হচ্ছে। অফিসে বাংলা প্রচলিত থাকলেও ইংরেজিতে দুর্বলতাকে (?!) অফিসারদের দোষ গন্য করা হয়। মিডিয়াতে এসব নিয়ে খবরও ছাপা হয়। বেসরকারী অফিষ/ব্যাংক প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি না জানলে চাকরি পাওয়া/টেকানো যায় না। ইংরেজিতে মাস্টার্স করা কাউকে দেখলে শ্রদ্ধায় (?!) আমাদের মাথা নামতে নামতে প্রায় পায়ের তলায় ঠেকে। বাংলায় এমএ কে দেখলে আমাদের মাথাতো নামে না পারলে পা উঠে যাবার যোগাড়। তথাকথিত আন্তর্জাতিক ভাষার সাম্রাজ্যবাদী প্রচারণায় আমরা বিভ্রান্ত। জাপান, কোরিয়া,চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যাণ্ড যে ইংরেজি ছাড়াই উন্নতি করছে এটা বেমালুম ভুলে আছি।

বাংলার জন্য আরেক উৎপাত এফএম রেডিওগুলো। এর মাধ্যমে বাংলা ইংরেজি মেশানো এক হিজড়া ভাষা প্রচলিত হচ্ছে। বাংলা যে কটা শব্দ সে ভাষায় থাকে সেগুলোও ইংরেজিপ্রভাবিত ভুল উচ্চারণে মহাবিকৃত। ইংরেজিগুলোও ভুল ব্যবহার ও উচ্চারণে আক্রান্ত। তরুণ প্রজন্ম এটাকেই তথাকথিত স্মার্টনেসের পরিচায়ক ধরে নিয়ে ভ্রান্তির দিকে ছুটতে শুরু করেছে।

সমস্যাটা প্রকট হবার কারণ আগে চাকুরির প্রতি মানুষের আগ্রহ কম ছিলো। স্বাধীন জীবনকে তারা মর্যাদাপূর্ণ জ্ঞান করতেন। এখন চাকরি পাওয়াকে মর্যাদাপূর্ণ মনে করা হয়। আগে মিডিয়া বা তার প্রভাব ছিলো না। এখন মিডিয়া জীবনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। এই মিডিয়া বাংলাকে এরকম প্রান্তীয়করণের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে চাকরি আর মিডিয়ার দাপটে প্রান্তিকজনেরা নিজেদের প্রান্তিকতম ভাবতে শূরু করবে। এটাই হয়ে উঠছে বাংলা ভাষার জন্য বিপদের কারণ।

বাংলাকে এই বিপদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য কোন সংগঠিত বা সুচিন্তিত প্রয়াস তো চোখে পড়ছে না। বাংলাকে রক্ষার জন্য তবে কী আবার ভাষা আন্দেলনে নামতে হবে ?

এই প্রশ্ন রাখলাম সুধিজনের দরবারে।

সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:৪০
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×