চলচ্চিত্র একটি বহুমাত্রিক মাধ্যম। প্রথমত: শিল্পমাধ্যম- বাণিজ্য ও কলা উভয়ার্থেই। অত:পর বিনোদন মাধ্যম। সর্বোপরি শক্তিশালী একটি গণমাধ্যম।
আলোকতত্ত্ব, চিত্রগ্রহণ, উপন্যাস, গল্প, নাটক, চিত্রকলা, সঙ্গীত প্রভৃতি মাধ্যমের মূলসূত্রগুলো আত্মস্থ করেই চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে বহুমাত্রিক, জটিল অথচ স্বতন্ত্র মাধ্যম। চলচ্চিত্র নির্মানের জন্য এক সাথে দরকার লক্ষ্মী ও সরস্বতীর আশীর্বাদ। যদিও এই দুই সহোদরা কদাচিৎ সহাবস্থান করেন। তাই দু'একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্রে বেনিয়াদের একচ্ছত্র দাপট। বেনিয়াদের অর্থলোলুপতার খাই মিটিয়েও কিছু বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষ চলচ্চিত্রকে পরিণত করেছেন শিল্পকলায়, পরিণত করেছেন মানবতার মুক্তিসংগ্রামের ধারক ও সহযোদ্ধায়। প্রিফিথ, চ্যাপলিন, আইজেনস্টাইন, লুই বুনুয়েল, সত্যজিৎ, গদার, ত্রুফো, রেনোয়া, বার্গম্যান, কুরোশাওয়া, ফেলিনি, হিচকক, স্পিলবার্গ প্রমুখ এ ধারার সূর্য সন্তান। এঁদের হাতেই মানুষের জীবন, জীবন সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধবিরোধিতা চলচ্চিত্রে অবিস্মরণীয় শিল্পরূপ লাভ করেছে।
পৃথিবীর বড়ো সব যুদ্ধ, বিপ্লব আর মুক্তিসংগ্রামকে অবলম্বন করে নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে মহৎ আর শিল্পসফল চলচ্চিত্রগুলো। এ প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের আলোকে দৃষ্টি দেয়া যাক মহান মুক্তিযুদ্ধ আর আমাদের চলচ্চিত্রের মেলবন্ধনের চালচিত্রে।
কি করে এলো ?
বহু মনীষীর বহু শতাব্দীর সাধনার যোগফল আজকের চলচ্চিত্র। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টোটল (খ্রীস্টপূর্ব ৩৮৪ থেকে খ্রীস্টপূর্ব ৩২২) তাঁর 'প্রবলেমটা'য় 'ক্যামেরা অবসবিউরা'র কথা বলে এর সূচনা করেন। তারপর ইউক্লিড, টলেমি, আবু আল হোসেন, আল খাজেন, জন ব্যপ্তিস্তা পোর্টা, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, আলবার্তি, কেপলার, রোজেট, টমাস আলভা এডিসন প্রমুখের যুগান্তকারী গবেষণার পথ ধরে এগিয়েছে চলচ্চিত্র।
এর প্রথম বাস্তবরূপের দেখা পাই ফ্রান্সের লুমিয়ের ভাইদের তৈরি করা চলচ্চিত্রে। তারা এটা করেন ১৮৯৫ সালে। চলচ্চিত্রের তাত্বিক ভিত্তি টলেমি ও পরে পিটার মার্ক রোজেট কর্তৃক উত্থাপিত 'অবিরল দৃষ্টিতত্ত্ব' (persistence of vision )। এ তত্ত্বের গূঢ়ার্থ হলো, মানুষের দৃষ্টি শক্তির একটা সীমাবদ্ধতা আছে। যখন কোন বস্তু মানুষ দেখে তা সরিয়ে ফেলার পরও দশ ভাগের এক সেকেণ্ড পর্যন্ত চোখে ওই বস্তুর ছবিই থেকে যায়। ওই অল্প সময়ে সে আর নতুন কিছু দেখতে পায় না। সিনেমার পর্দায় একটি ছবি ফুটে ওঠার পর আরেকটি ছবি ফুটে ওঠার আগে অল্প সময়ের জন্য পর্দা সাদা হয়ে যায়। দশ ভাগের এক সেকেন্ড পর্যন্ত নতুন কিছু দেখতে না পাবার যে সীমাবদ্ধতা সে কারনে মানুষ অল্প সময়ের জন্য সাদা হয়ে যাওয়া পর্দাটি দেখতে পায় না। এর ওপর ভিত্তি করেই চালু হয়েছে চলচ্চিত্র।
বর্তমানে যে গতিতে সিনেমা হলে ছবি প্রদর্শিত হয় তাতে প্রতি সেকেণ্ডে ২৪টি ছবি (frame ) পর্দায় প্রতিফলিত হয়। এক মিনিট ছবি দেখাতে প্রয়োজন হয় ৯৫ ফুট ফিল্ম।
প্রথম ছবির কথা
পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় প্যারিসের গ্র্যাণ্ড ক্যাফেতে ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর। অগাস্ট লুমিয়ের ও তার ভাই লুই লুমিয়ের তাদের উদ্ভাবিত 'সিনেমাটোগ্রাফ' যন্ত্রের সাহায্যে ২০ মিনিটের এ প্রদর্শনীতে বেশ ক'টি ছোট ছোট চলচ্চিত্র দেখান।
এ উপমহাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই মুম্বাইয়ের ওয়াটসন হোটেলে। প্রদর্শন করেন সেই লুমিয়ের ভাইয়েরাই। অবিভক্ত বাংলায় প্রথম চলচ্চিত্র দেখান মি.স্টিফেন্স ১৮৯৬ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায়।
এ উপমহাদেশীয়দের মধ্যে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন মানিকগঞ্জের বগজুরি গ্রামের হীরালাল সেন। ১৮৯৮ সালের ৪ এপ্রিল তিনি ভোলার এসডিও'র বাংলোয় ছায়াছবি দেখান। খুব সম্ভব বাংলাদেশের বর্তমান ভৌগোলিক সীমানায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের এটাই প্রথম ঘটনা।
হীরালাল সেনই ১৯০০ সালে এ উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মান করেন অমর দত্ত পরিচালিত মঞ্চনাটক সীতারাম-এর অংশ বিশেষ চিত্রায়নের মাধ্যমে।
বাংলাদেশে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মান করেন আবদুল জাব্বার খান। ১৯৫৪ সালের ৬ আগস্ট ঢাকার শাহবাগ হোটেলে ( বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসাতালের 'এ' ব্লক) তাঁর ছায়াছবি ''মুখ ও মুখোশ''-এর মহরত অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট রূপমহলসহ ৪টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিপায় ছবিটি। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন গভর্নর শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক।
এর আগে অবশ্য ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা জহির ও খাজা আজমল সহ কয়েকজন তরুণ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'সুকুমারী' (১৯২৭-২৮) এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'দা লাস্ট কিস' (১৯৩১) নির্মান করেন বলে জানা যায়। তবে ছবিগুলোর কোন প্রিন্ট এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
চলচ্চিত্রের মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মতো আমাদের চলচ্চিত্রকেও মুক্তির জন্য যুদ্ধ দিয়ে যাত্রা শুরু করতে হয়। ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে ডা. সাদেক কর্তৃক আহুত সভায় পাকিস্তানী চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীরা বললেন ঢাকার আবহাওয়া আর্দ্র; মূলধন, কারিগরী জ্ঞান এবং শিল্পীর অভাব আছে তাই ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মান অসম্ভব। আবদুল জাব্বার খান এ বক্তব্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তৈরী করেছিলেন 'মুখ ও মুখোশ'। অভিজ্ঞতা ও অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকার পরও তাঁর এ দু:সাহসী প্রয়াস ঢাকায় পূর্ণাঙ্গ স্টুডিও তৈরির ক্ষেত্র তৈরি করে। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী (বঙ্গবন্ধু) শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক আইন পরিষদে ইস্ট পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন বিল উত্থাপন করেন। সামান্য সংশোধনীর পর বিলটি পাশ হয়। এর ফলেই ১৯৫৭ সালে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন বা এফডিসি।
এফডিসি প্রতিষ্ঠার পর সেখানে তৈরী হয় বেশ কিছু জীবনঘনিষ্ট ছবি। এ.জে.কারদার-এর 'জাগো হুয়া সাবেরা', ১৯৫৯, (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি অবলম্বনে। মূল ভূমিকায় ছিলেন তৃপ্তি মিত্র), জহির রায়হানের 'কখনো আসেনি' (১৯৬১), 'কাঁচের দেয়াল' (১৯৬৩), সালাউদ্দিনের 'সূর্যস্নান'(১৯৬৪), সুভাষ দত্তের 'সুতরাং' (১৯৬৪), সাদেক খানের 'নদী ও নারী'(১৯৬৫) ইত্যাদি। কিন্তু পোষাকী উর্দু ছবির কাছে এগুলো ব্যবসায়িকভাবে মার খায়। ঢাকার ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রির অস্তিত্বই হয়ে পড়ে বিপন্ন। বাধ্য হয়ে ঢাকার নির্মাতারও উর্দু ছবি তৈরী শুরু করেন। এমনকি জহির রায়হানও তৈরী করেন উর্দু ছবি 'সংগম'(১৯৬৪)।
কিন্তু ১৯৬৫ সালে সালাউদ্দিন লোককাহিনী ভিত্তিক 'রূপবান' ছবিটি তৈরী করে হৈচৈ ফেলে দেন। ছবিটি উর্দু ছবির সাথে পাল্লা দিয়ে অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা আর ব্যবসায়িক সাফল্য পায়। এ ধারায় আরো ছবি তৈরী হতে শুরু করে। সেগুলোও জনপ্রিয়তা আর ব্যবসায়িক সাফল্য পায়। মূলত এভাবে মজবুত ভিত্তি পায় ঢাকার বাংলা চলচ্চিত্র।
অন্যান্য ছবির জীবন ঘনিষ্টতা সত্ত্বেও আমাদের প্রকৃত মুক্তির আকাঙ্খা আর সংগ্রামকে প্রথম যে ছায়াছবি মূর্ত করে তোলে তার নাম-'জীবন থেকে নেয়া'(১৯৭০)। আমজাদ হোসেনের কাহিনী অবলম্বনে জহির রায়হান পরিচালিত এ ছবি নির্মানশৈলীতে কিছু দুর্বলতা সত্ত্বেও জীবনঘনিষ্টতায়, মহাকাব্যিক গভীরতায় সর্বোপরি বিষয়ের মহত্তে এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টিতে পরিনত হয়েছে।
এরপর জহির রায়হান তাঁর 'আর কতদিন' উপন্যাস অবলম্বনে তৈরী শুরু করেন যুদ্ধবিরোধী মানবতাবাদী এক চলচ্চিত্র 'লেট দেয়ার বি লাইট'। কিন্তু নানা কারণে সেটি শেষ হয়নি। অনেক চলচ্চিত্র বোদ্ধার মতে এটিই জহিরের শ্রেষ্ঠকীর্তি।
মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র
মুক্তিডুদ্ধের চলচ্চিত্রকে আমরা পাই তিন ধাপে। প্রথমত: মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের তৈরি চলচ্চিত্র, দ্বিতীয়ত: বিদেশীদের তৈরী চলচ্চিত্র এবং তৃতীয়ত: যুদ্ধের পরের চলচ্চিত্র।
মুক্তিযুদ্ধকালের চলচ্চিত্র
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার জন্য জহির রায়হান প্রামান্যচিত্র 'স্টপ জেনোসাইড' তৈরী শুরু করেন ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে। যুদ্ধের ভয়াবহতা, প্রাণ বাঁচাবার আশায় অসহায় মানুষের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণের চিত্র বাস্তব ও মর্মস্পর্শী হয়ে ফুটে উঠেছে এ ছবিতে। নির্মানশৈলীতে জহির এতে প্রায় স্পর্শ করে ফেলেছিলেন প্রামাণ্যচিত্রের প্রবাদপুরুষ রবার্ট ফ্লাহার্টিকে। বিষয়ের মহত্তে এবং মানবিকাতার জয়গানে তাঁকেও যেন ছাড়িয়ে গেলেন। আমার বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন পর্যন্ত এটিই আমাদের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকীর্তি। এছাড়া জহির রায়হানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আলমগীর কবির তৈরী করেন প্রামাণ্যচিত্র 'লিবারেশন ফাইটার্স'। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ সাউন্ডট্র্যাকে ওভারল্যাপ করে এ ছবিতেই প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে।
বাবুল চৌধুরীর প্রামাণ্যচিত্র 'ইনোসেন্ট মিলিয়নস'-এর বিষয়বস্তু শিশুদের ওপর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতা। জহির রায়হান 'এ স্টেট ইজ বর্ণ' তৈরী করেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধেকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে।
বিদেশীদের ক্যামেরায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ
ভারতীয় প্রামান্যচিত্র নির্মাতা শুকদেব আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরী করেন প্রামান্যচিত্র 'নাইন মান্থস অব ফ্রিডম'। বৃটিশ টিভি চ্যানেল প্রাগডার উদ্যোগে নির্মিত হয় 'মেজর খালেদ'স ওয়ার'। জাপানী চলচ্চিত্রকার নার্গিশ ওলিমা নির্মান করেন 'বাংলাদেশ স্টোরী'। ভারতের গীতা মেহতা 'ডেটলাইন বাংলাদেশ' এবং দূর্গাপ্রসাদ 'দূরন্ত পদ্মায়' চিত্রিত করেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে।
১৯৯০ দশকের মাঝামাঝিতে বৃটিশ টিভি নেটওয়ার্ক চ্যানেল-৪ এর উদ্যোগে গীতা সায়গল ও ডেভিড বার্গম্যান তৈরী করেছেন 'ওয়ারক্রাইমস ফাইল'।
মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র
যেখানে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ৫৫ বছর পর ডি.ডাব্লিউ গ্রিফিথ তৈরী করেন মহাকাব্যিক চলচ্চিত্র 'বার্থ অব এ নেশন' (১৯১৫)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৫০ বছর পরও স্পিলবার্গ তৈরী করেন অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র 'সিন্ডার্স লিস্ট'। সেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরের বছর মুক্তিযদ্ধ নিয়ে ছবি তৈরী হয় মাত্র ৪টি। ১৯৭৩ সালে আর ৪টি এবং ১৯৭৪ সালে ২টি। তারপর দু'একটি বিচ্ছিন্ন প্রয়াস ছাড়া আমাদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধকে খুঁজে পাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোর শিল্পমানও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুব আশাব্যঞ্জক নয়।
আলমগীর কবিরের 'ধীরে বহে মেঘনা' (১৯৭৩) , হারুন অর রশীদের 'মেঘের অনেক রং' (১৯৭৬) এবং হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত 'আগুনের পরশমনি' (১৯৯৪) এ তিনটি ছবিই কিছুটা মান সম্পন্ন।
এর বাইরে ফখরুল আলমের 'জয় বাংলা', সুভাষ দত্তের 'অরুনোদয়ের অগ্নি সাক্ষী', খান আতার 'আবার তোরা মানুষ হ ', কবীর আনোয়ারের 'সুপ্রভাত', 'স্লোগান', চাষী নজরুলের 'ওরা ১১ জন', 'সংগ্রাম', মমতাজ আলীর 'রক্তাক্ত বাংলা', মিতার 'আলোর মিছিল', আলমগীর কুমকুমের 'আমার জন্মভূমি', আনন্দের 'বাঘা বাঙ্গালী' উল্লেখযোগ্য। কিন্তু চলচ্চিত্রের গুনগত মানের বিচারে এগুলোর অবস্থা মোটেও উৎসাহব্যঞ্জক নয়। তবু তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই তাঁরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ছবিতে ধারন করার চেষ্টা করেছেন বলে। প্রতিভার ঊনতার জন্য হয়তো শিল্পমানে মার খেয়েছেন। প্রতিভার ঊনতা ব্যক্তির ক্রুটি কিন্তু সেটা দোষ নয়।
মুক্তিযুদ্ধের মতো এত বড়ো একটি ঘটনার প্রতি চলচ্চিত্রকাররা এত উদাসীন হয়ে গেলেন কেন ? বিষয়টি নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিৎ। পর্যবেক্ষণ থেকে কিছু কারণ অনুমান করা যায়। প্রথম থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রও বেনিয়াদের বাণিজ্যিক লক্ষ্যে পরিণত হয়। কিছু বিষয় সরলরৈখিকভাবে সব ছবিতে চলে আসে-ধর্ষন দৃশ্যকে ত্রুটিপূর্ণভাবে উপস্থাপন, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও রাজাকার-আল বদরদের অপকর্মকে বস্তুনিষ্ঠ ও সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়নি, শুধু ধর্ষনকেই পূঁজি করা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলিত, হতাশ এমনকি বিপথগামীরূপেও উপস্থাপন করা হয়েছে। সঙ্গতকারণেই এসব পছন্দ করেননি মুক্তিযুদ্ধের দগদগে অভিজ্ঞতা বহনকারী জনসাধারণ। ফলে ছবি মার খেয়েছে। পূঁজি লগ্নির আগ্রহ হারিয়েছে বেনিয়ারা। এছাড়া স্বাধীনতার কয়েকবছর পর থেকেই বদলে যেতে শুরু করে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। সত্যিকারের প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতার অবিশ্বাস্যরকমের দুভিক্ষও আরেকটা কারণ। আমরা এমন কাউকে পেলাম না যার হাতে আইজেনস্টাইনের মতো 'ব্যাটলশীপ পটেমকিন' (যেটি এ যাবৎ নির্মিত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বলে বেশীরভাগ গুনীই মনে করেন) বা চ্যাপলিনের 'দা গ্রেট ডিকটেটর' মানের না হোক, অন্তত: ভিত্তোরিও ডি'সিকার 'সান ফ্লাওয়ার' কিংবা ডেভিড লীনের 'দা ব্রিজ অন দা রিভার কাওয়াই' - এর মতো একটা ছবি হলেও পেতে পারতাম। হয়তো আছেন কেউ কিন্তু নেই তার অর্থবল।
প্রামান্য চিত্র
সরকারী উদ্যোগে আলমগীর কবির দু'টি প্রামান্যচিত্র তৈরী করেন- 'প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ' (১৯৭৩) এবং 'লং মার্চ টুয়ার্ড গোল্ডেন বাংলা' (১৯৭৪)।
প্রত্যাশার আলো : বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র
মূল ধারার চলচ্চিত্রের সর্বব্যাপী হতাশার পাশে আশার আলো বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসাবেও এদের আমরা চিনে থাকি। অনভিজ্ঞ, অসচ্ছ্বল একদল মেধাবী উদ্যমী তরুণ প্রায় পরিত্যক্ত ১৬ মি.মি. ক্যামেরা আর প্রজেক্টর সম্বল করে এর গোড়াপত্তন করেছিলেন। মু্ক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই এদের প্রধান সম্বল। এর মধ্যেই ওদের অনেকে ছিনিয়ে এনেছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। মোরশেদুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবি 'আগামী' (১৯৮৪) ১৯৮৫ সালের দিল্লী চলচ্চিত্র উৎসবে 'রৌপ্য ময়ূর' লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মোরশেদ এরপর তৈরী করেন 'সূচনা'। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরী অন্যান্য ছবির মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে- মোস্তফা কামালের 'প্রত্যাবর্তন', আবু সায়ীদের 'ধূসর যাত্রা' , খান আখতার হোসেনের 'দূরন্ত', তানভীর মোকাম্মেলের 'স্মৃতি-৭১', নাসির উদ্দীন ইউসুফের 'একাত্তরের যীশু'।
সা¤প্রতিক কালে আলোড়ন তুলেছে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরীন মাসুদ দম্পতির 'মুক্তির গান'। ১৯৭১ সালে নিউ ইয়র্কের সাংবাদিক লিয়ার লেভিন 'বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা'র সাথে ঘুরে ঘুরে তাদের কার্যক্রমের ওপর ২০ ঘন্টার দৃশ্য ধারন করেছিলেন। কিন্তু তা ২৩ বছর লোকচক্ষুর আড়ালে বাক্সবন্দী হয়ে পড়েছিলো অর্থসঙ্কট এবং লেভিন বাংলা বুঝতে পারেননি বলে। তারেক-ক্যাথরীন সেগুলো উদ্ধার করে সম্পাদনার পর ৮০ মিনিট দৈর্ঘ্যের 'মুক্তির গান' ছবিটি তৈরী করেন। এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দারুন এক প্রামান্য দলিল এবং প্রথম রঙিন চিত্র। বাকী সব চিত্র পাই সাদা-কালোতে।
বিকল্প ধারার এইসব মানুষরাই আমাদের জন্য আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন।
সমাপনী
গত বছর বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্রের শতবর্ষ পালিত হয়েছে। মুখ ও মুখোশ থেকে ধরলে আমাদের চলচ্চিত্রের বয়স ৪০ বছর। দেশ স্বাধীন হয়েছে ২৫ বছর আগে। ৪০ বছরেও আমাদের চলচ্চিত্র বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটে এখনো শৈশবে পড়ে আছে। অন্য দিকে প্রযুক্তি আর অগ্রসর বিজ্ঞান ভাবনায় বিশ্বচলচ্চিত্র চলে গেছে জুরাসিক পার্ক পর্যায়ে।
আমাদের সামনেও আছে অমিত সম্ভাবনা। আছে হাজার বছরের সংগ্রামী ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক ভিত্তি। আমরা আশাবাদী আমাদের তরুণদের নিয়ে। যারা একদিন আমাদের মু্ক্তিযুদ্ধ নিয়েও তৈরী করবে বিশ্বমানের মহৎ চলচ্চিত্র। যারা চিলির বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার মিগুয়েল লিতিনের মতো বিশ্বাস করেন-''We regard our people as our only masters. Our cinema should find it's roots in our people. I think that our self impression through cinema must be to fight for our liberty.''
সহায়ক রচনাপঞ্জী:
১. চলচ্চিত্রের শতবর্ষ শতবর্ষের চলচ্চিত্র-মির্জা তারেকুল কাদের, নিরীক্ষা, ৬৯তম সংখ্যা, জানু-জুন,১৯৯৫
২. আমাদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ-তারেক আহমেদ, সুন্দরম, ১১শ বর্ষ ১ম সংখ্যা, আগস্ট-অক্টোবর,১৯৯৬
৩. চলচ্চিত্র ও আমাদের গণ আন্দোলন, কবীর আনোয়ার, মাসিক শৈলী, বর্ষ ১ সংখ্যা ১১, ১ আগস্ট ১৯৯৫
৪. বাংলা চলচ্চিত্রের আদি পর্ব, অনুপম হায়াত, শৈলী, প্রাগুক্ত।
৫. বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলন, মুক্ত দৈর্ঘ্যের সন্ধানে-আলমগীর কবির, মন্তাজ-২, ডিসেম্বর ১৯৮৯
৬. মুক্তির গান মুক্তিযুদ্ধের দলিল উদ্ধার-মিজানুর রহমান খান, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১৬ ডিসেম্বও ১৯৯৪
৭. চলচ্চিত্র নন্দনতত্ত্ব ও বারোজন ডিরেক্টর-তানভীর মোকাম্মেল, সুবর্ণ প্রকাশনী,ঢাকা, প্রথম সংস্করন, ২১ ফেব্র“য়ারি,১৯৮৫
( এ লেখাটি একটি আঞ্চলিক দৈনিকের ১৯৯৬ সালের বিজয়-দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত। বর্তমানে কিছু শব্দ আর বানান ব্যতীত আর কোন পরিবর্তন করা হয়নি।)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:০১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



