somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবার মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধ

১০ ই এপ্রিল, ২০০৮ রাত ৮:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একাত্তুরে আমার বাবা ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কলেজের একজন মুক্তিপাগল ছাত্র। ২০/২১ বছরের তাগড়া যুবক। মিটিং মিছিলে ছিল স্বতঃস্ফুর্ত আস্ফালন। রক্তঝরা দিনগুলির শুরুতেই নাড়ীর টানে ছুটে গেছিলেন গ্রামে। বর্তমানে কক্সবাজার জেলার রামু থানার ঈদগড় নামের এক অখ্যাত গ্রাম। সেই সময়কার পার্বত্য চট্টগ্রাম। সারা দেশে জ্বলছিল মুক্তিযুদ্ধের লেলিহান শিখা। বাবা ও কয়েকজন বন্ধু ঠিক করলেন যুদ্ধে যাবেন। রাতের বেলা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে জোয়ান ছেলেদের যুদ্ধে যাওয়ার ডাক দিচ্ছিলেন। তাদের এই কাজ স্হানীয় কিছু কুত্তাদের সহ্য হয় নাই। গভীর রাতে বাবার এক দুরসম্পর্কের আত্মীয় এসে খবর দিল রাজাকার আর পান্জাবীরা আসতেছে উনাদের ধরার জন্য। সেই রাতেই আমার বাবা, কাশেম আংকেল, নুরুল ইসলাম বাংগালী (মুক্তিযুদ্ধে দুর্দান্ত ভূমিকার কারনে এতদঅঞ্চলের লোকজনের কাছে তিনি বাংগালী বলে বেশি পরিচিত), সিরাজ ডা. বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে চলে আসেন বান্দরবানে। নাম লেখাইছিলেন মুক্তিবাহিনীতে, শপথ নিছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন করার। প্রায় একমাস ট্রেনিং নেয়ার পরে এক রাতের অন্ধকারে উনারা ফিরে আসছিলে গ্রামে, দাদীর কাছ থেকে বিদায় নিতে। সেই রাতে দাদী নাকি বিলাপ করে চিতকার করি কান্দি নিশুতি রাতের আসমান জমিন এক করছিলেন।

মুক্তিবাহিনীরা ঘাঁটি গাড়ছিল কালো পাহাড় নামের গহীন অরন্যে ছনখোলার ভিতরে। যুদ্ধ করছিলেন ঈদগাহ্‌, ঈদগড়, উখিয়া, ডুলাহাজারা ও রামুতে। অরন্যের মগ, মুরুং বা চাকমারা তখনো জানেনা যুদ্ধ কি ? শুধু জানে ১৫/২০ জনের একটা দল পান্জাবী মারার জইন্য ফেরারী হইছে। মুরুং রা মুক্তিবাহিনীর খাওয়া দাওয়া সবকিছুর ব্যাপারে তাদের সাহায্যের হাত বাড়াই দিছিল। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিছিল কয়েকজন মুরুং যুবক।

বাবার ভাষায়, সচক্ষে দেখা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল ঈদগাহ্‌ বাস ষ্টেশনের পাশে ছোট্ট লোহার ব্রীজটাতে। বাস স্টেশনটা কক্সবাজার শহর থেকে ২৫ কি.মি. আগে । খবর আসছে, কক্সবাজারে পাকি মিলিটারীর একটা দল আসতেছে আর ঈদগাহতে ছিল পাকি দের দুর্বল ডিফেন্স। মুক্তিবাহিনীর কাছে পর্যাপ্ত গোলা বারুদ ছিলনা। পাহাড়ী মুরুংদের পাঠানো হল গ্রামে। গ্রামবাসী তাদের চেরাগের শেষবিন্দু কেরোসিনটুকু ঢেলে দিলো ড্রামে, মুদির দোকানীরা দিল তাদের দোকানের সব কেরোসিন। গ্রামে না হয় আর কোনদিন চেরাগ-ই জ্বলবেনা !!! বন্ধ হল কয়েকটা গ্রামের ডিজেল চালিত রাইসমিল। আমার দাদী দিলেন সারা বছরের খোরাক ২০০ আড়ি ধান বেচা টাকা।

সূর্য্য ডুবতেই চারটা নৌকা নিয়ে মুক্তিবাহিনী রওয়ানা হলো। সারা রাত নৌকা চলল ভাটিতে, ঈদগড় থেকে ঈদগাহ, গন্তব্য-ঈদগাহ্‌ ব্রীজ। ভোর হতে আরো দেরী ছিল। লোহার ব্রীজের কাঠের পাটাতনে কায়দা করে বিছানো হল কয়েক'শ চটের বস্তা। একজন উঠে গেল বিরাট এক মেহগনি গাছের আগায়। ব্রীজের দুই মাথায় মুক্তি বাহিনীর দুইটা দল বসে আছে, কখন আসবে হায়েনার দল?? কখন মেহগনি গাছের উপর থেকে তাদের দিকে টর্চ মেরে সংকেত দেয়া হবে ???? মিলিটারিরা আসতেছে, গাছের উপর থেকে টর্চ মারা হল, ঢেলে দেয়া হল ড্রামে ড্রামে কেরোসিন ব্রীজের উপরে। হ্যা , মিলিটারির দুইটা ট্রাক উঠে গেছে ব্রীজে। ব্রীজের দুই মাথা থেকে একই সাথে লাগিয়ে দেয়া হল আগুন। রাতের কালো আকাশ লাল হল, প্রচন্ড যুদ্ধ হল। বেরসিক আগুন আর দুই দিক থেকে মুক্তি বাহিনীর আক্রমন !!! ২০/২৫ জন মুক্তি সেনার হাতে শিয়াল কুত্তার মত মরল ৫/৬ ডজন পাইক্যা "হাইওয়্যান"।

"অ - মা - রে" -------- গগনবিদারী আর্তচিৎকারে সবাই পিছনে ফিরে এলেন। হায়েনার বুলেট বিঁধেচে শান্তির পায়রার বুকে! রক্তে লাল হলো ঈদগাহ্‌ খাল। ভোরের প্রথম আলোয় অন্ধকারে স্তিমিত হল দুটি চোখ, বুকের মানিক হারালেন এক "মুরুং মা"। রক্তদিয়ে লেখা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অলিখিত সৈনিক হয়ে গেলেন মঙ্গোলীয়ান বংশধারার এক উপজাতি মুরুং যুবক।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০০৮ রাত ৩:৫৩
৩১টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×