somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একি খেলা আপন সনে- ২

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১০:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নতুন বাবার বাড়িতে যখন পৌছলাম তখন বেশ রাত। অবশ্য রওয়ানা দিয়েছিলামও আমরা ও বাড়ি হতে বেশ দেরী করেই। নয়তো ওয়ারী থেকে ধানমন্ডি কতটুকু আর দূরত্ব ছিলো? তখনকার দিনে আজকের মত এত যানজট তো ছিলো না। সব রাস্তাই ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। গাড়ি ঘোড়াও এমন গিজগিজ করতোনা সারাটা পথ জুড়ে। আমি বসেছিলাম মায়ের পাশ ঘেষেই, গাড়ির পেছনের সিটে। আমার নতুন বাবা, মধ্যে মা আর জানালার কাঁচের ধারে আমি। গাড়িতে চড়লেই আমার সবচাইতে বেশি আনন্দের কাজটাই ছিলো রাস্তা বা বিপনী বিতানগুলির আলোকসজ্জা দেখা ও তাদের নামগুলো বানান করে করে পড়া। সিনেমা হলগুলোর সামনে বিশাল বিশাল রঙ্গিন সব ছবি আর তার নাম ধাম পরিচয় এ আমাকে এক বিশেষ আনন্দ দিত। সেদিনের ওয়ারী থেকে ধানমন্ডি ভ্রমনটুকুর অল্প ঐটুকু পথেই আমি যথারীতি দোকানের আলো আর নামগুলি দেখছিলাম। দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানিনা। আমার বামদিক ছুঁয়ে বসেছিলেন মা। মায়ের নতুন লাল শাড়ী চোলির জরি, চুমকীর খসখসে ছোঁয়া এবং বিদেশী পারফিউমের সেই গন্ধের মাদকতাটা আজও মাঝে মাঝে কোথা থেকে যেন ভেসে আসে। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় অতীতের সেই নতুন অধ্যায়ের সূচনার দিনটিতে।

গাড়ি ব্রেক করতেই আমার ঘুম ছুটে গেলো। চারিদিকে লোকজন, উৎসবের রই রই আমেজে ঐ মধ্য রাতেও সরগরম হয়ে উঠলো চারিপাশ। সবাই নতুন বউকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। আমার নতুন বাবার রাশভারী মা ধান দূর্বা দিয়ে বরণ করলেন মাকে। পাও ভিজিয়ে দিলেন দুধ আলতার গামলায়। আমার দিকে কারো কোনো খোঁজই রইলোনা। হই হই এর মাঝে আমি মায়ের থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়লাম। সবাই এগিয়ে নিয়ে চললো মাকে। আর আমি হতভম্ভের মত কিছুখন একা একা দাঁড়িয়ে রইলাম পিছে। আমার সামনে পড়ে রইলো দুধ আর আলতা মেশানো অপরূপ সেই শ্বেত পাথরের গামলা। যেই অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবীর মায়াময় সেই রঙ তরলে মা পা ডুবিয়ে চললেন তার নতুন গৃহে। সেই হালকা গোলাপ ছোঁয়া রঙের মোহময় রঙ্গিন তরল পাত্র তির তির করে কাঁপছিলো তখনও আমার সামনে এক অদ্ভুত নিসঙ্গতায় আমাকে সঙ্গ দেবার জন্যই মনে হয়।

কিছুখন পর বুড়োমত এক লোক আমাকে দেখে হই হই করে উঠলো।
- আরে কি ব্যপার! কি সমস্যা এখানে দাঁড়িয়ে কেনো একা তুমি মা? তোমার মা কোথায়? কার সাথে এসেছো তুমি? কোন বাড়ির মেয়ে?
উনার এক গাঁদা প্রশ্নে আর মন খারাপ করা অকারণ অজ্ঞাত কারণে আমি ভ্যা করে কেঁদে ফেললাম। অনেক কষ্টে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম,
- আমি আমার মায়ের সঙ্গে এসেছি।
উনি উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
- আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। মা তো আর হারিয়ে যান নি। চলো চলো ভেতরে চলো। আমি তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।
উনার হাত ধরে ভেতর বাড়িতে চললাম আমি। বিশাল ঝাঁড়বাতিওয়ালা বিস্তৃত বসার ঘরের মাঝে তখন মানুষের ঢল নেমেছে। এত রাত্রীতেও এত আয়োজন! আমি ভড়কে গেলাম। ঘুম আমার তখন পুরোই ছুটে গিয়েছিলো। দেখলাম মা আর আমার নতুন বাবাকে পাশাপাশি বসিয়ে নানা বয়সী বিশেষ করে বর্ষীয়সী নারী পুরুষেরা মিষ্টি মুখ করাচ্ছেন। নানা রকম উপহার দিচ্ছেন। আশীর্বাদ করছেন।

উনি বললেন, কোথায় তোমার মা খুকি? খুঁজে বের করো এখন...
আমি দূর থেকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিলাম মাকে। সাথে সাথে উনার চেহারা গম্ভীর হয়ে গেলো। উনি আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক দঙ্গল মহিলা, বালিকা টাইপ মেয়েদের কাছে। ওদের মাঝে মিষ্টি চেহারার এক ২০/২৫ বছরের তরুনীকে ডেকে বললেন,
- এই মেয়েটি নতুন বউমনির আগের পক্ষের মেয়ে। একা একা কাঁদছিলো বাইরে দাঁড়িয়ে। এর খেয়াল রেখো।
উনার কথায় মেয়েগুলির মাঝে চাঞ্চল্যটা সেই বয়সেও বেশ খেয়াল করেছিলাম আমি। বুড়ো লোকটি সরে যেতেই তারা কানাকানি, ফিসফিস স্বরে নিজেদের মাঝে কি বলাবলি করে হাসাহাসি করতে শুরু করলো। শুধু মিষ্টি চেহারার সেই মেয়েটি এসে আমার হাত ধরলো, বললো তুমি কিছু খাবে? চলো তোমাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাই। ঘুম পেয়েছে নিশ্চয় তোমার...

আমি কিছু বলার আগেই সে আমাকে হাত ধরে নিয়ে চললো। লম্বা করিডোর পেরিয়ে নিয়ে আসলো একটি বন্ধ দরজার সামনে। বন্ধ দরজার গায়ে কাঁঠের পদ্মফুলের কারুকাজ। এত অদ্ভুত সুন্দর কিন্তু কালো কুঁচকুঁচে সেই কাঁঠের দরজাটা দেখেই আমার মনে পড়ে গেলো বাবা মায়ের সেই দূর্বিসহ ঝগড়া বিবাদের দিনগুলোতে বাবাকে দেওয়া মায়ের সেই তীক্ষ্ণ গালমন্দগুলি। যার মাঝে একটি ছিলো তার ঘোর কৃষ্ণ বর্ন নিয়ে। মা বলতেন আবলুশ কাঁঠ। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করলাম মনে মনে এটাই কি সেই আবলুসশ কাঁঠ?

আমার মন হঠাৎ এত দিন পরে বাবার জন্য কেনো যে মুচড়ে উঠলো। ঐ মেয়েটি তাড়া দিলো।
- যাও যাও তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। ছোট মানুষ এত রাত কি জাগতে পারে?
আমার বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলো, আমি একা একা ঘুমাতে পারবোনা, মায়ের কাছে যাবো। কিন্তু বলতে গিয়েও মনের কথাটা ঢোক গিলে ফেললাম সাথে সাথেই। আমি বুঝে গেলাম এই কথা বলার সময় মানে স্থান, কাল, পাত্র এখন নয়।

মেয়েটা আমাকে আমার বিছানা দেখিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে গেলো। আমার রাতের পোষাক বা অন্যান্য কিছুই আমার সাথে নেই। আমি সেই জরি ঝকমকা জামাটা পরেই নরম তুলো তুলো বিছানার উপরে বসে রইলাম। বাইরের হট্টগোলের ক্ষীন আওয়াজ ভেসে আসছিলো এত দূরেও বন্ধ দরজা ভেদ করে।

আমার বুকের মাঝে এক অকারণ শূন্যতা। হু হু করে উঠলো সব কিছু ছাঁপিয়ে।

আমি আকুল হয়ে কাঁদছিলাম। সেই মধ্যরাতের বদ্ধ ঘরটির দরজা, জানালা, দেওয়ালগুলি নীরব সাক্ষী হয়ে রইলো ১১ বছরের সেই আমির আকুল কান্নার...
একি খেলা আপন সনে - ১
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ৮:২১
৩৮টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×