ও বাড়ির গেটে যখন পা দিলাম। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। ভেবেছিলাম এতক্ষনে বুঝি সেখানে হুলুস্থুল পড়ে গেছে। মা নিশ্চয় আজও আমাকে দেখা মাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়বেন আমার উপরে ঠিক সেদিনের মত। চিৎকার চেঁচামেচিতে পাড়া মাৎ করবেন। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম সেই মধ্য দুপুর গড়িয়ে বিকেলবেলাতেও মানে দুপুরবেলার ভাত ঘুমের সময়টুকু বেশ আগেই পেরিয়ে গেছে তবুও সারা বাড়িতে তখনও এক ঝিম ধরা ভাব। মা মনে হয় তার দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা ছেড়ে এখনও ওঠেননি। কাজের লোকজন সব তখনও নিজ নিজ বিশ্রামেই রয়েছে। আমাকে দেখে বাগানে বাঁধা বিশাল এলসেশিয়ানটা শুধু মুখ তুলে একবার চেয়ে আবার তার সাদা ঝকঝকে পানির পাত্রে মুখ ডুবালো। হলুদ আর লাল রঙের ডোরাকাটা রাবারের তোবড়ানো বলটা যা দিয়ে তিতলী ওকে খেলা শেখাতো কিছুদিন আগেও তা পড়ে ছিলো ঠিক তার পাশেই। বারান্দার রেলিং এ দুইটা চুড়ুই ঝগড়া করছিলো কিচির মিচির। সিড়ির ধারের পাতাবাহার গাছের সাদা হলুদ ছোঁপ দেওয়া পাতাগুলি বিকেলের ঝিরঝিরে সেই বাতাসে কাঁপছিলো তিরতির।
আমার মাথা কিছুই কাজ করছিলো না। আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত বাগান পেরিয়ে বারান্দায় পা দিলাম। বারান্দার চারিদিক ফুলে ফুলে ঝলমল করছে। বড় বড় টবে ফুটে রয়েছে ক্রিসেনথিমাম। কি ঝকঝকে মন ভালো করে দেওয়া চেহারার ফুলগুলো। সাথে পেতলের ঝকঝকে টবগুলো সোনার মত চকচক করছে। আমি খানিক থমকালাম। মনে হলো আচ্ছা এসব টব কি কাজের লোকজন রোজ রোজ পলিশ করে? খেয়াল করিনিতো। নইলে এত ঝাঁ চকচকে চেহারা হয় কেমনে করে? কি সব সাত পাঁচ ভাবছিলাম কে জানে। আমাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ হাশেমচাচা বললেন, আমি তাহলে যাই মা। তুমি ভেতরে যাও। মনে হচ্ছে কোনো সমস্যা হবে না। আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কি হচ্ছে চারপাশে বা আমি কি করছি বা উনি কি বা বলছেন আমাকে। আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। হঠাৎ তিতলী কোথা থেকে যেনো ছুটে এলো, আমার হাত ধরে টানতে লাগলো।
ওর সাথে আমি আমার নিজের অগোচরেই চলে গেলাম ওর নতুন পুতুল বাড়ির খেলাঘরে। তিতলী আমাকে হাত ধরে কার্পেটে বসালো। বক বক করে চললো অনর্গল কি সব। কত্ত রকম পুতুল ওর। বৌ বার্বি, বর বার্বি, তাদের ছেলে মেয়ে সংসার। বেডরুম, ডাইনিং রুম, কিচেন আরও কত কি? হঠাৎ ভীষন হাসি পেলো আমার। সংসার। হায়রে সংসার। এ জগৎ সংসার এক বিশাল রহস্য। হঠাৎ কোথা থেকে যে কোথায় মোড় নেয় এক মুহুর্ত আগেও কেউই জানেনা। তিতলীটা কি সুন্দর হয়েছে। একদম মায়ের গায়ের রঙ পেয়েছে। চেহারাটাও যেন এক পুতুলের মুখ কেটে বসানো। ওর ঘোর কালো ঘন বাঁকানো বাঁকানো চোখের পাপড়িঘেরা গোলগোল চকচকে মনির চোখদুটো ঘুরিয়ে যখন কথা বলে। মনে হয় যেন জ্বলজ্বল হীরের দ্যুতি ঠিকরে বের হচ্ছে। ওর চারপাশ ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র পুতুলের মাঝে ও নিজেই এক জীবন্ত পুতুল।
আমি বসে রইলাম ওর পুতুলের খেলাঘরে ঐ নিষ্প্রান পুতুলগুলোর মতই প্রাণহীন, নিশ্চল। সারা শরীর জুড়ে কি এক অবসন্নতা আর ক্লান্তি। আমর প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছিলো। হাই উঠছিলো বার বার। আমি আসলে আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। আমার সামনে ভুত ভবিষ্যৎহীন অন্ধকার। আমি জানিনা এইবার আমি ঠিক কি নিয়ে বাঁচবো। কিছুই ভাবতে পারছিলাম না, কিছুই না। শিউলি মালটোভা মেশানো গাঢ় খয়েরী রঙের এক গ্লাস দুধ নিয়ে এলো তিতলীর জন্য আমাকে দেখে চমকে উঠলো, আপনি এইখানে? আপনাকে তো খালাম্মা খুঁজতেসে। এই কথায় আমার কোনোই ভাবান্তর হলো না। মনে হলো খালাম্মার কোনো কিছুতেই আমার আর কিছুই যায় আসে না আসলে। অথচ কত কত দিন আমি অপেক্ষায় থেকেছি, অপেক্ষায় ছিলাম, মা আমাকে একটাবার কাছে ডাকবে বুঝি। চুল বেঁধে দেবে বা জিগাসা করবে খেয়েছি কিনা। কিন্তু মা যেন আমাকে ভুলেই গিয়েছিলো।
কি অপরিসীম দক্ষতায়, অবর্ণনীয় উপেক্ষায় এবং আশ্চর্য্য অবহেলায় মা আমাকে এড়িয়ে গেছেন দিনের পর দিন। এই বাড়িতে আমি যেন কোনো অদৃশ্য চলমান বস্তু। যাকে মা দেখতেই পেতেন না। কি খেলাম না খেলাম, কোথায় গেলাম না গেলাম কোনোকিছুরই যেন মূল্য ছিলোনা মায়ের কাছে। অন্যান্য সকলের মত মায়ের কাছেও আমি ছিলাম এ বাড়িতে চরম অপাংক্তেয় একজন। অবশ্য আমি এতদিনে বুঝেছি কেনো আমাকে ঘিরে মায়ের এই উদাসীনতা ছিলো? কিসের ছিলো সেই ক্ষোভ। আমার বাবাই সেই উদাসীনতা বা ক্ষোভের কারণ। বাবা, আমার মায়ের জীবনের এক চরম পরাজয়। অপূরনীয় ক্ষতি, মায়ের পরম হার। আমার বাবা যে উপেক্ষায় এই পরমা সুন্দরী স্ত্রীকে ছেড়ে চলে গেছেন সেই উপেক্ষার জ্বালা সহ্য করার ক্ষমতা ছিলো না আমার পরমা সুন্দরী, অহংকারী মায়ের জন্য। সেই উপেক্ষা বা ত্যাগের যন্ত্রনা তাকে কুরে কুরে খেয়েছে সারাটাজীবন।
নতুন জীবনে এসে মা তাই তার আর কোনো পিছুটান চাননি। পিছে ফিরে তাকাতে চাননি তার এই পরাজিত ইতিহাসের কোনো স্মৃতির কাছে। কিন্তু চোখের সামনে এই জলজ্যান্ত আমি বাবার স্মারকলিপি হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। সেটাই মায়ের আসল যন্ত্রনার কারণ ছিলো। এই আমি ছিলাম মায়ের সকল যন্ত্রনার কারণ। আমি বা আমার উপস্থিতি মাকে যন্ত্রনায় বিদ্ধ করে যেত। এটা জানতে আমার অনেক দেরী হয়েছিলো। কি যে সব সাত পাঁচ ভাবছিলাম। শিউলী আবার তাড়া দিলো। খালাম্মা ডাকতেছিলো আপা। এখুনি যান, নইলে রাগ অইবো। পরম আলস্যতায় উঠে দাঁড়ালাম আমি। পায়ে পায়ে হেঁটে গেলাম মায়ের রুমের দিকে।
মা ইজিচেয়ারে বসে ছিলেন তার রুমেই। হাতে মায়ের প্রিয় বই বিমল মিত্রের কড়ি দিয়ে কিনলাম। ছোট থেকে আমি অন্তত পঞ্চাশ ষাটবার মাকে এই বই পড়তে দেখেছি। বিমল মিত্রের এই কড়ি দিয়ে কিনলাম বইটার মত আরও কিছু প্রিয় বই আছে মায়ের। কেরী সাহেবের মুন্সী, অপরাজিত, নিশিকুটুম্ব, মেমসাহেব আরও এমন কিছু বই যা মাকে বার বারই পড়তে দেখেছি।। আচ্ছা মা একই বই কতবার পড়ে? মায়ের কাছে কত কিছু জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তার সাথে এমন সহজ সম্পর্ক নেই যে এই সামান্য প্রশ্নগুলোও তাকে করতে পারি আমি। আমার স্কুলের বা কলেজের বন্ধুদের মায়েদেরকে দেখেছি। স্কুলগেটে দাঁড়িয়ে থাকতে। মায়ের থেকে টাকা নিয়ে আঁচার বা চটপটি কিনে খেতে এমন আরও কত কত স্মৃতি। আমার মা কোনোদিন আমার জন্য স্কুল গেটে যায়নি। আমাকে কোনোদিন সাথে করে স্কুলে নেয়নি। যেন আমি তার মেয়ে এটা স্বীকার করাতেই ছিলো তার লজ্জা।
মা আমাকে দেখে চোখ তুলে চাইলেন। হাতের বই নামিয়ে রাখলেন পাশের সাইড টেবিলে। তারপর সেখানে রাখা দুটি ফটোগ্রাফ তুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বললেন,
- আমরা এই ছেলের সাথে তোমার সন্মদ্ধ ঠিক করছি। ছেলে বিদেশ থাকে। পিএইচডি করেছে সেখানেই ইউনিভারসিটিতে জব করছে। দেশে এসেছে বিয়ে করতে। তুমি কাল এর সাথে দেখা করবে। মা শুধু আদেশ নিয়েই ক্ষান্ত হলেন না সাথে মায়ের তিরষ্কারও শুরু হলো।
"এই বয়সেই যে অঘটন তুমি ঘটিয়েছো তাতে লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেছে। তোমার জন্য কোথাকার কোন ছোটলোকদের কথা শুনতে হলো আমাদেরকে। জীবনেও ভাবিনি আমার পেটের মেয়ে হয়ে তুমি হবে এমন বেহায়া এবং নির্লজ্জ। ছি ছি লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার।" আরো সব অসহ্য রকম ভৎসনায় উনি ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন আমাকে। আমি ছবিটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম। মন দিয়ে শুনছিলাম মায়ের কথাগুলো। নির্লজ্জের মতই মনে হয় তাকিয়েও ছিলাম ছবিটার দিকে। কিন্তু আসলে ছবিতে আমার মন ছিলো না। আমি ছবিতে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। মা বললেন,
-তোমার সাত জনমের ভাগ্য এমন একজন ছেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এমন উচ্চ শিক্ষিত উচ্চবংশ ছেড়ে.......
মা আরও আরও কি কি সব বলে যাচ্ছিলেন। আমি মায়ের কথার মাঝেই হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেতেই ছবিটার দিকে মন দিলাম। কি অসম্ভব ভদ্র এবং চৌকশ চেহারার একজন মানুষ। হাতে একটি পেপসির প্লাস্টিক গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শীপের রেলিং এর ধারে।
মনে হয় কোনো জাহাজ ভ্রমনের ছবি। পিছে সারি সারি আলোক মালার ঝালর। কুঁচকুঁচে কালো রাত্রীর মাঝে দ্যুতি ছড়াচ্ছে সেই ছোট্ট ছোট্ট আলোক বিন্দুগুলি। কি অসম্ভব সুখী একজন মানুষের ছবি। একজন সফল মানুষ।
মা উঠে গিয়ে আলমারী থেকে একটি শাড়ির প্যাকেট বের করে আনলেন। প্যাকেট থেকে সেলোফেন কাগজ মুড়ানো হাল্কা গোলাপী আর সোনালী রঙের অদ্ভুত মায়াময় কারুকাজ করা একটি কাতান শাড়ি ছুঁড়ে দিলেন আমার দিকে। বললেন-
কাল সকালে ওমেন্স ওয়ার্ল্ডের রুপাকে বলেছি। সে এসে তোমাকে সাজিয়ে দেবে। ড্রাইভারকে বলা আছে ঠিক বারোটার মাঝেই বের হয়ে যাবে। হোটেল সোনারগাতে আছে আরবাজ। সেখানেই লাঞ্চের জন্য বুক করা আছে। মা মনে হয় আপদ বিদায় করতে পারলেই বাঁচেন। বিশেষ করে আমার মতন কেউ যখন আপদ....
শাড়িটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। দরজার কাছে পৌছুতেই মা বললেন,
-শোনো। আমি ফিরে তাকালাম। মা বললেন,
- গর্ধবের মত আবার তোমার সাত কাহন খুলে বলতে বসো না এই ছেলেকে। অনেক পুন্য করলে এমন ছেলে পাওয়া যায়।
আমার খুব হাসি পেলো। জানতে ইচ্ছে হলো, মা কি তবে কোনো পুন্যই করেননি? সারাজীবন জ্বলে পুড়েই মরলেন উনি এত প্রাপ্তির পরেও। আমার ঠোঁটের কোনে অস্ফুটে এক চিলতে হাসিও ফুটে উঠেছিলো হয়ত। মায়ের অলখে সেই হাসি আমি লুকিয়ে ফেললাম।
নিজের রুমে ফিরে এসে হঠাৎ আমার বুকটা হু হু করে উঠলো। আমি জানালায় দাঁড়ালাম। আকাশে কত তারা। পুরো আকাশ জুড়ে তারার ঝিলিমিলি। বেশ দূরের মেইন গেটের সাথে লাগানো হাস্নাহেনা ফুলের গাঢ় স্নিগ্ধ গন্ধ ভেসে আসছে। পৃথিবী কত সুন্দর! সারা পৃথিবীর প্রতিটি ক্ষন তার রূপ রস গন্ধের ডালি নিয়ে বসে আছে। হয়ত আমাদেরকে সুখী করতেই বিশ্ব বিধাতার এত আয়োজন। তবুও এরই মাঝে আমরা মানুষ বা কিছু মানুষ দারুণ অসুখে ভুগছি।
বুকের ভেতর ব্যথার হাহাকার। চাপ চাপ বেদনা। আমি এই বেদনার নাম জানি। কিন্তু আমি এখন সেটা মনে করতে চাইনা। কিছুতেই না।
শৈশব আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে যেতে পারতো। কৈশোর আমাকে উছন্নে ভাসিয়ে দিতে পারতো অবলীলায়। কিন্তু আমি ভেসে উঠেছি। বার বার প্রতিটা ঝড়ঝঞ্ঝা চরম আঘাতও আমি হঠিয়ে দিয়েছি। আমি পিছু হঠিনি কখনও কিছুতেই। এগিয়ে গিয়েছি সকল বাঁধা বিঘ্ন পেছনে ফেলে। আমি হেরে যাবো না। কোনোভাবেই পরাজিত হবোনা আমি। দোলন আমার কাছে আজ থেকে এক মুছে যাওয়া অতীত। ইরেজার দিয়ে ঘষে মেজে তুলে ফেলতে চাই আমি এই অতীতকে আমার জীবন থেকে চিরতরে। এক বিন্দু ক্ষীন মলিন দাঁগও যেন সেখানে না থাকে ।
গভীর রাতে আমি দরজা বন্ধ করে আমার গোপন বাক্সের ডালা খুলে বসি। দোলনের দেওয়া ডজন ডজন লাল, নীল, হলুদ, সবুজ কাঁচের চুড়িগুলি টুকরো টুকরো করে গুড়িয়ে ভেঙ্গে ফেলি। ওর দেওয়া কাশ্মিরী সিল্ক নাচের ঘাঘরি, বালুচুরি শাড়ি কাঁচি দিয়ে কুঁচি কুঁচি কেটে ফেলি। আছড়ে ভাঙ্গি আমার ভীষন ভীষন প্রিয় মাটির টেরাকোটা পুতুলগুলি এবং কবিতার ভাষায় আমাকে লেখা শত শত চিঠিগুলি আমি দেয়াশলাই জ্বালিয়ে পোড়াতে থাকি। সেই কাগজ পোড়া গন্ধে ঘর ভরে ওঠে। আমি বুক ভরে শ্বাস টেনে নেই।
আহ কাগজ পোড়া বিভৎস্য দমবন্ধ এক গন্ধ....
আমার ভীষণ হাসি পায়......
তীব্র হাসি......
অট্টহাসি পায় আমার .......
তবুও অবাক হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করি মেঝের উপর চোখের জলে ভেসে যাওয়া এক সাগরের মাঝে......
(চলবে)
একি খেলা আপন সনে- ১৩