আমাকে এ বাড়ি হতে পাকাপাকি বিদায় করবার আয়োজনে মায়ের বেশ তৎপরতা দেখা গেলো। হয়তো উনি এ সুযোগটাকে আর হাত ছাড়া করতে চাচ্ছেন না। আমার থেকে আজীবনের মুক্তির এই মোক্ষম সুযোগ আর পাওয়া যাবেনা বলেই হয়ত সকাল থেকে তার মহা তোড়জোড় শুরু হলো। সকাল আটটা বাঁজতে না বাঁজতেই রুমের দরজায় ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভাঙ্গলো আমার। দরজা খুলতেই দেখি শিউলী দাঁড়িয়ে আছে। সে জানালো মা তাড়াতাড়ি করে নাস্তা খেয়ে গোসল সেরে নিতে বলেছেন। কারণ কিছু পরেই বিউটি পারলারের মেয়েটা আসবে। আমাকে রেডি হতে হবে।
আমি কিছু না বলে তার কথায় সন্মতি জানালাম। শিউলী ফিরে যেতে দরজা বন্ধ করে এসে আমি বারান্দায় দাঁড়ালাম। সাধারণত এত দেরী করে উঠিনা আমি। খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠা আমার ছোটবেলার অভ্যাস। কাল বেশি রাত জাগার কারণেই আজ ঘুম ভাঙ্গতে দেরী হয়েছে। চোখ জ্বালা করছিলো আমার। বারান্দা হতেই দেখলাম রমেশকাকু পরম যত্নে বাগানের হেজে গাঁদা ফুলের চারা লাগাচ্ছন। আমার মনে হয় পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেনো আমি, এই মানুষটা সারাজীবন আমার মনের আরশীতে গাঁথা থাকবে। কি পরম নিষ্ঠায় বছরের পর বছর ধরে ফুল ফুটিয়ে যাচ্ছেন উনি। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি এই বাগানের সাথে যেন অতঃপ্রতঃভাবেই জড়িয়ে গেছেন তিনি আর তার জীবন। আমি আজ পর্যন্ত কোনোদিন উনাকে কাজ ছাড়া দেখিনি। কখনও আগাছা নিড়াচ্ছেন, কখনও বা পাইপে বা ঝাঁঝরিতে করে গাছে পানি দিচ্ছেন, কখনও চারা লাগাচ্ছেন। একনিষ্ঠ নিবেদিত প্রাণ এই রমেশকাকু বাড়িতেও যান না। শুনেছি উনার বাড়ি আসামে। পৃথিবীতে উনার আপনজন বলতে কেউ নেই। উনি নিজে কখনও উনার নিজের কথা বলেন না। জিগেস করলে এড়িয়ে যান। মাঝে মাঝে ভাবি, পৃথিবীতে কত মানুষ থাকে শেকড়চ্যুত।
হঠাৎ দরজায় মায়ের গলা শুনতে পেলাম। আমাকে নাম ধরে ডাকছেন। এ বাড়িতে আসার পর কোনোদিন উনি আমার ঘরে উঁকি দিয়েও দেখেননি। কতদিন উনি আমাকে নাম ধরে ডাকেননি। আজ তার ডাক তাই তার মুখে খুব অদ্ভুত শোনাচ্ছিলো। আমি কান পেতে শুনছিলাম। যতক্ষন শোনা যায়। ইচ্ছে করেই দেরী করছিলাম। দরজা খুলে দিতে দেখলাম মা হাতে একটি গহনার বাক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে তখনও ফ্রেশ না হতে দেখে বেশ বিরক্ত হলেন। ড্রেসিং টেবিলের উপরে গহনার সেটটা রেখে আমাকে তাড়াতাড়ি রেডি হবার তাগাদা দিয়ে গেলেন। কিছু পরেই বিউটি পারলারের মেয়েটা আসলো। তার সামনে আমাকে বসতে হলো পুত্তলিকার মত। মা বলে গেলেন কোথাও যেন বাড়তি মেকআপের আভাস না থাকে। নো লুক মেকাপ হবে। লাইট কালার পিংক লিপস্টিক হবে, পিচ ভেলভেট ব্লাশন, হালকা আইলাইনা। আমি সাধারণত স্টেজ প্রোগ্রাম বা নাচের সাঁজ ছাড়া তেমন সাজি না। আর ক্লাসিক্যাল নাচের সাজ তো বলতে গেলে ভুতুড়ে কাজল, টকটকা ঠোটের রঙ। মায়ের সেসবে দারুন অপছন্দতা। বিউটি পারলারের মেয়েটা প্রায় এক ঘন্টার বেশি সময় নষ্ট করে গোলাপী সোনালী জরিপাড় কাতানে আর মায়ের দেওয়া সেই অদ্ভুত বাতাবী লেবুদানা রং স্টোনের সরু নেকলেস আর ছোট্ট এক পাথরের দুলে যখন আমাকে সাজিয়ে দিলো আয়নায় নিজেকেই চিনতে পারছিলাম না আমি। এ যেন অন্য আমি। একেবারেই অচেনা অজানা কেউ।
ঠিক বারোটায় বের হলাম আমরা। আমরা মানে আমি আর ড্রাইভারচাচু। জীবনে কখনও শুনিনি পাত্রী পাত্রের সঙ্গে দেখা করতে নিজেই রওয়ানা দেন। স্বয়ম্বরা নামে আগের দিনে রাজা রাজড়াদের এক অনুষ্ঠানের কথা শুনেছিলাম যেখানে পাত্রী নিজেই তাদের বর নির্বাচন করতো। ওহ আমার ক্ষেত্রে তো সেটাও হবেনা। আসলে আমি জানি এই দর্শন শুধু মাত্র আমাকেই দর্শন করানো মানে পাত্রের পছন্দ অপছন্দের মূল্য দেওয়া। পাত্র যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটাই হবে ফাইনাল। যদি এমন হয় আমার তাকে পছন্দ আর তার আমাকে নয় তবে সেটা অগ্রাধিকার পাবে না কোনোদিন।
সে যাইহোক, সেদিন বোধ হয় ছুটির দিন ছিলো। রাস্তাঘাটে তখন এমনিতেও এত যানজট ছিলো না। আমি ২৫ মিনিটেই পৌছে গেলাম সেখানে। আমাদের বুকিং দেওয়া ছিলো। যেহেতু সময়ের আগেই পৌছে গেছি তাই আমি ঘুরে ঘুরে পর্যটকদের জন্য সাজিয়ে রাখা জামদানী, রাজশাহী সিল্ক, মসলিন শাড়িগুলি দেখছিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার পিছনেই হঠাৎ "এক্সিউজ মি" শুনে চমকে তাকালাম আমি। বুঝলাম উনিই আরবাজ চৌধুরী। ছবির সাথে তাকে মিলিয়ে নিতে এক বিন্দু কষ্ট হলো না আমার। ভীষন মন ভালো করে দেওয়া চেহারার ৬ ফিট ২ ইঞ্চি উচ্চতার সুপুরুষ আরবাজ চৌধুরীর স্মিত হাসির আড়ালে কি যাদু যে ছিলো জানিনা। মনে হলো উনি যেন আমার অনেক দিনের চেনা। আমি বুঝলাম উনাকে ভরসা করা যায়। উনি আর যাই করুক আমাকে বুঝবেন।
লাঞ্চের তখনও প্রায় আধা ঘন্টা মত বাকী থাকায় উনি আমাকে জ্যুস অফার করলেন। স্বচ্ছ লাল রুবি রঙ পমোগ্রানেট জ্যুস খেতে খেতে আমাদের টুকটাক আলাপ হচ্ছিলো। আরবাজ চৌধুরীর দারুন আগ্রহ শান্তি নিকেতন নিয়ে। একজন খাঁটি শান্তি নিকেতনী মানে আমাকে মিন করে বলছিলেন আর কি তার সাথে কথা বলতেই নাকি দারুন রোমাঞ্চিত হচ্ছিলেন উনি। আরবাজ চৌধুরী বললেন,
-জানেন ছোট থেকেই গান শেখার দারুন শখ ছিলো আমার। কিন্তু গান গাইতে গেলেই গলা দিয়ে বের হত কা কা । এক কথায় আমাকে কাক কন্ঠি বলতে পারেন। ওহ কন্ঠি তো মনে হয় স্ত্রী লিঙ্গ তাই না? তবে কি আমাকে এটা বলতে গেলে কাক কন্ঠ বা কাক কন্ঠা বলতে হবে?
আমার ভীষন হাসি পাচ্ছিলো তার এইসব কথা শুনে। তবে তার সাবলীল কথা বলার ধরণে, দারুন বুদ্ধিদীপ্ত এবং পরিমিত আচারে ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম। তার কথা বলার ফাঁকে ফাঁকেই খেয়াল করলাম তিনি চলনে বলনে পোষাকে আশাকে দারুন রুচীশীল। ভীষন ঝকঝকে তকতকে আরবাজ চৌধুরীর গোল্ডরিমের চশমার আড়ালে চোখদুটি হীরকখন্ডের মতনই দ্যুতি ছড়াচ্ছিলো। তার ব্যাকব্রাশ করা চুলের নীচের উঁচু কপালে যেন পরম সৌভাগ্য আর সফলতার রাজটিকা আঁকা আছে। এক নজরে ভীষন ভাগ্যবান একজন সফল মানুষ মনে হয় উনাকে। ভাবছিলাম উনার মত একজন লোক কি করে আমার মত ব্রোকেন ফ্যামিলীর বা অন্যের বাড়ি বা মায়ের দ্বিতীয় হাসব্যান্ডের বাড়িতে বাস করা একটি মেয়েকে বিয়ে করতে আগ্রহী হলেন? উনি কি আমার সম্পর্কে সত্যিই কিছু জানেন? মনে পড়লো মায়ের সাবধানবাণী " গর্ধবের মতন যেন তোমার সাত কাহন বলতে বসো না তাকে। অনেক ভাগ্য করলে এমন ছেলে পাওয়া যায়।" চমকে উঠলাম আমি! তবে কি মা তার ছয় কিংবা আটকাহনটি এই মানুষটির কাছে গোপন করেছেন? হয়তো কিছুক্ষনের জন্য ভাবনার জালে অন্য কোথাও হারিয়ে গিয়েছিলাম। উনার কথায় সম্বিৎ ফিরলো। উনি বললেন,
- আপনি কি কিছু ভাবছেন? আপনাকে বেশ চিন্তিত লাগছে। আচ্ছা সত্যি করে বলেন তো আমি কি দেখতে মাংকি বা ইয়েতীর মত?
উনার কথায় হেসে ফেললাম আমি। উনি বললেন,
- আপনার হাসিটা দারুণ সুন্দর! আমি মনে হয় লজ্জা পেলাম কারণ উনি তখনি বললেন,
- জানেন কত নীল নয়না, সুলোলিতা, কিন্নরী সুহাসিনী, সুভাষিনী বিলোল চাহনী আর ভ্রু বিলাসে তাকিয়েছে আমার দিকে। তবুও তাতে এতটুকু মন দোলেনি আমার। কেনো জানেন?
আমি তখন এই উচ্চশিক্ষিত মানুষটি যার জীবনের প্রায় অর্ধেক নিজ দেশের বাইরে কেটেছে এমন পলিশড মানুষের মুখে এমন বাংলা শুনে হা হয়ে গিয়েছি। হা করেই বুঝি তাকিয়ে ছিলাম। তিনি বললেন কি হলো? এমন অবাক হয়ে চেয়ে আছেন কেনো? শুনবেন না কেনো তাদের কোনোরুপ আকর্ষনেই আকর্ষিত হইনি আমি? আমি হা করা মুখ বন্ধ করে বললাম,
- হ্যাঁ শুনবো... উনি বললেন,
- কারণ সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি। আমার এই দেশ, এই দেশের মানুষ এবং এই দেশের লজ্জা অবনিতা মুখের নারী।
রোগ শোক ব্যাধিতে স্নেহময়ী, রেগে গেলে রণচন্ডিনী, এক হাতে ড্রাইভিং স্টিয়ারী আরেক হাতে ঝাল ঝাল গরুর মাংস রন্ধন পটিয়সী এর চাইতে সুন্দর কিছু, আর কি হতে পারে এই পৃথিবীতে বলেন? এই যে আপনার হাসির প্রশংসা করতে আপনি লজ্জা পেলেন জানেন সেই আবীর ছড়িয়ে গেলো আপনার দু' গালে...সেই সৌন্দর্য্যের কাছে সৌন্দর্য্যের দেবী ভেনাসও তুচ্ছ ....
আরবাজ চৌধুরী যে ভীষন বাকপটু এবং শুধু বাকপটুই নয় একেবারেই অন্যরকম মার্জিত ব্যাক্তিত্বের মানুষ তা বুঝে নিতে কারো দু মিনিটের বেশি সময় লাগবেনা। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত উনার কথা শুনছিলাম। উনার রিটায়ার্ড পোলিশ অফিসার রাগী বাবা, উনার স্নেহময়ী মা, ভীষন ভালোবাসার বড় বোন, দুলাভাই তাদের বাচ্চাদের কথা। শুনতে শুনতে বুঝতে পারছিলাম এবং চোখের সামনেই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম এক সুখী ও সমৃদ্ধশালী পরিবারের চিত্র। তবে উনার সবচেয়ে ভালোবাসার ও মায়ার মানুষটি যাকে পারলে উনি হয়তো তার জীবনের বিনিময়েও সকল সুখ ও আনন্দ এনে দিতে চাইতেন সে তার ২০ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী ছোট ভাইটি। ভাইটির কথা বলতে গিয়ে উনার মুখে যে কষ্টের ছাঁপ ফুটে উঠতে দেখলাম তাতে বুঝলাম পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষের কিছু বিশেষ কষ্ট থাকে যা সে বহন করে চলে সারাটাজীবন বুকের মধ্যে একা একা। যা চাইলেও অন্য কেউ ছুঁয়ে দেখতে পারে না হয়তো, তা থাকে তার একান্ত নিজেরই হয়ে।
ফিরে আসার সময় উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার সামনে আনলেন ছোট, বড় ও মাঝারি আকারের অসাধারণ সৌন্দর্য্যে র্যাপিং করা চারটি গিফট বক্স। আমি আবারও অবাক হলাম। আমার মনে হচ্ছিলো এসবের যোগ্য তো আমি নই অথচ এই মানুষটি আমাকে একের পর এক অবাক করেই চলেছে। এই অসাধারণ মানুষটি তার অসাধারণ হৃদয়ে লালিত করেছে এক অজানা অনাবিল স্বপ্নের যার যোগ্য আমি নই। আমার চোখে পানি এসে গেলো।
সেই অবাধ্য চোখের জল লুকিয়ে কোনোমতে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ফিরে আসার সময়টিতেও গাড়ির দরজা খুলে দিলেন আরবাজ চৌধুরী কিন্তু আমি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রইলাম। কোনো রকম বিদায় সম্ভাষন ছাড়াই চলে এলাম তড়িঘড়ি চোখের জলটুকু লুকাতেই।
জানিনা উনি কি ভাবলেন আমাকে......
চরম অভদ্র বা পাগলই বোধ হয়........
(চলবে)
একি খেলা আপন সনে - ১৪
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:২২