ফেরার পথে আমি ম্যুভেন পিকের আইস্ক্রিম পারলারটাতে থামলাম কিছু সময়ের জন্য। উদ্দেশ্য আইসক্রিম নয় আসলে বাড়ি ফিরে যাবার আগে আমি কিছুটা সময় নিজের মত কাটাতে চাচ্ছিলাম। নিজের মত করে ভাবতে চাচ্ছিলাম। ওদের দোতলার বড় উইন্ডো গ্লাসটার ধারে এক বাটি বাটারস্কচ আইসক্রিম নিয়ে বসলাম আমি, কিছুটা নিজের মত সময় কাটাতেই। নীচে চলমান রাজপথে তখন ব্যাস্ত নগরীর ছবি। একের পর এক গাড়ি ছুটে চলেছে অবিরাম। ছোট ছোট একদল ফুলশিশুরা ঘিরে ধরেছে এক বিদেশিনীকে। বিরক্ত করছে ফুল নেবার জন্য। আমাদের দেশী কাউকে এইভাবে বিরক্ত করলে তার ফল ভালো হত না ওদের জন্য। কিন্তু এই বিদেশী রমনী হাসি মুখে ওদের কথা শোনার ও বুঝার চেষ্টা করছেন। পাশে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে হাসছে পানওয়ালা । তার জন্য বিদেশিনীর এই এক দঙ্গল শিশুদের কাছে বিব্রত হবার দৃশ্যটা যেন বড়ই মজার।
ভাবছিলাম আমি, আরবাজ চৌধুরীর কথা। কি অমায়িক নিপাট একজন ভদ্রলোক। এতগুলো বছর বিদেশে কাটিয়েও বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসার টান এক বিন্দু কমেনি তার। জীবনসঙ্গিনী হিসাবেও পেতে চান কোনো বাঙ্গালী ললনাকেই। কথা বার্তা আচার আচরণে চৌকশ ও কেতা দুরস্ত একজন মানুষ। অথচ মানুষকে আপন করে নেবার যেন এক আশ্চর্য্য ক্ষমতা রয়েছে তার। পাত্র হিসাবে তিনি এক নাম্বারের আরও অনেক বেশি উপরেই থাকবেন। যে কোনো মা বাবাই লুফে নেবেন তাকে তাদের কন্যার জন্য। যে কোনো পাত্রীরও বুঝি তাকে ফেরানোর ক্ষমতা বা দুঃসাহস কোনোটাই হবে না। কিন্তু আমি! আমি কি করবো? আইস্ক্রিমের বাটিতে বাটার স্কচ গলতে থাকে। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি দূরে। আশে পাশে কাপলদের ভীড় বাড়তে থাকে। টুং টাং বাটি চামচের আওয়াজ, মৃদু কথন, হাসাহাসি ভেসে বেড়ায় আমার চারপাশ ঘিরে। আমাকে একা একা এইভাবে বসে থাকতে দেখে অনেকেই আমার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। তাকাবার কারণ হয়তো এই একা একা বসে থাকাটাই না, আসলে এমন আনউইজ্যুয়াল পোষাক আশাকে এখানে কেউ আইসক্রিম খেতে আসেনা। আমি ভেবে কোনো কূল কিনারা পাইনা। কি করবো আমি? বাড়ি ফিরে মা যখন জিগাসা করবেন কি জবাব দেবো তার?
সন্ধ্যার অনেক পরে বাড়ি ফিরি আমি। মাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। চুপচাপ নিজের ঘরে ফিরে আসি। পোষাক পালটে হাত মুখ ধুঁয়ে বিছানায় পা তুলে বসে ভাবতে থাকি। আরবাজ চৌধুরীর কথা। আজ সারাদিনের দৃশ্যচিত্র আমার চোখের সামনে সদ্য দেখা কোনো জলজ্যান্ত ম্যুভির দৃশ্যের মতই ভাসতে থাকে। বিছানার উপর পড়ে আছে সেই ছোট বড় মাঝারি চার রকমের চারটি গিফ্ট বক্স। মনে হয় শিউলিই রেখে গেছে। উপহারগুলো ঝাঁ চকচকে গোল্ডেন র্যাপিং পেপারে মোড়ানো হয়েছে খুব সুনিপুনভাবে। আমার মনে হঠাৎ প্রশ্ন জাগে আচ্ছা আরবাজ চৌধুরী কি শুধু আমাকেই পাত্রী নির্বাচন করেছেন নাকি উনি বিয়ের উদ্দেশ্যে দেশে এসে একের পর এক মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছেন? তাই যদি হয় তবে কি উনি সব কটি পাত্রীকেই এই ভাবে ছোট বড় মাঝারি ও গোল্ডেন পেপারে মুড়িয়ে উপহার দিয়ে যাচ্ছেন? আমার মাথায় নানা প্রশ্ন খেলা করতে থাকে। কোনোটারই উত্তর পাই না আমি। আচ্ছা কে এই আরবাজ চৌধুরী? কোথায় পেলেন মা একে? মায়ের কাছে কিছু প্রশ্ন এবার করতেই হবে আমাকে। আমি রাতে কিছু খাবো না বলে ঠিক করলাম। আমি না খেলে যে কেউই আমাকে ডাকতে আসবেনা সে বেশ জানি। কিন্তু আজ শিউলী এলো। বললো, খালাম্মা আপনাকে ডিনারের পরে উনার রুমে ডেকেছেন। আপনার সাথে জরুরী কথা আছে নাকি।
আমি বললাম, মাকে বলে দাও, আমি রাতে খাবো না। আজ রাতে আমি কথাও বলতে পারবোনা কারো সাথে। যা বলার কালকে বলবো। কাল সকালে।
এতগুলো কথা বলে আমি নিজেই অবাক হচ্ছিলাম। কোনোদিন আজ পর্যন্ত মায়ের অমতে বা মায়ের মুখের উপরে আমি কোনো কথা বলিনি। তার ইচ্ছা অনিচ্ছার বিরুদ্ধে যাইনি। আজ প্রথম আমি মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বললাম। এই কাজটার জন্য আমার ভেতরে এক আনন্দ হচ্ছিলো। কেনো সেই আনন্দ আমি ঠিক জানিনা। শিউলী চলে গেলো।যাবার আগে আমি ওকে লাইট অফ করে দরজা লক করে দিয়ে যেতে বললাম। গোল্ডেন পেপার মোড়ানো গিফটগুলি বেডের এক সাইডে ঠেলে দিয়ে। আমি শুয়ে পড়লাম। হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিলের উপর নীল ডিমলাইটের বেড সাইড ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে সেই ছোট্ট বেলার দিনগুলো, আমার আসল বাবার বাড়ি থেকে শুরু করে নানা কথা নানা দৃশ্য ফ্ল্যাশব্যাকের মত ভাবতে শুরু করলাম। এ আমার এক মজার খেলা। প্রায় প্রতিদিনই আমি ঘুমুতে যাবার আগে আমার শৈশব, কৈশোর, অতীত এবং এসবের ব্যাথা বেদনা আনন্দ ভালোবাসা ভালো লাগা নিয়ে ভাবি। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি। আমার ভাবনা চিন্তার ডালপালা যে এত বেশি প্রসারিত যে মাঝে মাঝে আমি অতীতের সাথে সাথে ভবিষ্যতও চলে যাই। আর এই ভাবনার পাখায় ভাসতে ভাসতে ভবিষ্যৎ বা ব্যাক টু দ্যা ফিউচারে যখনই হারাই, নিজেকে আমি দেখি এক অদ্ভুত জগতে। সেই স্বপ্নে আমি বেগুনী কিংবা সবুজ সূতি জরিপাড় শাড়ী টান টান করে পরা কোনো এক নিবেদিত প্রান সমাজকর্মী টাইপ কাউকেই দেখি যেটা কিনা আমি নিজেই। এই রকমটা আমি স্বপ্ন ছাড়া জেগে থেকে কখনই ভাবি না। স্বপ্নের নাকি রঙ নেই শুনেছি কিন্তু স্বপ্নে আমি লাল নীল হলুদ সবুজ কিংবা কমলা রঙের জরিপাড় শাড়িতে নিজেকে ঠিকই দেখতে পাই।
জানিনা কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম ভাঙ্গলো ফোনের শব্দে। এত রাতে কে ফোন করছে? মনে পড়ে সেই আমলের বিশাল সেলফোনটা বিছানার মাথার কাছে ভুতুড়ে আমেজে দপ দপ করে জ্বলছিলো, নিভছিলো। আমি ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো আরবাজ চৌধুরীর পরিশিলীত সুমার্জিত কন্ঠস্বর।
-স্যরি। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?
আমি ঘুম থেকে উঠে থতমত খেয়ে কি বলবো না বলবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আর তাছাড়া সন্ধ্যা থেকে ঘুমাচ্ছি। কতটাই বা বেজেছে কে জানে! আমি বললাম না মানে, খুব ক্লান্ত লাগছিলো তাই....আমাকে থামিয়ে দিয়ে উনি বললেন,
-আসলে আমি নিজেই এত রাতে কেনো ফোন করে বসলাম জানিনা। এটা খুবই অভব্যতা হলো হয়তো। কিন্তু একটা কথা বলতে আপনাকে এই অসময়ে আপনাকে ফোন দেওয়া। আমি আসলে কোনো কথা চেপে রাখতে পারিনা এবং স্পষ্ট করে বলতেই ভালোবাসি। হঠাৎ মনে হলো আপনাকে আমার বলা হয়নি-
আরবাজ চৌধুরী থমকালেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন,
- আমি যা বলতে এত রাতে আপনাকে ফোন দিয়েছি মানে যে কথাটা আজ আপনাকে আমার বলা হয়নি সেটা হলো, আমি ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম আপনি ঠিক সেই মেয়েটিই।
আমি মৃদু চমকালাম। আরবাজ চৌধুরী বলে চলেছেন,
- দেখেন সারাজীবন পড়ালেখা নিয়েই কাটিয়েছি। যদিও কলেজে আমি সেরা তার্কিক ছিলাম, টেবিল টেনিসেও চ্যাম্পিওন খেতাব পেয়েছি তবুও এই পড়া পড়া করেই কোনোদিন কোনো মেয়ের দিকে ফিরে তাকাবার সময় হয়নি আমার। তবুও মনের মাঝে একটি আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিলো। সেই স্বপ্নে যেই মেয়েটিকে আমি মনের মাধুরী মিশিয়ে এঁকেছি সে হুবুহু আপনিই। আপনি যাবার পরেও আপনার ছবি আমি মন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। আপনি কি জানেন বিধাতা সবচেয়ে সুন্দর করে আপনার কোন জিনিসটি গড়েছেন? সে আপনার এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দু'টি হাত। ঐ অদ্ভুত সুন্দর হাত দু'টি দিয়ে পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করা যায়। ঐ যাদুকরী হাত একটাবার কারো কপালে রাখলে যে কারো অসুখ সেরে যাবে। আপনি ঠিক আমার মনের মতন। কল্পনায় আমি যে মেয়েটিকে নীল শাড়ি এবং রেশমী চুড়িতে সাজিয়েছি, সে আপনি ছাড়া কেউ নন।
আমি চুপচাপ শুনছিলাম। আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছিলো। হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি। আরবাজ চৌধুরী বেশ অবাক হলেন। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। বার বার জানতে চাইলেন। উনি উনার অজান্তে কোনো দুঃখ দিয়ে ফেলেছেন কিনা। যদিও মা বলেছেন তাকে আমার কোনো সাত কাহনই না জানাতে তবুও এই অসম্ভব কাজটি কোনোভাবেই আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আরবাজকে আমি সব জানাবো। আমার অতীত, আমার লড়াই, আমার হার, জয় কিংবা পরাজয়। সবই জানাবো আমি তাকে। নিজেকে সামলালাম। উনার থেকে ১০টা মিনিট চেয়ে নিলাম নিজেকে ধাতস্ত করবার জন্য।
চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে ছাঁদের সিড়ি বেয়ে ছাঁদে চলে এলাম ঐ অত রাতে একা একা। রাতের আকাশে সেদিনও চাঁদ ও চকোরের খেলা। হিম হিম বাতাসের শীতল পরশে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছিলো। আমি রেলিং এর আলসে ঘেসে বসে ফোন দিলাম উনাকে। ফোন ধরেই উনি বললেন,
- ১০ মিনিটের কথা বলে তো পৌনে এক ঘন্টা কাটিয়ে দিলেন। আমি তো ভেবেছিলাম ফের ঘুমিয়ে পড়লেন।
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম,
- না না ঘুমাইনি। আসলে সন্ধ্যা থেকে ঘুমাচ্ছিলাম তো.....
আসলে আমার খুব লজ্জা লাগছিলো কিছু আগে উনার সামনে মানে ফোনে কেঁদে ফেলার কারণে। এটা কিছুতেই আমার ঠিক হয়নি। নিজেকে অপরাধী লাগছিলো। বেচারা কত স্বপ্ন নিয়ে....অথচ আমি.....আমাকে অবাক করে দিয়ে সেসবের কিছু জিগাসা না করেই আরবাজ বললেন,
- একটা গান শুনাবেন? আমি রাজী হয়ে গেলাম। কারণ এই মুহুর্তে তার সাথে কথা চালানোর চাইতে বরং এই কাজ অনেক সহজ। কিন্তু কি গান শোনাবো? সাত পাঁচ কিছু না ভেবেই আমি গান গাইতে শুরু করলাম,
আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো।
সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে--ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত।
সে চলে গেল, বলে গেল না-- সে কোথায় গেল ফিরে এল না।
সে যেতে যেতে চেয়ে গেল কী যেন গেয়ে গেল--
তাই আপন-মনে বসে আছি কুসুমবনেতে।
আমি থেমে গেলাম। কিছু আগেই কান্নার কারণে আমার গলা ধরে আসছিলো তবুও সেসব উপেক্ষা করেই আমি গাইছিলাম। আমি থেমে যাওয়ায় উনি উতলা হয়ে উঠলেন। বললেন, প্লিজ থামবেন না। পুরো গানটা শোনান.... আমি আবার শুরু করলাম সেই ধরে আসা গলাতেই।
সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে, চাঁদের আলোর দেশে গেছে,
যেখান দিয়ে হেসে গেছে, হাসি তার রেখে গেছে রে--
মনে হল আঁখির কোণে আমায় যেন ডেকে গেছে সে।
আমি কোথায় যাব, কোথায় যাব, ভাবতেছি তাই একলা বসে।
সে চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল ঘুমের ঘোর।
সে রাণের কোথায় দুলিয়ে গেল ফুলের ডোর।
কুসুমবনের উপর দিয়ে কী কথা সে বলে গেল,
ফুলের গন্ধ পাগল হয়ে সঙ্গে তারি চলে গেলো
হৃদয় আমার আকুল হল, নয়ন আমার মুদে এলে রে--
কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে॥
মধ্যরাত্রীর হিম হিম শীতল বাতাস তখন বেশ জোর হাওয়ায় রূপ নিয়েছে। উতল বাতাসে শন শন হাওয়া। আমার গানের প্রতিটি চরণ, কথা ও বাণী খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ছিলো সেই মধ্যরাত্রীর ক্ষন প্রহরে।
গান শেষ হলো। বেশ কিছুক্ষণ মৌন নীরবতায় কেটে যাবার পরে আরবাজ চৌধুরী জিগাসা করলেন,
- তুমি তাকে ভুলতে পারোনি না?
আমি চমকালাম......
ভীষণ চমকালাম আমি......
(চলবে)
একি খেলা আপন সনে- ১৫
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১৪