বেঁচে থাকতে আমি প্রায়ই তাকে বলতাম,
- দেখো, আমি মরলে স্বপ্নেও দ্বিতীয় বিয়ের চিন্তা মাথায় এনো না। একবার যখন তোমার হাত ধরে বাপের বাড়ি ছেড়েছি তখন এই জনমে মরণে তোমাকে আমি আর ছাড়ছি না। এই কথা শুনে রমি হাসতো। বলতো,
- ভূত হয়েও ছাড়বি না? আমি বলতাম,
- ঠিক তাই। রক্ষা নেই তোমার। একদম ভূত হয়ে ঘাড় মটকাবো যদি তোমার পাশে আর কাউকে দেখি..
কথাগুলো বলার সময় মজা করে বললেও সেই আমি সত্যিই ভুত হয়ে গেলাম। তবে আমি আমার কথা রেখেছি, ভূত হয়েও আমি রমিকে ছেড়ে যাইনি। যেদিন এক পশলা বাক বিতন্ডার পর রমি রাগে গজরাতে গজরাতে অফিস চলে গেলো আর আমি চোখের জল মুছতে মুছতে বাজারের দিকে চললাম। চরম অসাবধানতায় ইষ্টার্ণ প্লাজার সামনের রোড পার হচ্ছিলাম। চোখ ভর্তি পানি চারপাশ ঝাঁপসা করে দিচ্ছিলো আর মাথার ভেতর রাগের ভূত আশাপাশ ভাবতে দিচ্ছিলো না। সে যাইহোক, গন্তব্য ছিলো হাতিরপুল কাঁচাবাজার। হঠাৎ কোথা থেকে এক বাস এসে আমার মাথাটা থেৎলে দিয়ে গেলো। তখন প্রায় বেলা দশটা হবে। চারিদিকে ঝকঝকে সকালের কর্ম চঞ্চল দিনের শুরু। আর প্রায় এই সাত সকালে রাগের বশে অসাবধানতায় আমাকে বেঘোরে প্রাণটা দিতে হলো। দুপুর নাগাদ ঢাকা মেডিকেলের এক বারান্দায় পড়ে ছিলাম তারপর দেখলাম রমিত আসছে। উদ্ভ্রান্ত চেহারা, উস্কখুষ্ক চুল, এক রকম ছুটতে ছুটতেই আসলো সে। তারপর হাউ মাউ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
আমি খুব অবাক হলাম। রমিত যে আজও আমাকে এত ভালোবাসে মরে যাবার এক সেকেন্ড আগেও আসলে আমি জানতাম না বরং দিনে দিনে ওর আচরণ নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছিলো আমার মনে। যখন তখন ওদের সেই পুরনো ভাঁড়াটে শীলার সাথে রমিতের উচ্ছসিত ফোনালাপে রাগে, ক্রোধে, ঘৃনায় জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি । ধ্যাৎ ভুলই বুঝেছিলাম হয়ত। নইলে কে রাগের বসে চোখ মুখ আঁধার করে অসাবধানতায় বাসের তলে পড়ে মরতে যায়? নিজের উপর ভীষন বিরক্ত হওয়া শুরু হলো।
বেশ কিছুদিন যাবৎ কোথা থেকে এই উটকো আপদ জুটেছিলো। দিন নেই, রাত নেই, সকাল নেই, বিকাল নেই হুটহাট টেলিফোন। হা হা হি হি আবার ফোনে আমাকেও ডেকে নিয়ে সে কি রঙ ঢঙ করে ইনিয়ে বিনিয়ে এ কথা সে কথা বলা। গা জ্বলে যেত আমার। প্রথম দিকে কিছু বলিনি কিন্তু দিনে দিনে উৎপাত বাড়তেই রমির সাথে আমার কথা কাঁটাকাঁটি শুরু হলো,
- কে এই শীলা? আগে তো নাম শুনিনি...
- আরে আমাদের পুরোনো ভাড়াটিয়া আমি তখন ক্লাস নাইন আর সে পড়তো ক্লাস টেনে। ক্লাসের দিক দিয়ে আমার চাইতে এক বছরের বড় হলেও আসলে আমরা সমবয়সীই।
-মানে! পরম বিস্ময়ে হতবাক আমি। বিস্ময়ের কারণটা রমির উচ্ছাস দেখে। আমি ছাড়াও আর কোনো মেয়েকে উনি এমন আসমানে উঠাতে পারেন জানা ছিলো না আমার। যাইহোক রমি যোগ করে,
-জানোই তো আমি পড়ালেখায় চিরকালই ডাব্বা। মানে করতাম না আর কি। তো ক্লাস এইটে ফেল করায় ওর চাইতে এক ক্লাস নীচে পড়ে যাই। কিন্তু শীলা ছিলো অসাধারণ মেধাবী। সে হেন করতো, তেন করতো, নাচতো গাইতো.... হে হে হে .... রাগে আমার মাথা ঘুরতে থাকে। তবুও প্রথম প্রথম কিছু বলিনি। পরে ক্রমান্নয়ে তাদের পুরান প্রেম জেগে ওঠা দেখে এবং গভীর থেকে গভীরতর হবার সম্ভাবনায় আমি চিন্তায় পড়লাম। এক কথা দুই কথায় চরম গন্ডগোল লেগে গেলো রমির সাথে-
- আজ তুমি ঐ মেয়েকে নিষেধ করে দেবে যেন জীবনে আর তোমাকে ফোন না দেয়....
- বারে! এই কথা বলবো কিভাবে?
- এহ রে নেকা! এই কথা বলবো কিভাবে? জানেন না এই কথা বলবেন কি ভাবে? ভূতের মতই বুঝি ভেংচে উঠি আমি...
- কিভাবে আবার! তোমার মুখ নাই? তুমি কথা বলতে জানোনা? তুমি কি বোবা? নাকি কালা? দেখো ধানাই পানাই বন্ধ করো। আজকের মধ্যে তুমি যদি ঐ মুখপুড়ি ভুতনীকে নিষেধ না করো তো তোমার একদিন কি আমার একদিন। নির্লজ্জ, বেহায়া কুকুর? বাড়িতে বউ রেখে দিন রাত অন্য মেয়ের সাথে ফোনাফুনি না? ইশ বুড়াকালে উনার পুরান প্রেম উথলে উঠেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা উনি প্রাক্তন কোন শাকচুন্নীর সাথে হে হে করছেন। এক নাগাড়ে এত কিছু বলে আমি হাঁপাতে থাকি। রাগে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
কিন্তু হাজারও লাঞ্ছনা গঞ্জনার পরেও রমিত থামে না বা থামতে পারে না। এরপর বাড়িতে ফোন আসা বন্ধ হয় ঠিকই কিন্তু আমি ঠিকই খবর পেয়ে যাই ওদের অফিস এসিস্ট্যান্ট লায়লার কাছে। রোজ দুপুরেই নাকি রমির কোন এক বান্ধবী ফোন দেয় তার অফিসে। আমার সন্দেহ তখন প্রায় প্রমানিত। রাগে দুঃখে আমি পাগল হয়ে যাই। নিজেকে বড় ছোট লাগে। অথচ রমিকে ভালোবেসে আঠারো বছরের জন্মদিনের দিন এক কাপড়ে ওর হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিলাম। বরিশাল থেকে সোজা ঢাকা। পুরনো জীবন থেকে পালিয়েই যাওয়া এক রকম। অবশ্য আমার ভীষন বদরাগী বাবা বা মা কিংবা ও পরিবার থেকে কখনও আমাকে কেউ খুঁজতেও আসেনি। রমিতের জন্য আমাকে আমার নিজের পরিবারকে এক রকম বিসর্জনই দিতে হয়েছিলো। তার এই পরিণাম! অসহায় লাগে নিজেকে বড়।
এই নিয়েই সেদিন সকালে তুলকালাম হয়ে গেলো। আমার অসহনীয় বাক্যবাণে, কুকুর বিড়াল শিয়াল হতে শুরু করে হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্চা, রাস্তার মেল প্রস্টিটিউট শোনার পরে রমি আর সইতে পারলো না। নাস্তার প্লেট ছুড়ে মারলো সজোরে। সেই প্লেট দেওয়ালে লেগে খান খান হয়ে পড়লো মেঝের উপর। পরোটা ভাঁজি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখানে ওখানে। আমি রাগে অন্ধ হয়ে গেলাম। ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওর উপরে। রমি আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে অফিস চলে গেলো। বহুক্ষন কাঁদলাম আমি। দরজা খোলাই পড়ে রইলো। এরপর কিছু একটা হেস্তনেস্ত করবোই সিদ্ধান্ত নিয়েও বাজারের পথে পা বাড়িয়েছিলাম। কিন্তু কিছু একটা হেস্তনেস্ত করবার আগেই জীবনটাই শেষ হয়ে গেলো।
যাই হোক, সে সব এখন অদূর অতীত। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো। সব ঝামেলা চুকে বুকে যাবার পরে রমির সাথে সাথে আমি একই গাড়িতে চড়েই বাড়িতে এলাম। আহা আমার সাজানো সংসার। জানালায় হালকা নীল পর্দা দোল খাচ্ছে জানালায়। বারান্দায় দোলনচাঁপা ফুটেছে। আজ বিকেলে টবে পানি দেওয়া হয়নি। ঘরের জানালা দরজাও বন্ধ করা হয়নি। একটু পরেই মশা ঢুকবে। দূর কেনো যে মরতে গেলাম! মরে গিয়েও হাজারটা চিন্তা মাথায় ঘুরতে লাগলো। আমার বিরক্তি কমলো না। এই কারণেই বলে, সংসারের মায়া কাটানো বড়ই কঠিন। কারো মৃত্যুর পর পত্র পত্রিকায় লেখা হয় জগতের মায়া কাঁটিয়ে চলে গেছেন। যাইহোক, এদিক ওদিক তাকিয়ে এই অশরীরি শরীরটা নিয়ে আমি টুপ করে এসি বসানোর ফোঁকরটার মাঝে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। সেখান থেকেই দেখতে লাগলাম চারিদিক।
রমি দুহাতে মাথা চেপে সোফার উপর বসে আছে। ওর অফিসের দু এক জন ওর সাথে আজ রাতে থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু রমি রাজী হয়নি। এই অবস্থায় কারো একা থাকা উচিৎ নয় বলে তারা গাঁইগুঁই করেছিলো কিন্তু রমিতের আপত্তিতে পরে হাল ছেড়েছে। আমি উড়ে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। গাঁয়ে ঠেস দিয়ে বসলাম। রমি কিছুই বুঝলো না। হায়রে বুঝবে কেমনে! মরে গিয়ে তো আমি বাতাস হয়ে গেছি। আমার শরীরের আর কোনো অস্তিত্বই নেই। তবে মরে যাই আর যাইহোক এইভাবে হালকা শরীরে বাতাসে ভেসে বেড়ানোও এক নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা বেশ মজারও। আহা ছোটবেলায় পাখির মত আকাশে ভাসতে কতই না সাধ জাগতো মনে। তখন কি আর জানতাম মরে ভূত হলেই এইভাবে পাখী কিংবা পরীর মত ওড়া যায়?
যাইহোক রমিত উঠে গিয়ে কিচেনের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়েছে। বেসিনে সকালের ভাঙ্গা কাঁচের প্লেটের টুকরোগুলি। সেখান থেকে একটি টুকরো হাতে নিয়ে রমি আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। পুরো বাড়িতে হাউ মাউ সেই কান্নার শব্দ বড় ভূতুড়ে লাগছিলো। আমার ভীষন মায়া হচ্ছিলো। ভীষন মন খারাপ করে বসে রইলাম আমি। ইচ্ছে হচ্ছিলো ওকে দুহাতে জড়িয়ে রাখি। কিন্তু হায়! ভুতেদের হাত থাকে না...
দুখী চোখ আর মন নিয়ে আমি অক্ষমের মত রমির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছুর করার ছিলো না আমার। হঠাৎ চোখ পড়ল টেবিলের উপরে সাইলেন্ট করা ফোনের আলো জ্বলছে। ফোনে শীলার নাম। দেখেই মেজাজটা বিগড়ে গেলো। যাইহোক যদিও মনে প্রাণে চাইছিলাম ফোনের আলো রমির চোখে না পড়ুক তবুও ফোনের আলো জ্বলা বিপ বিপ দৃশ্যটা রমির চোখে ঠিকই পড়ে গেলো। রমি ফোন রিসিভ করলো। আমি ওর পাশে গিয়ে ফোনে কান পাতলাম,
- আমি খবরটা শুনেছি রুম। আজ দুপুরে তোমার ফোন অফ ছিলো তাই অফিসে ফোন দিতেই অফিসের মেয়েটা বললো এই দুঃসংবাদটা। মন খারাপ করো না রুম, তুমি শক্ত হও রুম।
রুম! রুম! আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো, মুখ হা হয়ে গেলো! মানে যদি বেঁচে থাকতাম তাই হত। এখন তো মুখ চোখের বালাইও নেই। সে যাইহোক শিলার ঐ নেকা নেকা রুম রুম শুনে আর রমিতের প্রশ্রয় দিয়ে চুপ করে শুনে যাওয়া দেখে আমি আর পারলাম না। ওর কানটা থেকে ফোন নিয়ে সর্বশক্তিতে আছড়ে ফেললাম মাটিতে। ফোনটা টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। রমি চমকে উঠে পরম বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো।
- বঁদমাইশ মেঁয়ে আঁমি মঁরেছি তাঁই মঁনে ফূঁর্তি লেগেছে নাঁ! এঁইবার দেঁখাবো মঁজা। হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ
আমার খোনা গলায় হাসির শব্দে প্রথমে বিস্মিত হয়ে ভীত চোখে তাকিয়ে থাকলেও পরমুহুর্তেই রমি অট্টহাস্যে ফেটে পড়লো।
- হা হা হা হা হা তাইলে তুই তোর কথা রাখলি। ভূত হয়েও ছাড়লি না আমাকে? হা হা হা হা হা হা। পরম নিশ্চিন্তে শূন্যে চোখ মেলে রমি প্রশ্ন করলো। আমি বললাম,
- তোঁমাকে ছাঁড়িনি বঁটে তঁবে তোঁমার সঁর্ববিদ্যাধরী, মোঁহিনী, যোঁগিণী, মোঁহমায়ারুপিনী, কাঁলনাগিণী শীঁলার ভঁবলীলা সাঁঙ্গ কঁরে ছাঁড়বো এঁইবার...... হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ
এ কথা শুনে রমি আরও জোরে হাসতে শুরু করলো। সাথে আমিও।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১১:২৩