somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়বো না (ভূত সিরিজ -২)

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুযোগটা যে এত তাড়াতাড়ি এসে যাবে তা আমি কল্পনাও করিনি। মরেছি আজ তিন দিনও হয়নি এরই মাঝে শয়তান্নীটা বাড়িতে এসে হাজির। আজ দুপুরের পর সবে বিকেল নেমেছে। আমিও সবে মাত্র জানালার আলসীতে পা ঝুলিয়ে বসে বসে বড় রাস্তাটা দেখছি। বেডরুমের এই জানালাটা বেঁচে থাকতেও আমার বড় প্রিয় ছিলো। প্রায়ই এই জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি বড় রাস্তায় ছুটে চলা গাড়িগুলি দেখতাম। পার্থক্য শুধু তখন ছিলাম জানালার ভেতরে আর আজ জানালার বাইরে। এখন আমি মুক্ত বিহঙ্গ। চাইলেই শুধু জানালার বাইরে ঝুলেই থাকতে পারি তাই নয়, সোজা উড়ে গিয়ে বড় রাস্তার গাড়ি বা বাড়িগুলির ছাঁদে গিয়েও চড়তে পারি। তবে বাসা ছেড়ে আমি আগেও তেমন একটা বেরুতাম না এখনও বের হই না।
মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে দেখছিলাম রমি বিছানার উপর ঘুমিয়ে আছে। ওর শুকনো মুখটা দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। এ ক'দিন কি খেয়েছে না খেয়েছে সবই দেখা আছে আমার। এই তিন দিনেই যেন তিরিশ বছর বেশি বয়স বেড়ে গেছে। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে কান খাড়া করলাম। সুড়ুৎ করে জানালার ফুল ফুল গ্রীলের ফোকোর গলে ভেতরে ঢুকে দৌড়ে গিয়ে ডোরহোলে চোখ রাখলাম। দেখি ছিপছিপে সুন্দর পাতলা মত এক মেয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে অধীর হয়ে আবারও বেল দিলো। কিন্তু রমি যেন মরার মত ঘুম দিয়েছে। কিছুতেই উঠছে না। আরও দু'দুবার বেল দেবার পর রমির ফোন বাঁজলো তাতেই তার ঘুম ভাঙ্গলো আর ও উঠে এসে দরজা খুললো।

- বাবা! সেই দু'ঘন্টা ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ( এহ কি আল্লাদী! দু'ঘন্টা না ছাই, দু' মিনিটও হয়নি, ভেংচে উঠলাম আমি। মেয়েটার ঢঙ্গ দেখে এমনিতেই আমার গা জ্বালা করছিলো। মনের মধ্যে কি রকম এক কুডাকও ডাকছিলো। কে বাবা এই মেয়ে!)
- তুমি! বাসা চিনলে কি করে?
- তোমার অফিস থেকে এড্রেস নিয়েছি। ধপ করে সোফায় বসতে বসতে বললো মেয়েটা।
- ওহ
- তোমার চেহারার একি অবস্থা করেছো রুম? বলি মানুষের কি জীবনে ঘটনা দূর্ঘটনা ঘটে না রুম! তাই বলে...
রুম! যেন ইলেক্ট্রিক শক লাগে আমার গাঁয়ে। ওহ তাইলে তুমিই সেই দেবা? হুম শিলা দেবী দেখি কত বাড় বাড়তে পারো। কত রুমে কত বাড়ি আজ দেখাবো তোমাকে।
- রুম প্লিজ তুমি এমন মন খারাপ করে থাকবে নাতো। যাও এখুনি রেডি হয়ে আসো। আজ রাতে আমার বাসায় খাবে তুমি।
বলে কি এই মেয়ে রাতে খাবে মানে কি? তারপর ? তারপর কি হবে? আমি অবাক হই ওর নির্লজ্জতা দেখে।
- না না আমি কোথাও যাবো না । আমি ভালো আছি তো বলছি।
- না না তুমি ভালো নেই। আমি দেখতেই পাচ্ছি তুমি কতটা খারাপ আছো। প্লিজ রুম। প্লিজ এমন করেনা সোনা...

এঁহহ হ হ.... প্লিঁজ রুঁম। এঁমন কঁরে নাঁ রুঁম! আমি রাগে আঙ্গুল মটকে বলে ফেললাম। যদিও মরে যাবার পরে আমার গলাটা কেমন যেন নাকি নাকি হয়ে গেছে মানে যাকে বেঁচে থাকতে আমরা বলি ভূতেদের খোনা গলা, তবুও সেই গলা শুনেই এক লাফে শিলা প্রায় রমিতের কোলে এসে বসলো। রমি আৎকে উঠে উঠে দাঁড়ালো। আর শিলাও টাল সামলাতে না পেরে ধপ্পাস করে মেঝেতে পপ্পাৎ ধরণীতল। তাই দেখে আমি আর হাসি আটকাতে পারি না।
- কে! কে হাসলো ওমন খোনা গলায়? কে কথা বললো! শিলার ভয়ার্ত চেহারা দেখে আমি হাসির দমক সামলাতে পারলাম না। হো হো করে হাসতে লাগলাম। শিলার চোখ তো তখন ছানাবড়া।
- কে আবার? আমার বউ।
- ব-ব-ব-উ মানে তো তো তো তোমার ব ব ব....ভ ...ভ... ভ.... শিলা তোতলাতে লাগলো।
- হ্যাঁ অপঘাতে মৃত্যু তো তাই ভূত হয়ে গেছে। এ কথা শোনার পরে শিলার সুন্দর চেহারাটা বাংলার পেয়ারা হয়ে গেলো। সে লাফ দিয়ে উঠে মেইন দরজাটায় এক বিষম বাড়ি খেলো এবং তারপর কোনোমতে দরজা খুলে ছুটে পালালো কোন জাহান্নামে কে জানে!

আমি পাক্কা সাড়ে চার মিনিট হাসলাম। তারপর হাসি থামতেই আমার ভীষন রাগ হলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো রমির মাথাটাই ফাটিয়ে দেই এক বাড়ি দিয়ে। এদিক ওদিক তাকালাম আমি। কি দিয়ে বাড়ি দেওয়া যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না। লাফ দিয়ে উঁচু আলমারীটা থেকে নামলাম। ফ্যানটাকে দুলিয়ে দিলাম এক হ্যাচকায়। চেয়ার তুলে ছুড়ে মারলাম দূরে। অবশ্য কাঁঠের ডাইনিং চেয়ারটাকে ছুড়িনি ভেঙ্গে যেতে পারে তাই। রাবারের ফোলানো আরাম কেদারাটাকেই ছুড়েছি। চোখ গিয়ে পড়লো দেওয়ালে ঝুলানো বিয়ের ছবিটার উপর। হঠাৎ সব রাগ গিয়ে পড়লো আমার সেখানেই। ছবিটাকে দেওয়াল থেকে তুলে মেঝেতে ছুড়ে মারলাম। রমি বসে বসে গম্ভীর মুখে সব দেখছিলো। কিন্তু বিয়ের ছবিটা খান খান হয়ে ভেঙ্গে যেতে দেখে সে এইবার ভীষন রেগে গেলো। আমার এহেন সৃষ্টিছাড়া কাজ কর্ম আর বুঝি তার সহ্য হলো না।

- অনেক হয়েছে! জাস্ট স্টপ ইট। বেঁচে থাকতে এই শিলা শিলা করে জ্বালিয়ে মেরেছো। মরে গিয়েও শান্তি দেবে না নাকি? ভালো চাও তো একদম বন্ধ করো এইসব নইলে...
আমার কান্না এসে গেলো। বেঁচে থাকলে এই মুহুর্তে চোখ জলে ভরে উঠতো। রাগে নয় অভিমানে। কেনো নিজে যখন শিলাকে আল্লাদ দিয়ে মাথায় তুলেছিলো তখন খেয়াল ছিলো না? এখন আমার উপর বাহাদূরী। ভীষন মন খারাপ করে বসে রইলাম রমির সামনেই। ভুলে গিয়েছিলাম আমার এই মন খারাপ দেখে মান ভাঙ্গাবার জন্য আর কেউ নেই এখন। আমি যে এই গোমড়া মুখে এক সমুদ্র কান্নার জল চোখে নিয়ে বসে আছি তা রমি দেখতেও পাচ্ছে না আর। তবে কি আবার শুরু করবো। খাঁটটাকে ছাদের উপর উঠিয়ে আছড়ে ফেলবো মাটিতে? নাকি বারান্দার সবগুলো টব এক ধাক্কায় নীচে ফেলে দেবো? যাইহোক আমার ভীষন অভিমান হলো। আমি কিছুই করলাম না। মন খারাপ করে এসির কোটরে উঠে শুয়ে রইলাম।

রমিও শুয়ে রইলো। সে তো ওঠেও না, ঠিক মত খায়ও না। সেদিন ওর এক আত্মীয় রুই মাছের মুড়োঘন্ট আর চাপিলা মাছের ভাঁজি দিয়ে ঘন মসুর ডাল আর আতপ চালের ভাত এনেছিলো। রমিকে আদর করে টেবিলে খেতে বসালো। রমি হাত মুখ ধুয়ে যেই না খেতে বসেছে। তার সেই খালা কাগজী লেবুর টুকরো পাতে তুলে দিয়ে একটা কচকচে সবুজ কাঁচামরিচও পাতে দিয়েছে। কিন্তু তিনি যেই না ধপধপে যুইফুলের মত এক মুঠো ভাতের উপর এক হাতা রুই মাছের মুড়োঘন্ট তুলে দিয়েছে। রমি খাওয়া ছেড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। তার খালা তো অবাক!
- বলি হয়েছে কি? কাঁদছিস কেনো?
- খালা আমি এই মুড়োঘন্ট খেতে পারবো না।
- ওমা কেনো পারবিনা! বিস্ময়ে হতবাক খালা...
- ও আমার জন্যই সেদিন কাঁচাবাজার যাচ্ছিলো রুইমাছের মুড়োঘন্ট তার আগের রাতে খেতে চেয়েছিলাম বলে। ও নিজেও এই মুড়োঘন্ট খুব পছন্দ করতো। আর এখন না জানি কত কষ্টে না খেয়ে দেয়ে আছে। আর তাছাড়া শুনেছি ভূতেরা মাছ খুবই পছন্দ করে। না ওকে ছাড়া আমি এ কিছুতেই খেতে পারবো না।
খালা বিস্ময়ে বাকহরা হয়ে যান। বলেন,
- ভূ ভূ ভূত মানে? রমি সোৎসাহে বলে,
- খালা জানো? ও না মরে গিয়ে ভূত হয়ে এখানেই রয়েছে। আমি টের পাই.... না না খালা এসব রেখে দাও ওর জন্য। সে এসে সব খেয়ে যাক। ভূত জন্মে কোথায় না কোথায় না খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার চোখ দিয়ে পানি এসে গেলো। কিন্তু একি!
সে কথা শুনে খালা আর কিচ্ছু না বলে বো করে ঘুরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন......

যাইহোক এইভাবেই কাটছে দিন।স্ত্রীর মৃত্যু উপলক্ষে রমি অফিস থেকে দু'সপ্তাহেরর ছুটি নিয়েছিলো। এই দু'সপ্তাহ সে একটাবারও হাসেনি। একা একাই কি সব ভেবেছে। দিনের বেশিভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছে গুটিশুটি মেরে। খাওয়া দাওয়ার বালাই নেই। বেশি খিধা লাগলে সন্ধ্যার দিকে উঠে ডাবল ডিমপোচ আর এক গ্লাস পানি খেয়েই আবার শুয়ে পড়েছে। আবারও আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ে, ধ্যাৎ কোন দুঃখে যে সেদিন ঝগড়া করে চোখ ভর্তি এক গাঁদা পানি নিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসের নীচে পড়লাম? রমির মুখের দিকে তাকানো যায়না। শুকিয়ে কাঁঠ হয়ে গেছে। একমুখ দাঁড়ি গোফের মাঝে জ্বলজ্বল করে চোখ দুটোই। দিন দুই আগে ওর এক বন্ধু এসেছিলো। ওকে দেখে অবাক!

-আরে একি চেহারা বানিয়েছিস? মারা পড়বি তো।
- মরা কি এতই সহজ? তাই যদি হত তবে .....রমির চোখে পানি এসে গেলো। সে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রইলো।
আমার মন খারাপ হবার কথা ছিলো রমির এই কষ্ট দেখে কিন্তু তা না হয়ে বরং কেনো যেন আনন্দ হলো। ভালোই হয় না খেয়ে যদি সে মরেই যায় তাইলে আমরা দুজন মজা করে আবার এক সাথে অশরিরী হয়ে এ বাড়িতেই সংসার পাততে পারবো। কিন্তু পরক্ষনেই বুঝলাম যা ভাবছি তা এত সোজা নয়। সেধে পড়ে ভূত হবার বাসনা কোনো জীবন্ত মানুষের নেই। রমি মুখে যাই বলুক তারও নেই।

এভাবেই রমির অফিসের ছুটি শেষ হয়ে গেলো। সকালবেলা কোনোকালেই তার ঘুম ভাঙ্গে না। আজীবন তাকে ডেকে তুলতে হয়েছে আমাকেই। আর এখন কে তাকে ডেকে তুলবে? রমির আলার্ম বেঁজে বেঁজে বন্ধ হয়ে যায়। কখনও সে নিজেই এলার্ম বন্ধ করে দিয়ে ভোস ভোস ঘুমায়। অফিসের গাড়ি এসে হর্ন দিয়ে ডেকে তুললে সে তড়িঘড়ি কোনোরকমে রেডি হয়ে অফিসে ছোটে। আমার ভীষন মায়া লাগলো।

একদিন রমি রেডি হয়ে সকালের নাস্তা তৈরীর যুদ্ধ চালাচ্ছিলো। সে ফ্রিজ থেকে ডিম নিয়ে বাটিতে ডিমটা ভাঙ্গতেই আমি ওকে সাহায্য করবার জন্য ফ্রাইপ্যানে তেল ঢেলে দিতে গেলাম। রমি প্রথমে হা করে তাকিয়ে রইলো। শুন্যে তেলের ক্যানটা ভাসছে দেখেই। পরমুহুর্তে ভীষন খেপে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে আমার তেলের ক্যানটা ফেলে দিলো। সব তেল ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে।

- হয়েছে! আর ঢঙ্গ দেখাতে হবে না। বেঁচে থাকতে যাচ্ছেতাই বলেছো। অকারণে দোষারোপ করে নিজে মরেছো। এখন এসেছো দরদ দেখাতে? লাগবেনা তোমার আমার জন্য এত দরদ। লাগবেনা তোমার ভালোবাসা। লাগবেনা আমার জন্য এত কষ্ট করা। এই সব ঢঙ্গ ছাড়ো। বেঁচে থাকতে যা নয় তাই বলে গাল দেওয়া আর এখন মরেছি তাই এত ভালোবাসা উথলে উঠছে না? লাগবেনা তোমার ভালোবাসা। আজই আমি মৌলভি ডেকে মিলাদ পড়াবো। ঝাঁড়ফুক করে ভূত তাড়াবো। আমার সত্যিই ভয় হলো যদি আবার ভূতের অত্যাচার বাড়াবাড়ি করলে বলাও যায় না ওঝাই ডেকে আনে বা কোন মাওলানা কিংবা হাফেজ। শেষে দিন রাত ঝাঁড়ফুক করে বাড়ি বন্ধ করে বসে থাকে। তখন তো আমাকে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে। রমিকে ছাড়া আমি কি করে বাঁচবো? পরক্ষনেই আমার চিন্তা হলো। আচ্ছা ভূতেদের কি মরণ আছে?

অভিমানে আমি সাতদিন এসির কোটর থেকে নামলামই না। রাতদিন শুয়ে রইলাম একা একা চুপচাপ। মরেই না হয় গিয়েছি। মরে গিয়েও কি রমিকে ভুলতে পেরেছি? পেরেছি কি তাকে ছেড়ে থাকতে? তবুও কেনো রমির এই অন্যায় আচরণ? সে কেনো আমাকে আরও বুঝালো না? সে কেনো শিলার সাথে যোগাযোগ রেখেই আমার সন্দেহ বাড়িয়েই চলছিলো। সে কেনো আমি বলার পর পরই শিলার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করলো না???
আমার সব রাগ গিয়ে পড়লো শিলার উপর। প্রতিশোধ। ভূতের প্রতিশোধ।কিন্তু কাজটা হওয়া চাই সাবধানে। কোনোক্রমে সন্দেহের মাঝে পড়ে গেলেই তারা ডেকে আনবেন ওঝা, তারাই ভূতেদের পুলিশ,জজ, ব্যারিস্টার, আইন আদালৎ। তারা আবার কখন কে বোতলবন্দী করে ফেলে কে জানে? না না বোতলে বন্দী হয়ে আমি আজীবন কাটাতে পারবোনা বাবা। কাজেই কাজটা করতে হবে সুক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে। যত দিন লাগে লাগুক।
এক অমাবস্যার রাতে চারিদিক ঘুরঘুট্টি অন্ধকার দেখে আমি উড়াল দিলাম শিলার বাড়ির উদ্দেশ্যে। রমিত সোফায় শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিলো। আমি গিয়ে বসলাম ওর পাশে। সে বুঝতেও পারলো না। তার কাছে নীরবেই বিদায় নিয়ে আমি চললাম শিলার বাড়িতে।
রমিতকে ছেড়ে যেতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো। মনকে প্রবোধ দিলাম কয়েকদিন তো মাত্র।

যাইহোক উড়তে উড়তে পৌছুলাম শিলাদের বাড়িতে। শিলার বেডরুমে উঁকি দিয়ে তো আমি তাজ্জব! তখন রাত দু'টো। ঘরের ভেতর হালকা নীল ডিম লাইট জ্বলছে। ফুরফুরে বাতাসে আকাশনীল রাতের পোষাকে শিলা তার স্বামীর গলা জড়িয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। আমার গা জ্বলে গেলো। বদ মেয়ে আমার জীবন নষ্ট করে, আমার স্বামীর দিকে কু নজর দিয়ে তুমি মহানন্দে নিজের হাসব্যান্ডের গলা ধরে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছো! দাঁড়া তোর মজা দেখাচ্ছি।

শিলা পাশ ফিরে শুয়ে ছিলো। তার ডান হাতটা ছিলো তার হাসব্যন্ডের বুকের উপরে। আমার মাথায় আইডিয়া খেলে গেলো। আমি সেই হাতটার উপর খুব সন্তর্পণে ভর করলাম। গভীর ঘুমে আছ্ন্ন সে। কিন্তু তার অনড় অবশ ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে যাওয়া হাতটা হঠাৎ শূন্যে উঠে এলো। মানে ভূতের কৃপায়। তারপর শূন্যে দোল খেতে খেতে তার স্বামীদেবতার এক মাথা ঘন কালো চুলের মাঝে আঙ্গুলগুলো ডুবে গেলো। তারপর মুঠো করে ধরে এক হ্যাঁচকা টানে ছিড়ে আনলো একমুঠো চুল। স্বামীদেবতা তো এক নিমিষে চিৎকার করে চোখ মেলে দেবতা থেকে রাক্ষস হয়ে গেলেন! গাঁক গাঁক করে উঠে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখলেন, তার ঘন কালো এক মুঠো চুল হাতে নিয়ে তার পত্নীদেবী তারই দিকে তাকিয়ে বিস্ফারিত নেত্রে বসে আছেন। তার চোখ দিয়ে জল ঝরছিলো ব্যাথায়। হবে না ? যেন তেন খাঁমচি নাকি! একে বলে ভূতের খাঁমচি। শিলার চোখে একই সাথে ছিলো বিস্ময় ও কষ্ট। এই করুণ মুখে তাকিয়ে মনে হয় বিধাতাও তার শত পাপ মাফ করে দেয়। আহা আমারই তো মায়া হচ্ছিলো। দয়াও হচ্ছিলো। কিন্তু শিলার পতিদেব তার মাথার উপরে হাত বুলিয়ে ব্যাথায় নাকি এক মুঠো চুল হারানোর দুঃখে কাতর না হয়ে বাঘ হয়ে গেলেন। শিলার চুলের মুঠি ধরে হিড় হিড় করে টেনে ঘরের বার করে দিলেন। শিলা আত্মপক্ষ সমর্থণে নানাকিছু বলে চিল্লাচ্ছিলো কিন্তু গাঁক গাঁক শব্দের মাঝে সে ক্ষীন স্বর কোথায় হারিয়ে গেলো। আমি হাসতে হাসতে দরজার বাইরে বসে থাকা শিলার চারিধার ঘিরে নৃত্য করতে লাগলাম। ভূতের নাচ কাকে বলে সেদিন বুঝেছিলাম।আহা কি আনন্দ। বেঁচে থাকতে এ নাচের আনন্দ জানলে কত্থক কথাকলির মত ভুতের নাচও আমি জগতে চালু করে দিতাম।

যাইহোক বেশিক্ষন আনন্দ সহ্য হলো না। খুব ভোরে শিলা কোনো কূল কিনারা না পেয়ে সোজা রমিতের কাছে চলে এলো। আমিও ওর সাথে সাথেই ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরে এলাম। যদিও উনার বৃদ্ধি কতখানি হয়েছে তা দেখতে দেখতে রাগে আমার দাঁত কপাটি লেগে যাচ্ছিলো। তবুও সুযোগ দিলাম। দরজা খুললো রমিত। শিলা কেঁদে ওর বুকে লুটিয়ে পড়লো। আমি তো তার কান্ড দেখে ভুতুড়ে ভয় দেখাতেও ভুলে গেলাম।

শিলা কেঁদে কেটে কি কি সব বলছিলো আমার কানেই ঢুকছিলো না। দরজা খোলা পড়ে রইলো আর উনারা ..... উফফ কি করবো না করবো ভেবে ওঠার আগেই দেখি বিশাল এক রিভলভার হাতে দরজায় এক ডাকু ডাকু চেহারার টাকলু লোক। কোথায় যেন দেখেছি ওকে। ওহ পরক্ষনেই তার গাঁক গাঁক হাঁক শুনে আর মাথার উপরে সদ্য ছাল চামড়াসহ উপড়ে নেওয়া চুলহীন মস্তিস্ক দেখে চিনে ফেললাম শিলার স্বামীকে। তবে ট্যাক্সি চেপে আমি একাই আসিনি শিলার সাথে সাথে এ বাড়িতে। উনার স্বামীদেবও শিলাকে ফলো করে চলে এসেছেন। গুড গুড। খেলা দেখতে আমি ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে আমার এসির কোটরে আরাম করে পা ঝুলিয়ে বসলাম।

শিলা রমিতের বুকের মাঝেই মুখ গুঁজে পড়ে ছিলো। স্বামীর ঐ রুদ্র মূর্তী দেখে তড়াক করে উঠলো। স্বামীদেব বললেন,
- ও এই তাহলে সেই কৃষ্ণ ! যার জন্য মাঝ রাত্তিরে তুই আমার চুল ছিঁড়ে টেকো বানাতে চেয়েছিলি আজ আর তোর রক্ষা নাইরে পাপিষ্ঠা.....রিভলবার তাক করেই গুলি ছুঁড়ে দিলো রাগের বাঘটা আর রমিত এক ঝটকায় শিলাকে এক পাশে সরিয়ে বলে উঠলো,
- কি বাঁজে বকছেন... শি শি শি শি.... দুড়ুম দুড়ুম দুইটা গুলির শব্দ। কিন্তু গুলি দু'টিই শিলার গায়ে না লেগে রমিতের পাঁজর ভেদ করে চলে গেলো.....
আশে পাশের ফ্লাটের লোকজন ছুটে এলো। জড়ো হতে লাগলো ফ্লাটের দরজায় আর রমিত উঠে এলো এসির কোটরে...ঠিক আমার পাশাপাশি পা ঝুলিয়ে গম্ভীরমুখে বসলো সে.... আমি হাসিমুখে ওর কাঁধে মাথা রাখলাম। আঙ্গুলে আঁচল জড়াতে জড়াতে গেয়ে উঠলাম গুনগুনাগুন,
যে তোমার ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ছি না না না না না না .....


সমাপ্ত



যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়বো না (ভূত সিরিজ -১)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৪৪
৩৯টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রামের রঙিন চাঁদ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১২


গ্রামের ছায়া মায়া আদর সোহাগ
এক কুয়া জল বির্সজন দিয়ে আবার
ফিরলাম ইট পাথর শহরে কিন্তু দূরত্বের
চাঁদটা সঙ্গেই রইল- যত স্মৃতি অমলিন;
সোনালি সূর্যের সাথে শুধু কথাকোপন
গ্রাম আর শহরের ধূলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৭



পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষঃ
পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরবাসী ঈদ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৩

আমার বাচ্চারা সকাল থেকেই আনন্দে আত্মহারা। আজ "ঈদ!" ঈদের আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ হচ্ছে ওদেরকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে এই একটা সুবিধা ওরা পায়, বাড়তি ছুটি!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×