somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বর্ষায় বগালেক ও কেওক্রাডাং: শেষ পর্ব (কেওক্রাডাং চূড়ায় উড়িয়ে দিলাম লাল সবুজ নিশান)

২০ শে জুলাই, ২০১০ বিকাল ৫:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বর্ষায় বগালেক ও কেওক্রাডাং: ১ম পর্ব (যাত্রা হলো শুরু)

বর্ষায় বগালেক ও কেওক্রাডাং: পর্ব ২ (বগা লেকের পথে পথে)

১০ জুলাই ২০১০

পরদিন খুব ভোরে উঠে আমরা রেডি হয়ে নিলাম। রাতে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ায় একটু ভয়ে ছিলাম। সকালে আবহাওয়া বেশ ভালো দেখে একটু স্বস্তি পেলাম। সিয়াম দিদির খিচুরি-ডিম ভাজি পেট পুরে খেয়ে আমরা রওয়ানা হলাম আমাদের মূল গন্তব্যে। কিওক্রাডাং। আবার শুরু হলো হাঁটা। গাইড আমাদের আগেই সতর্ক করে দিলো এ পথে জোঁক থাকতে পারে আর বৃষ্টি হওয়ায় পথ পিচ্ছিল।

আমরা হাঁটছি আর বিভিন্ন জায়গায় থেমে ছবি তুলছি। কিওক্রাডং যাওয়ার পথে মেঘ আর পাহাড়ের খেলা আরো বেশি জমজমাট আরো বেশি ঘনিষ্ঠ। পাহাড়, সবুজ আর মেঘের দুষ্টুমিতে প্রকৃতি সেজেছিলো বর্ণাঢ্য এক রূপে।

হঠাৎ গাইড আমাদের বললো ‘দেখেন মামা জোঁক কীভাবে লাফালাফি করতেছে।’ জোঁকের লাফালাফি দেখাতে গিয়ে গাইডের পায়েই বেশ বড়সড় একটা জোঁক আক্রমণ করে বসলো।

কিছুদূর হাঁটার পর আমরা শুধু ঝোঁপ ছাড়া কিছু দেখতে পেলাম না। গাইড জানালো এ পথেই যেতে হবে। জোঁকের ব্যাপারে আবারো সাবধান করে দিলো। দৌড়ে ঝোঁপটা পার হলাম। এরপর বেশ সমতল আর ঝোঁপঝাড় বিহীন রাস্তা। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা ঝর্ণার দেখতে পেলাম। আমার দেখা সবচেয়ে বড় এ ঝর্ণার নাম চিংড়ি ঝর্ণা। ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। এসময় মনে হলো জুতো খুলে একবার দেখা দরকার। জুতো খুলে আমি হতভম্ব।! ভেতরে দু দু’টো জোঁক কিলবিল করছে! একটুও বুঝতে পারিনি। সবাইকে বললাম যার যার জুতো চেক করে দেখতে। জীবনের জুতো থেকে দু’টো আর মুসার জুতো থেকে একটা জোঁক পাওয়া গেলো। ব্যাপারটাতে সবাই একটু তটস্থ হয়ে গেলাম। এরপর যতটুকু পথ পার হয়েছি একটু পরপরই জুতো খুলে দেখে নিতাম।

পথে আমরা কুমি পাহাড় আর দার্জিলিং পাড়ায় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য দু’বার থামলাম। প্রায় চার ঘন্টা হাঁটার পর গাইড দেখালো কিওক্রাডং এর চূড়া দেখা যাচ্ছে। এবার আমাদের মধ্যে কে আগে উঠবে তা নিয়ে শুরু হলো প্রতিযোগিতা ।

১০ জুলাই ২০১০ বেলা ১১টা । আমাদের দলের প্রত্যেকের জীবনে এ দিন ও ক্ষণটি বিশেষভাবে স্মরনীয় হয়ে থাকবে। এ ক্ষণটিতে আমরা পা রেখেছিলাম ৩১৭২ ফুট উঁচুতে....কিওক্রাডং চূড়ায়। সবার প্রথমে রতন। তারপর একে একে রউফ, আমি, জীবন আর মুসা। সে ক্ষণের অনুভূতি যে কী তা আমার মতো লেখালেখিতে আনাড়ি মানুষ ভাষায় বোঝাতে পারবেনা!

চূড়ায় উঠার পর আকাশ ছিলো রৌদ্রময়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়গুলোকে মেঘ গ্রাস করতে শুরু করলো। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখছিলাম। দ্রুতই আমাদের চারপাশটা সাদায় সাদায় ছেয়ে গেলো। মনে হলো মেঘ আমাদের ঘিরে ফেলতে শুরু করেছে। হাত বাড়ালেই মেঘ ছোঁয়া যাবে। যেন প্রকৃতি আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য মেঘ-দূতকে পাঠিয়েছে! একটু পরেই ঝুপ করে নামলো বৃষ্টি । মিনিট দশেক পর ভোলবাজির মতো বৃষ্টি খেদিয়ে উঠলো রোদ। প্রকৃতির এ লীলাখেলায় আমরা বিমুগ্ধ ও হতবাক! এ দৃশ্য মনের ফ্রেমে বন্দী করা ছাড়া কোন ক্যামরায় সঠিকভাবে ধারন সম্ভব বলে মনে হয়না। তারপরও আমরা বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তোলা শুরু করলাম।

চূড়ার উপর একটি ইট-সিমেন্টের ছাউনি রয়েছে। আমরা তার উপর উঠে গেলাম। উড়িয়ে দিলাম আমাদের অহংকারের লাল-সবুজ নিশান। এরই ফাঁকে রউফ আর জীবনকে দু’টি বেশ বড় সাইজের জোঁক আক্রমণ করে বসলো। কিন্তু বিজয়ের আনন্দে তখন সকল ভয়, ঘৃণা ম্লান হয়ে গিয়েছিলো।











আধঘন্টার মতো চূড়ায় থাকলাম। আমাদের পানি ও খাবারের রসদ ফুরিয়ে যাওয়ায় পাশের মুরং গ্রাম থেকে ভর্তি করে নিলাম। এবার নামতে শুরু করলাম। আবারো শুরু হলো বৃষ্টি। থামার কোন লক্ষণ নেই। পুরো কাকভেজা হয়ে আমরা বগা লেক ফিরে এলাম মাত্র দুই ঘন্টায়। সবার পেছনে গাইড আর জীবন ছিলো। জীবন হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এসে বললো, ‘দাদা প্রায় তিন-চারশো জোঁক এক সঙ্গে কিলবিল করছে। আমি ছবি তুলতে চেয়েছিলাম। গাইড মামা বলে কিনা এখনই দৌড় দেন নাহলে লাফ দিয়ে সব আপনার গায়ে উঠবে।’

বগা লেকে এসে আমরা আধ ঘন্টার মধ্যে খেয়ে-দেয়ে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিলাম। পা ব্যথায় টনটন করছে। শরীর প্রায় শক্তিহীন। কিন্তু কিছুই করার নেই । কারন সেদিনই রুমা বাজার ফিরতে চেয়েছিলাম। গাইডকে বললাম চাঁদের গাড়ি ঠিক করতে। গাইড জানালো বাইশো টাকার নীচে গাড়ি রিজার্ভ করা যাবেনা। তবে সেজন্য আগে দেড় ঘন্টা হাঁটতে হবে। তারপর গাড়ি পাওয়া যাবে। আমরা রাজি হলাম। দেড় ঘন্টা হাঁটার পর আমরা যখন গাড়িটি দেখতে পেলাম তার অনুভুতি কেওক্রাডাং চূড়ায় উঠার চেয়ে সম্ভবত বেশি আনন্দের ছিলো!!!

দু’দিনে গাইড কাজলকে আমরা বেশ আপন ভাবতে শুরু করেছিলাম। ভেবে রেখেছিলাম যাওয়ার সময় এমনিতেই টাকা বাড়িয়ে দিবো। কিন্তু জানতে পারলাম গাড়ি ভাড়া নিয়ে বেটা আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গাড়ি ভাড়া দেড় হাজার টাকা। বেটা বাইশো টাকা বলে আমাদের কাছ থেকে টাকা মারতে চেয়েছিলো। এ ঘটনার পর পাওনা টাকা ছাড়া কাজলকে আমরা আর একটি টাকাও বেশি দেয়নি।

রুমা বাজারে এসে আবার উঠলাম হোটেল হিলটনে। ততক্ষণে অনুভব করলাম আমাদের সর্বাঙ্গে ভয়াবহ ব্যথা। খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই কিছু পেইনকিলার খেয়ে নিলাম। পরদিন ঘরের ছেলেরা নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারলেই সমাপ্তি ঘটবে আমাদের রোমাঞ্চকর এ অ্যাডভেঞ্চারের।#
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:৩৭
১৮টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×